জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৪৭/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৪৭

আজকের বেড়ানোতে মিসেস দত্তর সঙ্গে আলাপ হওয়াটা, একটা বাড়তি পাওনা। ভদ্রমহিলাকে বেশ ভালই লাগল। পোশাক আসাকে, আদব কায়দায় বাঙ্গালিয়ানাকে ধরে রেখেছেন। ১৯৮৫ সাল থেকে এদেশে আছেন। মাঝে একবার দেশে ফিরেছিলেন, কিন্তু থাকতে পারেননি। আবার এখানেই ফিরে এসেছেন। আর দেশে ফেরার ইচ্ছে নেই।  মাসিমার কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছে। সেইসঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি। সে ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের তো ফিরতে হবে। নাড়ির টানে, ভালবাসার টানে। আমাদের দেশ খুব গরিব, এখানকার মত এত সুযোগ সুবিধা নেই। তবুও মা তো মা-ই।
      আজ দীপ প্রথম নিজের গাড়ি চালিয়ে কুইন্স হাসপাতাল গেছে। এদিকে দেখতে দেখতে জারা সোনার তিনমাস বয়স হয়ে গেল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমাদের ফেরার ডেট হয়েছে। আজ দীপ গাড়ি নিয়ে লেসটার গেছে কোর্স করতে। পথ চিনে যেতে হবে। প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। সবই তো অভ্যাসের ব্যপার। ওখান থেকে ফিরে আমাদের নিয়ে সায়েন্সবেরি নিয়ে গেল। মস্তবড় সপিংমল, ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালই লাগল। আমার কেনার কিছু ছিলনা। দীপ কারসিটসহ জারাকে ট্রলিতে বসিয়ে ঘুরল, ও কান্নাকাটি করেনি, চুপচাপ ছিল।
      বেশ গরম লাগছে। ১৫ ডিগ্রী টেম্পারেচার আজ। রোদের ও খুব তেজ। আজ জারার ওজন নেওয়ার দিন। আগে ১৫ দিন অন্তর মিডওয়াইফ বাড়িতে এসে ওজন নিয়ে যেতেন। এখানে ওজন যদি ঠিকমত না বাড়ে, ওরা বাচ্চাকে নিয়ে চলে যাবে। দুপুরবেলা বাবলি একাই ওকে জিপির কাছে নিয়ে গিয়ে ওজন করিয়ে নিয়ে এসেছে। ১৫ দিনে ৩৫০ গ্রামের মত ওজন বেড়েছে। বিকেলে ভ্যাক্সিনের জন্য আবার যেতে হল। পরপর দুই পায়ে ইঞ্জেক্সন দিল। একটাতে রক্ত বের হয়ে গেল। প্রচুর কাঁদছিল। এবার বাবলি ওকে আগেই প্যারাসিটেমল খাইয়েদিয়েছিল, তাই বেশি কান্নাকাটি করেনি।
      দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছি। মাঝখানে আর কয়েকটা দিন রয়েছে, তারপর দেশে ফেরা। মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছি এই বলে, ২ মাস পরে তো ওরাও যাবে। মামাঘরে মুখেভাত হবে। গিয়ে সে বিষয়েও বকুলের সঙ্গে ওর মামাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তার আগে ভাবছি এই ক’মাসে ঘরদোরের  কী হাল হয়েছে?  ফোনে যাকে যা বলার বলে দিয়েছি। ওরা নিশ্চয় সব ব্যবস্থা করে রাখবে।
      এই সিটি হাসপাতালের কোয়ার্টার ও সংলগ্ন এলাকায় বাবলি আর বনিরা ছাড়া আর কোনো বাঙালি পরিবার আছে বলে মনে হয় না। তাই দুটি ফ্যামিলি পরস্পরকে জড়িয়ে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। শুনলাম জার্মানি থেকে বনির মাসি মেসো এসেছেন সানকে দেখাশোনা করার জন্য। বনি দেশে ফিরে যাবে গান  ভালবেসে। সানকে এখানে স্কুলে ভর্তি করা হবে। আমি গেলাম ওনাদের সঙ্গে দেখা করতে। বয়স হলেও মাসি কাজকর্মে বেশ চটপটে। আসলে এদেশে নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হয় বলেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই বাড়ির কাজে আভ্যস্থ।  কিন্তু বনির মেসোর অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম, এই মানুষটি কী করে  এলেন? কী করেই বা ওনার স্ত্রী ওনাকে নিয়ে এলেন! মাসির ছোটখাটো চেহারা,  মেসোর দশাসই চেহারা, কিন্তু তিনি একেবারে চলৎ-শক্তিহীন। যন্ত্রনির্ভর। এটাই এদের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য। কোনো অসুবিধাকে এখানকার মানুষ বাধা বলে মনে করেন না। সবকিছুকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেন।
    এই বিদেশে বিভূঁইয়ে ভাল বন্ধু পাওয়া খুব মুশকিল। দীপ পেয়েছে জাভেদকে। যে কোনও প্রয়োজনে হাজির থাকে। বিশেষ করে গাড়ি সংক্রান্ত বিষয়ে তো সব সময় সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। কথা প্রসঙ্গে একদিন দীপ ওর এক বন্ধুর কথা শুনিয়ে ছিল। ও তখন এম বি বি এস পাশ করে সবে ইংল্যান্ড এসেছে ডিগ্রি ও চাকরির জন্য। বিভিন্ন জায়গাতে কোর্স করতে যেতে হত। থাকত নরউইচে। কোর্স করতে আসতে হবে লেসটারে। কোথায় থাকবে? (তার আগে এটা নাকি  তিনদিনের কোর্স ছিল। কিন্তু এই রকম বেকার ডাক্তাররা বেশি সংখ্যক আসতে  শুরু করাতে, একদিনের কোর্স করা হয়েছে)। ওর এক সিনিয়র দাদা বলে, চিন্তা করিস না, ওখানে আমার এক বন্ধু আছে, ওকে বলে দেব। সেই বন্ধুটি হল একজন পাকিস্তানি ডাক্তার। ওখানকার হাসপাতালের ব্যাচেলার একমোডসনে থাকত।  ছেলেটি গাড়ি নিয়ে ওকে স্টেশনে নিতে এসেছিল। রাতে মাংসভাত রান্না করে  খাইয়ে ছিল, সকালে ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছে দিয়েছিল। ট্রেনিং শেষে আবার স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল। আগের রাতে আরও একটি ইন্ডিয়ান ছেলেরও ডিনারে আমন্ত্রণ ছিল। রান্না করতে করতে পাকিস্তানি ডাক্তারটি মজা করে বলেছিল, আমার  গ্র্যান্ডফাদার আর্মিতে ছিলেন, যুদ্ধের সময় কত ইন্ডিয়ান সোলজারদের হত্যা  করেছিলেন। আমি তার নাতি হয়ে  ইণ্ডিয়ানদের রান্না করে খাওয়াচ্ছি। সেদিন ও সারাটা পথ ভেবেছে, আমরা ছোট থেকে জেনেছি,  পাকিস্তানকে যে যত বেশি  ঘৃণা করতে পারবে, সে তত বড় দেশ প্রেমিক। ভুল জেনেছিলাম। সাধারণ মানুষের মানসিকতা আর নেতা মন্ত্রীদের চিন্তাধারার মধ্যে অনেক পার্থক্য। নির্মম সত্য হল গরিব ঘরের ছেলেরা অধিকাংশই অভাবের তাড়নায় আর্মি বা অন্যান্য যুদ্ধ বাহিনীতে যোগ দেয়। যারা মরে এবং যারা মারে তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো শত্রুতা থাকেনা। এই জন্যই বলা হয় রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় / উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। 
      মাঝে আর ১ দিন রয়েছে। তারপরেই দেশে ফেরা। বাবলিটার খুব কষ্ট হবে, একা বাচ্চা সামলানো, রান্না করা, বাড়ির অন্যান্য সমস্ত কাজ একাকে করতে হবে। আজ সন্ধ্যায় রান্না করিনি, দীপ ম্যাকডোল্যান্ড থেকে খাবার এনেছিল, সেটাই খাওয়া হল। গত কয়েক মাসে কত কি দেখলাম, কতকি শিখলাম, এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। যখন এসেছিলাম অধিকাংশ গাছে পাতা ছিলনা। কিন্তু রাস্তার রিংরোডের মাঝখানে ফুটেছিল হলুদ,সাদা ড্রফোডিল ও নানা রঙের টিউলিপ। এদেশের মানুষ নিজের দেশের প্রতি খুবই যত্নশীল। তাই নিজের নিজের কাজ ও দায়িত্বের বিষয়েও খুবই সচেতন। নিজের শহর পরিস্কার রাখার পাশাপাশি তাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার জন্য একরকম ফুল ফোটা শেষ হলেই আর একরকম ফুলের চারা রোপণ করে দেয়। যেমন এখন দেখছি  নানা রঙ্গের জিনিয়া ফুটে রয়েছে। এদেশের মানুষের সৌজন্যতা বোধ, শিষ্টাচার  মুগ্ধ করার মত। আমাদের দেশে অনেক মানুষই সবার সঙ্গে কথা বলতে চান না,বা বলেন না। যাঁদের সমাজে বিশেষ পরিচিতি আছে, অঢেল টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ির মালিক। তাঁরা সাধারন মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করেন না। ক্ষেত্র বিশেষে নিজের গরিব বা অনামি আত্মীয়দের না চেনার ভান করেন। এদের মধ্যে এক ধরণের ইগো কাজ করে। এই ইগোতে বেশি আক্রান্ত নায়ক,গায়ক, কবি সাহিত্যিকরা।অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। এদেশে এমনটা ভাবাই যায় না। এঁরা পথেঘাটে আমাদের মত ভিনদেশি অচেনা মানুষদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে হাই,হ্যালো বলেন। না হলেও হাসি বিনিময় করে থাকেন।
    আর একটা বিষয় হল, এদেশে যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন আছে, তেমন মানুষ সবসময় সেই আইন মেনে চলার চেষ্টা করে। তাই মানুষজন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। পথচারিদের নিরাপত্তার দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়। আমাদের দেশে দেখেছি যারা গাড়িতে চলাফেরা করেন তাঁদের অনেকেই পথচারিদের পথের জঞ্জাল ভাবেন। দুর্ঘটনা ঘটলে সব দোষ পথচারির ওপর চাপিয়ে দিয়ে গালাগালি পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। ট্রাফিক আইনেরও তোয়াক্কা করেন না। আর এখানে রাস্তার ধারে লাইট পোস্টের মত পোষ্টের মাথায় ক্যামেরা বসানো আছে। প্রতিটি গাড়ির গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। লাল আলো উপেক্ষা করে বা অজান্তে এগিয়ে গেলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। গাড়ির স্পিড মাপারও সিস্টেম রয়েছে। যথেচ্ছাচারের কোনো সুযোগ নেই। এদেশে আরও একটা অবাক করা জিনিস হল, যে থেকে আসেছি, অল্প সময়ের জন্য হলেও পাওয়ার অফ হয়নি।  (ক্রমশ)

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments