জ্বলদর্চি

বাঁদনা পরব - গরয়া পূজা কী ও কেন /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৪৫

বাঁদনা পরব -  গরয়া পূজা কী ও কেন

সূর্যকান্ত মাহাতো


কার্তিকী অমাবস্যার রাত্রি হল 'জাগরণের' রাত্রি।

জিজ্ঞেস করলাম, "'জাগরণ' কেন? 'জাগরণ' মানে তো নিদ্রাহীন ভাবে জেগে থাকা। জেগে থাকা কেন?"

বন্ধু বলল, কারণ এই রাত্রে জেগে থাকলে 'লক্ষ্মী' লাভ ঘটে এমনটাই মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, এই রাতে জেগে থাকলে 'গো-সম্পদেরও' বৃদ্ধি ঘটে (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য: পৃষ্ঠা১১৯)। সেই সঙ্গে 'ধেনু গাই' লাভের সম্ভাবনার কথা জাগরণের 'অহিরা' গানেও স্পষ্ট। এমন কি 'অমাবস্যা' রাতকেও জাগিয়ে রাখার কথা গানে গানে বলা হয়েছে---

"জাগ মা লক্ষ্মী জাগ মা ভগবতী জাগে ত অমাবস্যার রাইত রে
জাগাকে পতিফল দেবে মা লছমী পাঁচপুতায় দশধেনু গাই রে।"

বললাম, "কীভাবে সবাই জেগে থাকে?"

বন্ধু বলল, "'অহিরা' গানে গানে। ঢোল ধামসা নাগাড়া মাদলের মতো বাদ্যযন্ত্রের বাজ বাজনায়। নেচে নেচে। গানের নাম 'অহিরা' গান হলেও একে 'গোরু জাগানোর গান' বা গোরু 'জাগ্যানা গান' বলেও অভিহিত করা হয়। 'ধাঁগড়িয়া'-রাই গোরু বাছুরকে জাগিয়ে রাখার কাজটি করে থাকে।"

'ধাঁগড়িয়া' শব্দটি শুনে বললাম, "সেটা আবার কী?'"

বন্ধু বলল, 'ধাঁগড়িয়া' শব্দটা 'ধাঁগড়' বা 'ধানগর' শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হল 'চাকর' বা 'ভৃত্য'। মূলত এরাই গোরু জাগানোর কাজটি করে থাকে।"

বললাম, "চাকর - বাকর বলতে কারা? জঙ্গলমহলের অধিকাংশ কুড়মি মাহাতো সহ যারা 'বাঁদনা' পরব পালন করে থাকে তারা তো অনেকেই গরিব! কীভাবে তাদের চাকর বাকর থাকা সম্ভব?"

বন্ধু বলল, "কিছু কিছু অবস্থাপন্ন বাড়িতে অনেকেই 'ভাত' এর বিনিময়ে কিংবা সামান্য অর্থের বিনিময়ে শ্রমিকের কাজ করত। এদেরকে বলা হয় 'ভাতুয়া' বা 'মুনিশ'। এছাড়াও গোরু বাছুর চরানোর জন্য বাগালেরা তো থাকতই। তাই এরাই সাধারণত গোরু জাগানোর কাজটি করত। তবে এখন আর কেবল ওরাই শুধু নয়, পাড়ার প্রায় সকলেই এই গোরু জাগানোয় অংশগ্রহণ করে।"

বললাম, "কীভাবে গোরু জাগানো হয়?"

বন্ধু বলল, "বাড়ি বাড়ি গিয়ে। প্রতিটি গোয়াল ঘরের সামনে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের গম গম শব্দে আর 'অহিরা' গানে গানে। নেচে নেচে। এভাবেই গোরু জাগানোর কাজটি সম্পন্ন করে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে 'গোরু জাগানোর' প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, প্রতিটি বাড়ির গোয়াল ঘর প্রদর্শন করা। গ্রামের প্রতিটি গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখা সকলে গোরু বাছুরের প্রকৃত যত্ন আত্তি করেছে কিনা। কারো বাড়িতে তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে গৃহকর্তাকে এভাবেই গান ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে জাগিয়ে তোলাই  বোধ হয় প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল। এছাড়াও এর পিছনে মহাদেবের আগমনের যে পুরা কাহিনীটির প্রচলন আছে তারও একটা গভীর প্রভাব যেন প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত রয়েছে। এমনটাও মনে করা হয়।"

বন্ধুর এই যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার মতো বলে মনে হল না। অন্তত ওই অনুষ্ঠান দেখে আমারও সেরকমটাই মনে হয়েছে। 'ধাঁগড়ের' দল গান-বাজনার শেষে গৃহকর্তার আসন গ্রহণ করে। গৃহকর্ত্রী কৃতজ্ঞচিত্তে ওদের পিঠা খাওয়ায়। হাঁড়িয়া বা মদও খাওয়ায়। এছাড়া কিছু পয়সাও দেয়। তবে ধাঁগড়িয়ারা কোনরকম জোর করে না। স্বেচ্ছায় গৃহকর্ত্রী যা দেয় সেটাই তারা গ্রহণ করে। এতে তাদের কোন লোভ নেই। সে কথা তারা গানে গানে বলেও থাকে---

"নাহি যে আসি ভালা ভাতকেরি লভী রে নাই আসি পয়সাকেরি লভে
তরি যে ঘরে আছে দশ মূড় কাশি ফুল তাহাদিকে জাগ্যাতে আস্যেছি।"

এভাবেই বাড়িতে বাড়িতে গোয়াল ঘরে 'অহিরা' গানে ও বাজনায় গোরু জাগানো চলে। রাত্রি শেষে পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে এই অনুষ্ঠান। সারা রাত্রি ধরে গোরু জাগানোর কারণে তারা বিনিদ্র। চোখে বেশ ক্লান্তির ছাপ। বিস্রস্ত চুল। নেশার কারণে পা দুটো টলমল। এভাবেই ধুলো উড়িয়ে নাচ করতে করতে, আনন্দ করতে করতে তারা এগিয়ে চলে। সকালবেলা গান ও নাচ করতে করতে এই যে ছন্দহীন ভাবে এগিয়ে  চলা সেটাও একটা উৎসবেরই অঙ্গ। তারও একটা নাম আছে।"

অবাক হয়ে বললাম, "সারা রাত্রি ধরে গোরু জাগানোর পর ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসাটাও একটা অনুষ্ঠান নাকি!"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ। নাচতে নাচতে তাদের বিশেষ ভঙ্গিতে ছন্দহীন ভাবে চলে যাওয়ার নাম হল "মাছি খেদা।" একে 'মাছি বাট্যানাও' অনেকে বলে।"

আরো বেশি অবাক হয়ে বললাম, ""মাছি খেদা"! এমন অদ্ভুত নামকরণ কেন?"

বন্ধু বলল, "কারণ গোরু বাছুরকে মশা মাছির হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে। আগে ঝাড়খণ্ডে 'মশা' শব্দটি তেমন ব্যবহৃত হত না। 'মাছি' শব্দটাই বৃহত্তর অর্থে ব্যবহৃত হত। তাই 'মাছি খেদা' কথাটি মশা ও মাছি, দুটোকেই তাড়ানো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুটো প্রাণীই গোরু বাছুরকে কামড়ায় ও তাদের রক্ত পান করে।"

বললাম, "কিন্তু এভাবে কি নাচ-গান করে মশা বা মাছি তাড়ানো সম্ভব?"

বন্ধু বলল, এটা তো তোর আধুনিক কালের পরিণত মনের একটা যুক্তি। কিন্তু তখন  প্রাচীনকালে যুক্তির এত ধার ছিল না। প্রিয় পোষ্য গুলোর সুরক্ষায় তৎকালীন সময়ে তারা যেটুকুকেই শ্রেষ্ঠ পথ বলে মনে করেছিল সেটাই তারা পালন করেছে। সেই প্রাচীন ধারাই কেবল এখনো প্রচলিত হয়ে আসছে। তাই বলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সবের কিছুটা যে অদল বদল ঘটছে না তা নয়।"

আমি বললাম, "একটাই দল যারা গতরাতে 'অহিরা' গানে ও নাচে মেতে উঠেছিল পরে তাদের গানের ধারাটাও দেখলাম এই "মাছি খেদা" অনুষ্ঠানে আমূল পাল্টে গেল। কিছু কিছু কুরুচি শব্দ ও অশ্লীলতাও যেন প্রচ্ছন্নভাবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত। একটা গানে যেমন শুনলাম---

"কুলহি মুড়ায় কুলহি মুড়ায় নাচ লাগ্যেছে
সেই শুনে রে ভাই বড় বহু চুলহায় হাগ্যেছে।"

"আবার বেশ রঙ্গ রসিকতা করতে করতে বাড়ির বউরা কোন কোন ধাঁগড়িয়াকে পিটুলি গোলা জলও ছুঁড়ে মারছে। এমনটা কেন?"

বন্ধু বলল, "নববর্ষের আগে এমন 'অশ্লীল ক্রীড়া', 'কৌতুক', 'অশ্লীল গান', 'খেউড়' তো বৈদিক যুগ থেকেই চলে আসছে। এ আর নতুন কি! প্রাচীন পুরাণ শাস্ত্রে এর নানান বিধানও আছে। তবে এইসব প্রাচীন ধারাগুলো যে একেবারেই নিন্দনীয় এমনটা কিন্তু নয়। 'নিন্দা' ব্যাপারটা অনেকটাই আপেক্ষিক। বিতর্কিতও। পক্ষে বিপক্ষে কিছু যুক্তি প্রতিযুক্তি থাকবেই। আসলে 'মাছি খেদা' অনুষ্ঠানটি কেবল মাছি অর্থাৎ এই পতঙ্গটির বিতাড়নই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এই অনুষ্ঠানের গভীরতা বরং আরো গভীরে। গোরু বাছুরের ক্ষতিকারক যেকোনো অশুভ শক্তিকেই দূরীভূত করতে এই 'মাছি-খেদা' অনুষ্ঠানটি পালিত হয়। অশুভ শক্তিকে দূরীভূত করতে 'খিস্তি', 'খেউড়ের' চল কেবল প্রাচীনকালে কেন এখনো তো আছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সে সবের ব্যবহার হতে পারলে প্রাচীনকালে তো সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এ আর অসম্ভব কি!"

বললাম, "তা ঠিক। আচ্ছা প্রতিপদের এই দিনটিই তো 'গরয়া'র দিন। 'বাঁদনা' পরবের শ্রেষ্ঠ একটি দিন।"

বন্ধু বলল, "হ্যাঁ। প্রতিপদের দিন হল 'গরয়া'। এই দিন 'গরয়া' পূজা হয়।"

বললাম, "'গরয়া' পূজা  কী?"

বন্ধু বলল, "'গরয়া' হলেন একজন দেবতা। গোরু গোয়ালের দেবতা। তারই পূজা হয় এই দিন।"

বললাম,"এই দিনটিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার কারণ কী?"
বন্ধু বলল, "কারণ অনেক আছে, তার মধ্যে একটি হল এই 'গরয়া' পূজা। এই পূজায় বাড়ির গৃহকর্তার যেমন ভূমিকা থাকে, গৃহকর্ত্রীরও সমান ভূমিকা থাকে। গৃহকর্তা বা তার ছেলেকে সকাল থেকে উপোস থাকতে হয়। তিনিই পূজারী। অমাবস্যা তিথি শেষে প্রতিপদে হয় এই পূজা। পূজার দিন গৃহকর্তা নিকটবর্তী বাঁধ কিংবা পুকুর থেকে স্নান করে একটি মাটির গোলা পাকিয়ে হাতে কিংবা শালুক পাতায় করে বাড়ি ফিরেন। গোয়াল ঘরের প্রধান খুঁটিটির নীচে এই মাটির গোলাকে সযত্নে রাখা হয়। মাটির গোলার সঙ্গে কয়েকটি শালুক ফুলও সঙ্গে নিয়ে আসেন। কারণ পূজোর সময় এই শালুক ফুল দিয়েই পূজা হয়। ওদিকে গৃহকর্ত্রীরও নানা রকমের কাজ থাকে। সাত সকালেই উঠে পড়তে হয়। বাড়ির উঠোন, গোয়াল ঘর গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করে। ঐদিন পূজা সংক্রান্ত সবকিছুতেই নতুন জিনিসপত্রের ব্যবহার হয়। নতুন 'ঠেকা', 'কুলা' থেকে নতুন 'হাঁড়ি' 'খলা' সব কিছুই। আগে থেকেই এসব সংগ্ৰহ করে রাখতে হয়। পূজার দিন নতুন 'ঠেকা' ও 'কুলায়' আতপ চাল নিয়ে বাড়ির বউরা স্নানে যায়। স্নানের পর চালগুলো ভালোভাবে ধুয়ে ভেজা কাপড়ে ভেজা চাল নিয়ে বাড়ি ফিরে। সেই সঙ্গে কিছুটা কাঁচা মাটিও সঙ্গে নিয়ে আসে। ওই কাঁচা মাটি দিয়েই একটি নতুন উনান বানানো হয়। ভেজানো আতপ চালগুলো ঢেঁকিতে কুটে চালের গুঁড়ি তৈরি করা হয়। সেই গুঁড়ির পিঠা গাওয়া ঘি দিয়ে নতুন উনানে ভাজতে হয়। ঘিয়ে ভাজা এই পিঠাই হল 'গরয়া' দেবতার পূজার ভোগ।"

গোয়াল দেবতার পূজার ভোগ ঘিয়ে ভাজা পিঠা! এ দারুন ব্যাপার তো। কোন গুড়, চিড়া না হয়ে ঘিয়ে ভাজা পিঠাও যে ভোগ হতে পারে এমনটা তো আমার জানা ছিল না।

বন্ধু বলল, "এটাই সত্যি। পূজার উপকরণ বা নৈবেদ্যগুলোও প্রচলিত পূজার মতো নয়। 'শালুক ফুল', 'চালের গুঁড়ি', 'পিঠা' এসবই হলো এই পূজার মূল উপকরণ। বাঁধ থেকে নিয়ে আসা মাটির গোলাটা গোয়াল ঘরে গোরু বাঁধা মূল খুঁটির সামনে রাখা হয়। তার উপর গুঁজে দেওয়া হয় একটি শালুক ফুল।"

বললাম, "শালুক ফুল এভাবে গুঁজে দেওয়া হয় কেন?"

বন্ধু বলল, "একে যৌন মিলনের প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়। কারণ গো প্রজনন এই পূজার মূল উদ্দেশ্য।(ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য:পৃষ্ঠা ১৩১)

বললাম, "কীভাবে পূজা হয়?"

বন্ধু বলল, "'গরয়া' খুঁটার সামনে আতপ চালের গুড়ি দিয়ে তিন সারির 'নয়'টি(৯) চৌকা ঘর বানাতে হয়।"

জিজ্ঞেস করলাম, "নয়টা ঘর কেন?"

বন্ধু বলল, "কারণ ওই নয়টা ঘরে 'নয়' জন 'দেবতা'-কে পূজা করা হয়। প্রতি ঘরে একজন করে দেবতা অবস্থান করেন। এই নয়টি ঘরে দেবতাদের অবস্থান কোনভাবেই ওলট-পালট করা যায় না।"

জিজ্ঞেস করলাম, "কোন কোন এই নয় জন দেবতা?"

বন্ধু বলল, "উপরের তিনটি ঘরে বাম দিক থেকে প্রথমে থাকেন 'গরয়া' দেবতা, তারপর 'গুঁসাই' দেবতা ও শেষে 'কালাপাহাড়' দেবতা অবস্থান করেন। মাঝের সারির প্রথমে 'বড় পাহাড়' (মারাং বুরু, মতান্তরে মাহাদেব), পাশের ঘরে 'ছাঁদন দড়ি' ও 'বাঁধন দড়ি' অবস্থান করেন। শেষের সারি তথা নিচের সারিতে প্রথমে 'বাঘুত' দেবতা তার পাশে দেবতা 'গরাম' ও শেষে অবশিষ্ট দেব-দেবী অবস্থান করেন। এই নয়টি ঘরে প্রথমে একটি করে তুলসীপাতা বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার উপর আতপ চাল আর 'গরয়া' পিঠা ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়।"

বললাম, এই পূজার কোন মন্ত্র আছে?"

বন্ধু বলল, "না। কেবল মনে মনে দেবতাদের কাছে গোরু বাছুরের স্রেফ মঙ্গল চাওয়া হয়।" 

বললাম, "এই 'গরয়া' দেবতা 'পুরুষ' দেবতা নাকি 'স্ত্রী' দেবতা?"

বন্ধু বলল, "'গরয়া' হলেন, 'স্ত্রী' দেবতা। কারণ এই পূজায় 'পাঁঠা' বলি দেওয়া নিষিদ্ধ। সে কারণে 'পাঁঠি' বা 'ছাগী'(অক্ষত যোনী) বলি দেওয়া হয়।"

যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এই প্রথম শুনলাম কোন পূজায় 'পাঁঠি' বা 'ছাগী'ও (অক্ষত যোনী) বলি দেওয়া হয়!

বন্ধু বলল, "যারা 'ছাগী' বলি দিতে পারে না তারা 'কাটুল' বা কুমারী 'মুরগি' বলি দেয়। উদ্দেশ্য 'গরয়া' দেবতা সহ অবশিষ্ট দেবতাগণকে সন্তুষ্ট করা। সারা বছর ধরে যেন গোরু বাছুর গুলোকে সুস্থ রাখেন।"

"আমি একবার শুনেছিলাম, বাঁধ থেকে আনা মাটির যে 'গোলাটি' খুটির নিচে রেখে শালুক ফুল গুঁজে পূজা করা হয়, তাকে "গিরি গোবর্ধন" পর্বত রূপে পূজা করা হয়। এটা কতটা সত্য?"

বন্ধু বলল, "এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। 'গিরি গোবর্ধন' পূজাকে 'গো-পূজা'(বাঁদনা)-র সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুটো পৃথক পূজা। তার আগে 'গিরি গোবর্ধনের' এই কাহিনীটি একটু জানা দরকার না হলে বিভ্রান্তি হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। একবার কৃষ্ণ বৃন্দাবনবাসীকে ইন্দ্রের পূজা করতে নিষেধ করেন। এতে ইন্দ্র বৃন্দাবন বাসীর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। ক্রুদ্ধ হয়ে বৃন্দাবন বাসীর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করেন। তখন কৃষ্ণ 'গিরি গোবর্ধন' পর্বতকে ছাতার মতো এক আঙুলে তুলে ধরে সমস্ত বৃন্দাবনবাসীকে তার তলায় আশ্রয় দেন। বৃন্দাবনবাসীদের সঙ্গে গোরু ও গাভীদেরও আশ্রয় দেন। তাই কৃষ্ণ বৃন্দাবন বাসীকে আদেশ দেন কার্তিকী 'শুক্ল প্রতিপদে' 'গিরি গোবর্ধন' পর্বতের পূজা করতে। সেইসঙ্গে গোরু ও গাভীদেরও পূজা করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে কার্তিকী 'শুক্ল প্রতিপদে' 'গিরি গোবর্ধনের' পূজা হয়ে আসছে। যেটা "অন্নকূট" উৎসব নামেও পরিচিত। এর সঙ্গে 'বাঁদনা'র কোন সম্পর্ক নেই। দুটোর মধ্যে কেবল "গো-পূজার" মিল আছে এটুকুই। তবে দুটোরই পূজা পদ্ধতি ভিন্ন। সুতরাং উৎসব দুটোও একেবারেই পৃথক।"

বললাম, তবে যে 'বাঁদনা'র অনেক লেখাতেই 'গোয়াল'(গোহাল) পূজোর সময় মাটির 'গোলা'-টি 'গিরি গোবর্ধনে'র প্রতীক বলে উল্লেখ করেছেন!"

বন্ধু বলল, "ওইসব লেখা আমিও পড়েছি। বিশিষ্ট লেখক বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থে এই পৌরাণিক কাহিনীর কোনরকম উল্লেখ নেই। তাই আমারও মনে হয় গিরি গোবর্ধনের কাহিনীকে বাঁদনার সঙ্গে যেন জোর করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।"

বললাম, পুজোর শেষে কৃষি কাজে ব্যবহৃত সমস্ত 'হাল', 'মই', 'জোঁয়াল' গুলোকেও দেখলাম সিঁদুর দিয়ে পূজা করা হয়েছে। সেই 'হাল', 'জোঁয়ালে' বেঁধে দেওয়া হয়েছে শালুক ফুলের ডাঁটা।

বন্ধু বলল, এই 'হাল', 'জোঁয়াল', 'মই'গুলোকে পূজা করার উদ্দেশ্য হল, কৃষি কাজে ব্যবহৃত এই সমস্ত উপকরণগুলো ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে তুলে রাখা হয়। তারপর নতুন বছর পড়লে অর্থাৎ মাঘ মাসের দ্বিতীয় দিনে "হাল পূণ্যা"-র অনুষ্ঠানে সেগুলোকে আবার চাষের কাজে নামানো।"

চলবে...

তথ্যসূত্র: ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments