আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে
পর্ব -১৯
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
পথ
"এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে/ তা কে জানে তা কে জানে" রবীঠাকুরের এই গান খানি কোন কল্পলোকে আমাদের নিয়ে যায় এবং নিগুঢ় দার্শনিকতায় গভীরভাবে ভাবতে শেখায়।আমি যদি রাস্তার কথা বলি, আপনি চেয়ে আছেন ঠিক আপনার বাড়ির পথটাতেই বেশ খানিকটা দেখতে পাচ্ছেন যতখানি আপনার চোখ আপনাকে দেখাবে। ইচ্ছা করলেই আপনি কিন্তু এই পথ দিয়ে শুরু করলেই সারা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন।
কত পথ কত রাস্তা পৃথিবীতে আছে এ কথা মাচিত্রেও লেখা থাকেনা। সবাই তো রমানাথ বিশ্বাস হতে পারে না। তিনি সাইকেল করে পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন। পথ তাঁকে আপন করে নিয়েছিল।
আমরা আবার জীবনের পথকেও পথ বলতে পারি।কথার প্রসঙ্গে বলি জীবনের মোড় ঘুরে গেল তার। এ মোড় তো চৌমাথা বা পাঁচ মাথার মোড় নয়। এ হলো জীবনের পথ, যে পথ আপনার লক্ষ্য স্থির করবে আপনি কি করবেন, আপনি কি হবেন এই সব কিছু যা আপনার আলাদা identity বহন করবে। যেমন উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি প্রখ্যাত লেখিকা বেবী হালদারের কথা। অনেক দুঃখ কষ্ট অভাব অনটনের মধ্যে বড়ো হয়েছেন, ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন, আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য তারপর আর পড়তে পারেননি। অল্প বয়সে বিয়ে এবং অত্যাচারিত হয়ে পরে তিনটি বাচ্চা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দিল্লি চলে আসেন। তিনি পরিচারিকার কাজ করতে করতে তারপর সৌভাগ্যবশত গুরগাঁও এ প্রখ্যাত লেখক মুন্সী প্রেমচাঁদের পৌত্র ভূবিদ্যার অধ্যাপক প্রবোধ কুমার শ্রীবাস্তবের বাসায়। সেখানেই বেবীর জীবনের মোড় ঘুরে যায়, জীবনের অনন্য পথ খুঁজে পান বেবী।
কার জীবনে কোন পথ যে তার জন্য অপেক্ষা করছে কেউ বলতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি আমাদের সবার প্রিয় " আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন"।
সত্যিই আমি একজন সামান্য মানুষ, জীবন যেমন চলছে চলবে তেমন দিনগত পাপক্ষয়। এই বৈচিত্র্যহীন জীবনে এমন একজন মানুষ এসে আমাকে অমৃতের সন্ধান দিল আমাকে ধন্য করল।
আমি ভাবিনি আগে কিছুই, এমন এক সাজানো পথ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে?
পথ তো তোমার জন্য সেজে বসে থাকবেনা, তোমাকে তোমার পথ তৈরী করে নিতে হবে।
সাইকেল একবারে চালানো শেখা যায়? নাহ্ বারবার পড়তে হয় তবেই শেখা যায়। সমস্ত দূরের পথ তখন কাঁচি দিয়ে ছেঁটে ছোট করা যায়।
আমার মনে হয় পথ মানে একটা অঙ্ক শুধু সমাধান টুকু আপনাকে ধৈর্য্য ধরে করতে হবে।
ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন "যত মত তত পথ" মহাপুরুষের বাণী এ এক মহা জাগতিক উপলব্ধি। যত নিয়ম তৈরী হবে সেই নিয়ম আমাদের পথ দেখাবে, খুলে দেবে নতুন রাস্তা। আমরা সারাজীবন এই দুই পায়ের উপর ভর করে কত পথ হাঁটলাম কেউ তার হিসেব জানিনা।
আরো কত হাঁটতে হবে আরো কত নতুন পথের দেখা পাব তা আমরা কেউ জানিনা। বড় বিচিত্র মানব জীবন আমরা কত কিছু নিয়ন্ত্রন করতে চাই শেষ পযর্ন্ত সব কর্ম আমাদের হাতে থাকেনা। আমরা অনেক সময় বলি ও বিপথ এ চলে গেল, ভাগ্য ওকে নিয়ে গেল। কিন্তু এই বিপথ টা আসলে কি? মানে খারাপ রাস্তা বা কুসঙ্গ। অনেক ভালো মানুষ খারাপ সঙ্গে পড়ে তার জীবনের পথটা নিজের অজান্তে আপন হাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
পথিক, পথ, ভবঘুরে আর বাউল এই চারটি টি শব্দ আমাকে পাগল করে দেয়। এই শব্দ গুলো কে একত্রিত করলে পাই এক বন্ধনহীন পথের গ্রন্থি।
আমি যে পথে যেতে চাই সে পথকে সহজেই ছুঁতে পারব। আমি কিছুই আপন করে ধরে রাখব না কিন্তু পথ আমাকে ধরে রাখবে। আমার বুকের ভেতর এঁকে দেবে অনন্ত পিপাসার আকুতি। আমি চিনবো প্রাণ ভরে কত জীবন কত নতুন জায়গা যেখানে কেউ আমাকে চেনেনা। অচেনার কাছে রেখে আসবো আমার নবীন ঠিকানা। ট্রেনে, বাসে কিংবা ফ্লাইটে যখন ভ্রমণ করি কিছুটা সময় সবাই একই পরিবারে মতো মনে হয় অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা আমাকে ঘিরে ধরে। কত নতুন গল্পের জন্ম হয়, আমি সদ্যজাত গল্প নিয়ে গন্তব্যে ফিরি। আমি তো জানিনা সবার বাড়ির ঠিকানা, জানিনা কোন পথ কোন গলি কোন শহর সবই অজানা রইল শুধু কিছু গল্প আর কিছু উজ্জ্বল মুখের রেশ রয়ে গেল।
হেমন্ত ঋতুর একটা আলাদা মাধুর্য আছে।মনে হয় কৈশোর আর যৌবনের মধ্যবর্তী অবস্থা। এই অবস্থা কে আমি বলি হেমন্ত বিতান। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায় কেমন একটা বিষণ্ণতা গ্রাস করে।
বারবার ইচ্ছে হয় অতীত স্মৃতির সরণিতে হাঁটতে।
ফেলে আসা পথ যেন বর্তমান হয়ে খেলা করে।
লাজুক মুখচোরা মেয়ের মতো এই হেমন্তকাল। তার দুঃখ বেদনা প্রেম রোমাঞ্চ সবই বড় নীরব পায়ের ছাপ। নিঃশব্দে চলে যাওয়ার পর বুকে একটা চিন চিনে ব্যথা বোধ হয়। তার জন্য আমাদের কোনো আড়ম্বর নেই। শিউলিরা সারি সারি খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধে যায়। গাছ তার না বলা কথা রসে সিক্ত করে রাখে। বুলবুলি টিয়া শালিখ স্বাদে আস্বাদে জমাট হয় পরকীয়া। শেফালির আবেগী পতন সারারাত শিশির ভেজা খেলা। খরচ হয়ে যায় দিনটা খুব তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যা নেমে আসে ঘরে ফেরা পাখির ডানায়। আছে সবই কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতা জমা হতে থাকে। উৎসবমুখর এই কালটি। তুহিনা বসন্তমালতী নিভিয়া পন্ডস্ এখন ল্যাকমি লোটাস কেয়া শেঠ একেবারে ক্রিম ভরা মাখনের মতো জীবন। ওডিকোলনের গন্ধে ভরপুর এ জীবন। সবছেড়ে এখনো আরো কতো জীবনজুড়ে থাকবে সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন। ।মনের ভেতর যত পুরনো আনন্দ দুঃখ কে কেবলই উল্টে পাল্টে দেখতে ইচ্ছে হয়। কী কী করলে ভালো হতো এসব ভেবে সময় কে পোস্টমর্টেম করে সময় অপচয় করি। মনটা থেকে থেকেই চা কফি ডেকে ওঠে।
কতদিন অচেনাপুরে ভ্রমণ করিনি। ইচ্ছে করে সব চেনা ছেড়ে একেবারে আনকোরা জায়গায় গিয়ে নিজেকে নতুন করে ঝালিয়ে নিই।
নবান্নের সুবাসে ঘর ভরে ওঠে। আলপনা দিই মনের কলকায় আর ধানশিষে। দূরে গান বাজছে চিরাচরিত ছটপুজোর গান । হেমন্তকালের অস্পষ্টতা থেকেই গেছে মনে কখনই
সে ভাবে ছুঁতে পারিনি এই কালকে । যত বয়স বাড়ছে তত প্রকৃতি এবং মানুষের উৎসব গুলো যেন চরম অর্থবহ হয়ে ওঠে। জীবনের একটা সময় সব কিছুর ভীষণ প্রয়োজন হয়। সেই চাহিদা পূরণে জীবন দৌড়তে থাকে। এক প্রয়োজনের স্টেশন থেকে আরেক চাহিদার স্টেশনে ধাবিত জীবন।
কোনো কিছুই স্থায়ী নয় সবই হেমন্তের শিশিরের মতো টুক করে মিলিয়ে যায়। মানুষ সব ভুলে যায়।
গরমকালে কী আমরা শীতের পোশাক লেপ কম্বলের কথা ভেবেছিলাম ? কিন্তু আবারও এ মাসেই তাদের বের করতে হল। আমি ছোটবেলায় শীতের নারকেল তেলে বরফের আনন্দ পেতাম, মা যে কেন রোদে দিত শিশিটা!! গ্লিসারিন সাবান টা এ মাসেই এসে যেত। যাই বলুন আর তাই বলুন বাথরুমে চুপিচুপি মুখে দিয়ে দেখেছিলাম চকলেটের মতো খেতে কিনা! মাদুরে লেপ বালিশ কম্বল রোদে দিত যেখানে সেখানে বসে পড়া কমলালেবু খাওয়া সব চলত।আর বাড়ির বেড়ালটা আমার পাশে বসে আরামে মিউ মিউ করত কয়েকবার।
এই সময় টা যাত্রা হতো কিন্তু আমার যাওয়া হতো না খুব সম্ভত ডিসেম্বর এ ফাইনাল পরীক্ষা থাকত। তবে পরের দিকে এলে যেতাম।
প্রতিবছর একটা নতুন সোয়েটার হতই সে হাতে বোনা কিংবা কেনা, ভীষণ আনন্দ পেতাম।
সার্কাস অবশ্য জানুয়ারিতে আসতো সে দারুণ হতো তখন সব জন্তু থাকত কিন্তু জোকার কে দেখতেই ব্যস্ত থাকতাম। এই হেমন্তে মাঠে পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচ দেখা খোলা ছাড়িয়ে বাদামভাজা খাওয়ার আলাদা আনন্দ। আমাদের গরমের দেশটা হিমেল পরশ ছড়িয়ে কেমন বিদেশ হয়ে ওয়ে ওঠে। মিলন মানেই মেলা তার মানেই উৎসব। আকাশে বাতাসে নলেন গুড়ের গন্ধ। মিষ্টির দোকানে সাজানো নলেন গুড়ের সন্দেশ ঘরে ঘরে পায়েসের সোনালী আভা গুড়ের।
পুজোসংখ্যা গুলো সব পড়ে ফেলতে হবে।
ঝুপ করে দিনের মাঝে কে যেন শাটার তুলে দেয়!
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালি দেবতার ঘরে। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো জীবন ক্রমশ ফেড হয়ে আসে। কতশত পর্ব পার করে আসি জীবনের সবই সময়ের দান। সময় আমাদের পুতুলনাচ করায়।
তবুও সকাল হলেেই আমি সাহস পাই
সূর্যের সাত রঙা রং মেখে নিই আমার মনের ঘরে।
আমি বাঁচি যত বুঝি আমি আছি প্রেমও আছে ঘরের প্রদীপের আলোতে আমার জীববোধে।। আমি ও রোজ প্রদীপে সলতে পাকাই প্রদীপ কে সিক্ত করা চাই না হলে আলো জ্বলবেনা।
হেমন্ত আমাকে বিষণ্ণতা দেয় নিজেকে ভাবতে শেখায় ভালোবাসতে শেখায়। আকাশ প্রদীপ জ্বালি দূরের তারার পানে। জন্ম জন্মান্তরে জীবনের খেলাঘর জীবের অপার বিস্ময়।
হেমন্ত লক্ষ্মীর চরণে ধন্য হোক বাস্তুভিটা প্রাঙ্গণ।
কবি কিটস্ এর বড় কবিতার মতোই আমাদের এ জীবন।
0 Comments