আমি আমার মতো
পর্ব ২
সুকন্যা সাহা
ঝর্না কলম
কলম বলতেই ছোটোবেলার কালির ফাউণ্টেন পেনের কথা মনে পড়ে ... আমরা বলতাম ঝর্না কলম... আর ছিল চাইনিজ পেন ... ড্রপারে করে কালি ভরতে হত ...নীল কালি... অন্য কোনো কালিতে লেখা অ্যালাউড ছিল না ... তখন সবে ক্লাস ফাইভে পেন হাতে পেয়েছি... মহা মূল্যবান জিনিস ... সেরা গিফট কালির পেন ... পেলেই একরাশ আনন্দ ... তখন কত অল্পে খুশি ছিলাম ... অবাক লাগে ... স্কুলের খাতায় ডট পেনে লেখা চলবে না ... হাতের লেখা খারাপ হয়ে যাবে যে !
একবার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ঝর্ণা কলম নাম কেন রে ? সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দিয়েছিল ঝর ঝর করে লেখা বেরোয় তো এক্কেবারে ঝর্নার মত ; তাই ঝর্না ।প্রথম প্রথম লাইন টানা বাংলা খাতায় লেখা ...তার পর সাদা খাতা ... প্রথম দিকের আঁকা বাঁকা লাইন পরে সোজা হতে শুরু করে ... কালির পেনের আরেকটা অসুবিধে ছিল... খানিকক্ষণ খোলা রেখে দিলেই ব্যস নিবের কালি শুকিয়ে যেত তখন আবার পেনটাকে ঝাড়তে হত... ঘরে বিন্দু বিন্দু কালি পড়ত ... ঘর নোংরা ... বরাদ্দ মায়ের বকুনি...
আমার হাতের লেখা বরাবরই ভালো । কালির পেন দিয়ে তাও প্রথম প্রথম খুব ধরে ধরে লিখতাম । লাইন সোজা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা । লেখার কথা এলেই মনে পড়ে আমার দাদুমণির কথা । সাধারণ নীল কালির ডটপেন ;তাও সাদা পাতায় ছোট্ট ছোট্ট অক্ষর । যেন পাতা জুড়ে ফুলের মতো ফুটে রয়েছে। সে দেখার মত হাতের লেখা ! কি বাংলা কি ইংরেজি ! পারতাম না তবুও অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম খুব ছোট থেকেই । ছোটোবেলায় মানে ক্লাস ফোর পর্যন্ত, নিয়মিত পড়তাম দাদুমণির কাছে । পাতার পর পাতা ইংরেজী ট্রান্সলেশান পি. কে .দে সরকারের গ্রামার বই থেকে, আর অঙ্ক করার ক্লাস। মনে আছে একপাতা অঙ্ক নির্ভুল ভাবে করতে পারলে পাঁচ পয়সা রোজগার ছিল । পয়সা পেলে কি যে আনন্দ হত ! মনে হত নিজের উপার্জন ... পয়সা গুলো জমিয়ে রাখতাম মাটির লক্ষীর ভাঁড়ে । আশ্চর্য্য হয়ে দেখতাম দাদুমনি ক্লাস ফোরের বাচ্চাকে পড়াতেন আবার একই সঙ্গে এম এ ক্লাসের ইকনমিক্স বা পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়াতেন। এবং দুটোতেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন । আসলে পড়াশোনার বেস যাদের ভালো, গভীরতা যাদের যত বেশী বিভিন্ন বিষয়ে তাদের তত দক্ষতা ... তবে আশ্চর্য্যের কথা পেশাগত ভাবে কিন্তু দাদুমনি শিক্ষক ছিলেন না , ছিলেন বিসিএস অফিসার । কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি পড়াশোনার এই গভীরতা আজকের দিনের অনেক ভালো ভালো শিক্ষকদেরও নেই । ক্লাস ফোরেই আমাকে একবার মাত্র দুপাতার মধ্যে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ লিখে দিয়েছিলেন ... দাদুমনির নিজের হাতের লেখা সেই কাগজ দুটি আজও আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে ...
অনেকের কাছে শুনেছি কালি কলম মন / লেখে তিনজন ... তা এখন আর সে কালি বা কলম কোথায় ? তার জায়গা নিয়েছে ল্যাপটপ মাউস, কি বোর্ড... ভাবনা গুলো কলমের ডগায় আসে না ... কী বোর্ডে আসে ... আগে অনেক অফিস যাত্রী মানুষ জামার বুক পকেটে কলম রাখতেন ... এখন এসে গেছে বল পয়েন্ট পেন, মার্কার পেন, হাইলাইটার , জেল পেন ... এই জেল পেন এসে ফাউণ্টেন পেনের বাজার অনেক খারাপ করে দিয়েছে । জেল পেন বহিরঙ্গে ডট পেন অন্তরঙ্গে ফাঊণ্টেন পেন । তবে কালি ভরা ,কালি ঝাড়ার সমস্যা নেই। বাজারে এসেছে ইউজ অ্যান্ড থ্রো ডট পেন... মজার ব্যাপার,পেনে রিফিল ভরার ক্রেজ এখন অনেক কমে গেছে । পেনের কালি ফুরোলেই লোকে নতুন পেন কিনে নেয় ... তাছাড়া গো গ্রীন মুভমেন্টে তো কাগজ আর কলমের পাট টাই প্রায় উঠতেই বসেছে ...
ডট পেনের রমরমা শুরু হওয়ার পর সেসব আর দেখিনা ... যাই হোক সব জিনিসের মতো পেনও এখন ইউস অ্যান্ড থ্রো... কম্পিউটার এসে যে কত জিনিসের ব্যবসা কেড়ে নিল! ঘড়ি , পেন সবই ধীরে ধীরে অচল হয়ে যাচ্ছে ... আগে যেমন ঝর্ণা কলমের পেডিগ্রি ছিল; এখন তো বাজারে হরেক কিসিমের হরেক দামের কলম... পার্কার , বেটা, কিছুরই অভাব নেই...আর সব কিছু এত সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় গুরুত্ব কমে গেছে সব কিছুরই।
প্রাচুর্য্য বোধহয় কেড়ে নেয় সারল্য... কলমের কথা মনে পড়লেই যেন ফিরে যাওয়া যায় ছোটোবেলার সেই নীল সাদা সময়ে এত রঙ্গের কালির পেন যখনও আমাদের বর্তমানকে গ্রাস করে নি...এখনকার ছোটোরা ছোটো থেকেই অভ্যস্ত ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের মাউস, কি বোর্ড ঘাঁটাঘাটিতে... আরো সহজ স্মার্ট ফোনে লেখালিখি... লিখেই পোস্ট করে দেওয়া নিজের ওয়ালে ...বেশ কিছু লাইক, কমেণ্ট তো ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়বেই...সবকিছু এত সরলীকৃত হওয়া আর সহজেই হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে যাওয়ার জন্যই বোধহয় এই জেনারেশান এত অধৈর্য ... অপেক্ষার যে মাধুর্য্য, অর্জনের যে আনন্দ, সেটাই ভুলে গেছে এরা...
(ক্রমশঃ)
0 Comments