জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৪৭
খাঁদারাণী, তালবেড়িয়া, মুকুটমণিপুর ড্যামের নির্জনতা ও 'পোড়া' পাহাড়ের গা ছমছমে গুহা
সূর্যকান্ত মাহাতো
সব সময় আমরা ছুটে চলেছি। এই ছুটে চলা আর ব্যস্তময় জীবনের আড়ালে আমরা কিছুটা হলেও কোথাও যেন একটু নির্জনতা প্রিয়। নির্জনতা প্রিয় না বলে 'নির্জনতা লোভী' বলাই বোধ হয় ভালো। এটা আমাদের আদিম সত্তারই একটা স্বরূপ মনে হয়। এই যে নির্জনতার লোভ, তার মাঝেই তো আমরা বারবার নিজেকে খুঁজে পাই। নিজের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলা যায়। মুহূর্তগুলোর সঙ্গে একাত্ম হতে পারি। নিজেকে এইভাবে আবিষ্কার করার আনন্দটাও তো বড় কম কিছু নয়। এই নির্জনতার মাঝে এলে একটা প্রগাঢ় প্রশান্তি যেন ঘিরে থাকে আমাদের মনে সর্বক্ষণ। জঙ্গলমহলে এরকমই যে কয়েকটা নির্জন জায়গা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল বেলপাহাড়ীর "খাঁদারাণী" জলাধার, ঝিলিমিলির "তালবেড়িয়া ড্যাম", এবং খাতড়ার "মুকুটমণিপুর ড্যাম"।
পাহাড়, জল ও জঙ্গলের ত্রিবেণী সঙ্গমে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ছড়ানো আছে সেখানে। এই নির্জন প্রকৃতি বারবার ডাক দেয় কিছুটা সময় নিজের সঙ্গে গল্প করার জন্য। বেলপাহাড়ীর "খাঁদারাণী" ও ঝিলিমিলির "তালবেড়িয়া" ড্যাম দুটোতে পাহাড়, জল ও জঙ্গল আঁচল মেলে সর্বক্ষণ অদ্ভুত এক নির্জনতা বজায় রেখেছে। ড্যাম দুটোর মধ্যে দারুণ মিল। গঠন ও আকৃতিগত ভাবে। পাহাড় ঘেরা সবুজ শাল গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশটাও সেখানে মুখ বাড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ। যেন উঁকি মেরে লেকের জলে নিজের মুখখানি দেখছে। দেখে মনে হবে আকাশটাও যেন নির্জনতার অনুসন্ধানী। লেকের জল আকাশের সেই নীল রঙ গায়ে মেখে নিজেও সুনীল হয়ে উঠেছে। ওই দূর থেকে শালের গন্ধ মাখা বাতাস এসে খেলা করছে লেকের ভরা জলে। স্থির শান্ত জলও সেই বাতাসের মৃদুমন্দ ধাক্কায় বারবার নেচে নেচে উঠছে। ছোট ছোট নৃত্য রত ঢেউগুলো পাড়ে এসে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে করে খেলে বেড়াচ্ছে আপন খেয়ালে। নির্জন তীরে বসে আপনি সেই শব্দে কান পাতবেন। আর একটা মিষ্টি সুর শুনতে পাবেন। ইচ্ছে হলেই পায়ের পাতা ডুবিয়ে লজ্জা মাখা সেই জলের স্পর্শও নিতে পারেন। একটা প্রফুল্লতা আপনার মন ও শরীরে তখন জেগে উঠবে। জলের দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকতে বড় ইচ্ছা করবে। কয়েকটা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তখন আপনার চোখের সামনে ভেসে বেড়াবে। ছোট ছোট কয়েকটা মাছ ধাঁ করে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াবে। তাদের ওই খুশি আপনার মধ্যেও ছুঁয়ে যাবে। ছুঁযে যাওয়া খুশির সেই আনন্দে আপনিও তখন হাত ডুবিয়ে একটু জল ছিটিয়ে দেবেন ওদের দিকে। কিছুটা দূরে কয়েকটা জল হাঁসকে কি এক অজানা আনন্দে বারবার ডুব দিয়ে খেলা করতে দেখবেন। ওদের ডুব দিয়ে খেলা করতে দেখে আপনার মধ্যেও একটা চোরা খুশি জেগে উঠবে। ব্যস্ত জীবনের স্ট্রেস তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও পালিয়ে যাবে। বরং একটা কাব্যিক মন আপনার হৃদয়ে জেগে উঠবে। কয়েকটা গানের লাইন নিজের অজান্তেই হয় তো গুনগুণীয়ে উঠবেন। নয় তো একটা কবিতা বোনার ব্যর্থ চেষ্টাও করবেন। ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে যাবেন কে আমি? কোথায় আমার ঘর? অফিস। কাজের চাপ। সংসারের ঝামেলা সবকিছুই। এই নির্জন প্রকৃতির কোলে দু-দন্ড শান্তিই তখন অপনি কেবল উপভোগ করবেন।
জলাধার দুটোর প্রাকৃতিক গঠনও বেশ মনোরম। ড্যামের চারপাশে ছোট বড় কয়েকটা পাহাড় ও টিলা। সবুজ গাছ গাছালিতে ভরা। বেশিরভাগই বড় বড় শাল গাছ। বৃষ্টির জল সেই পাহাড় ও টিলা দিয়ে গড়িয়ে এসে জলাধারে জমা হয়। যে পাশ দিয়ে জল নিম্নমুখী হয়ে বয়ে যায় সেই পাশেই একটি পাড় তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টির সেই জল নিম্নমুখী হয়ে পাড়ে এসে থেমে যায়। সংরক্ষিত এই জমা জলের সৌন্দর্যই আলাদা রকমের। সেখানে কেবল আকাশের ছায়ায় পড়ে না। উচু উঁচু শাল গাছের ছায়াগুলোও জলের সঙ্গে তিরতির করে কাঁপতে থাকে।
"কংসাবতী" ও "কুমারী" এ দুটি নদীর সঙ্গম স্থল হল মুকুটমনিপুর। সেখানে একটি বিশাল বড় জলাধার গড়ে তোলা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও হুগলির কিছুটা বিস্তীর্ণ পতিত জমিকে চাষযোগ্য করে তোলা। ডঃ বিধান চন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। চাষের জল সংরক্ষণের জন্য এই বাঁধ নির্মিত হলেও এটাই এখন বাঁকুড়া জেলার সব থেকে বড় মূল পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ডেমের সুদৃশ্য কংক্রিট বাঁধানো তীরে বসে আপনিও হারিয়ে যাবেন নীল জলের সঙ্গে। ওই দূরে জলের বুকে ভেসে যাওয়া কয়েকটা নৌকা দেখে, ছেলেবেলায় আঁকা নৌকা ও নদীর ছবি ভেসে উঠবে আপনার মানসপটে। খোলা বাতাস এসে বারবার মুখে ঝাপটা মেরে মাঝে মাঝে সেই চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাবে। তবুও যেন ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়ে কখন যেন একলা হয়ে পড়বেন এই ড্যামের দিকে চোখ মেলে তাকালেই। দূরের দিকে তাকালেই মনে হবে আকাশটা যেন জলাশয়ের বুকে নেমে এসেছে।
জঙ্গলমহলের এই ছোট বড় ড্যামগুলোর সৌন্দর্য যতটা না চোখে ধরা পড়বে তার থেকে বেশি ধরা পড়বে মনে। যতটা না চোখ জুড়াবে, তার থেকেও বেশি মন জুড়িয়ে যাবে। একটা অদ্ভুত প্রশান্তি সর্বদাই আপনাকে ঘিরে থাকবে।
মুকুটমণিপুর ড্যামের তীরে বসে থাকতে থাকতে হয় তো হঠাৎ আপনার মনে হবে একটু রোমাঞ্চ না থাকলে কেমন যেন ঠিকঠাক হচ্ছে না! সে রোমাঞ্চ পেতে মনটা তখন বেশ উড়ু উড়ু করবে। কিন্তু কীভাবে? কিছুটা দূরেই আছে একটা পাহাড়ের গুহা। সেই পাহাড়ের নিকষ অন্ধকার গুহা দেখে আপনার রোমকূপ খাড়া হয়ে যাবেই যাবে।
মুকুটমণিপুর থেকে তিন চার কিলোমিটার দূরে আছে সেই পাহাড়ী গুহা। পাহাড়ের নাম "পোড়া পাহাড়"। মূল চূড়ার বেশ কিছুটা নিচেই আছে সেই পার্বত্য গুহা। ভয়ানক অন্ধকার, গা ছমছমে এই গুহায় কতগুলো পাশাপাশি কুঠুরিও আছে। আশ্রয় লাভ, বাসস্থান নাকি আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে এই গুহা তৈরি করা হয়েছিল তা আজ আর স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করে বলা যায়, এটা আত্মগোপনের শ্রেষ্ঠ একটি জায়গা। স্থানীয় লোকেরা বলে, কত পুরানো গুহা সেটা তারা বলতে পারবে না। তবে বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকেই দেখে আসছে। বেশ উঁচু গুহা। প্রায় পাঁচ ফুটের মতো উঁচু। খুব বেশি মাথা ঝোঁকাতে হয় না প্রবেশের সময়। একরকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই প্রবেশ করা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে কেটে কেটে এই গুহা বানানো হয়েছে। এটা প্রাকৃতিক গুহা নয়। তবে দীর্ঘ সময় ধরে যেভাবে কেটে কেটে বানানো হয়েছে তা যে কতখানি কঠিন একটা কাজ সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত এই গুহাটি। গুহার মূল প্রবেশ পথ পশ্চিম দিক ছাড়াও আরো একটি প্রবেশপথ আছে। সেটি একটি জল যাওয়ার নালার মুখ বলা যেতে পারে। ঘুটঘুটে অন্ধকার গুহার ভিতরে প্রবেশ মাত্রই আপনার সব ইন্দ্রিয়গুলো ঝপ করে সজাগ হয়ে উঠবে। হাঁটার সময় একটা অজানা ভৌতিক ভয় আর রোমান্সে আপনার সারা শরীর বারবার শিহরিত হয়ে উঠবে। চোখ বন্ধ করলে যে অন্ধকার ঠিক সেই অন্ধকার। গুমোট একটা পরিবেশ। সব সময় গা ছমছম করবে।
গুহা থেকে বেরোনোর সময় প্রথম যখন গুহা মুখের আলোর রেখা টুকু দেখতে পাবেন। আপনার মুখটাও তখন আনন্দে আলোকিত হয়ে উঠবে। সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসার পর মনে হবে আহারে পৃথিবীটা কত রঙিন! চারিদিকে কত সবুজ। ওই তো পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়া। ঘন সবুজের মাঝে চূড়াখানি বেশ রুপোলি আলোয় ঝলমল করছে। বড় বড় সাদা খড়ি রংয়ের পাথরে মোড়া সর্বোচ্চ শৃঙ্গটা। গুহা জয়ের পর মনের মধ্যে জেগে উঠবে শৃঙ্গ জয়ের উদগ্র বাসনা। সেই তাগিদেই কখন যেন একসময় আস্ত পাহাড়টির একেবারে চূড়ায় পৌঁছে যাবেন বুঝতেও পারবেন না।
তাই একটু নির্জনতা আর ভৌতিক অনুভূতি পেতে জঙ্গলমহলের এই জায়গাগুলো ঘুরে আসা যেতেই পারে।
0 Comments