জ্বলদর্চি

ড. সুকুমার মাইতি (গবেষক, শিক্ষক, প্রত্ন সংগ্রাহক, খড়গপুর)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ২৯

ড. সুকুমার মাইতি (গবেষক, শিক্ষক, প্রত্ন সংগ্রাহক, খড়গপুর)

ভাস্করব্রত পতি

"কি হবে মাটির গহ্বরে ঢুকে 
কঙ্কাল পাথর ফসিল কুড়িয়ে এনে?
পুথি ঘেঁটে লাভ নেই
নাই বা হল পি-এইচ ডি; ডি.ফিল.
অথবা ডি.লিট।
অর্থ না সন্মান?
অথবা দুটোই?
ক্ষুধা নিয়ে যাও যদি মাটির গহ্বরে
মাটির ক্ষুধার চাপে চাপা হবে তুমি।
ইতিহাস সজীব কি নির্জীব?
জিজ্ঞাসার জাল বুনে লাভ নেই কিছু।
বিজ্ঞান কি গতিশীল?
সঠিক উত্তর মেলা ভার"---

কোনো জিনিস ফেলনা নয়। এই মর্মার্থ উপলব্ধি করেছেন ড. সুকুমার মাইতি। তাই পুরানো দলিল দস্তাবেজ, ঠিকা পত্তনি চুক্তিপত্র, চিঠিপত্র, পঞ্চায়েতী নামা, হুকুমনানা, ইজারাপত্র, পাট্টা, আবেদন নিবেদন ঋণপত্র বা বন্ধকনামা, তালপাতা ও তুলোট কাগজে লেখা দ্বি সহস্রাধিক সংস্কৃত ও বাংলা পুথি, ভাস্কর্য, টেরাকোটা মূর্তি, পোড়া মাটির লিপিলেখ, পুরানো মুদ্রা তিনি সংগ্রহ করেছেন। বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন আজ থেকে অন্তত ১০০ বছর আগেকার প্রাচীন ইতিহাসকে। এজন্য স্থাপন করেছেন 'বিজন পঞ্চানন সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র'। পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরেই সুকুমার বাবুর সেই কর্মশালা। যদিও তাঁর জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নার প্রত্যন্ত গ্রামে।

১৩৪৫ এর ১৪ জৈষ্ঠ্য (২৮/০৫/১৯৩৮) জন্ম। প্রথাগত পড়া শেষ করে ১৯৬৩ তে রামচন্দ্রপুর রাইসুদিন হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ৩৬ বছর পর ১৯৯৯ তে অবসর নেন। এরই মাঝে ১৯৭২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের অধীনে নরসিংহ বসুর 'ধর্মমঙ্গল'-এর ওপর গবেষণা করে 'পি এইচ ডি' লাভ করেন। ভ্রমণকাহিনীকার সুবোধকুমার চক্রবর্তীর অমর সৃষ্টি 'রম্যাণিবীক্ষ্য' পর্বমালা অবলম্বনে উপস্থাপন করেন 'রম্যাণিবীক্ষ্য ও ভারততত্ব'। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পেয়েছেন 'ডি. লিট' সম্মান।
তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন তিনি। শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকেই সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন এলাকায়। তুলে আনতেন প্রায় অচ্ছুৎ জিনিসপত্র। সেগুলিই এখন ইতিহাস গবেষকদের কাছে অমূল্য সম্পদ। সেইসব মহামূল্যবান সম্পদ রক্ষিত করার লক্ষ্যেই গড়ে তোলেন 'বিজন পঞ্চানন সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র' (১৯৭০)।

পুথি বিশেষজ্ঞ অক্ষয়কুমার কয়ালের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমেই আলাপ হয়েছিল প্রথমে। সুকুমার মাইতির লেখা 'লাউসেনের রাজধানী ময়না' পড়ে লিখেছিলেন চিঠি। এরপর কলকাতায় আলাপ। এসেছিলেন বাড়িতে। সেখানে নিবিষ্ট চিত্তে পুথি পাঠ করতে দেখে পুথির প্রতি আরো ভালোবাসা এবং টান জেগে ওঠে সুকুমার মাইতির। আজ National Archives of India র অর্থানুকূল্যে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভাবে পুথি সংগ্রহ করে রেখেছেন।

কী নেই তাঁর সংগ্রহে? কবি সাহিত্যিকদের ৬০০ র বেশি চিঠিপত্র সযত্নে রক্ষা করছেন তিনি। এখন দুষ্প্রাপ্য প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মানসী ও ধর্মবাণী, নদীয়া দর্পণ-এর মতো পত্রিকাগুলি তাঁর ভাণ্ডারে। ড. মনোরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন – "অবসর জীবনেও ক্ষেত্রানুসন্ধানে সমান আগ্রহী। নরম মাটি, সবুজের স্বপ্নে ভরা তমলুকের ময়না ব্লকের এই কৃতি গবেষকের গবেষণার ফসল ধর্মমঙ্গল কাব্য কাহিনীর নায়ক লাউসেনের রাজধানী ময়না আরও একবার নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তথ্যবহুল আলোচনায় সমৃদ্ধ হয়ে"।

মূক তাম্রলিপ্ত জনপদ ও তার ভাষা মুখর হয়েছে সুকুমার বাবুর সৌজন্যে। দুই মেদিনীপুরের বিশেষ করে তাম্রলিপ্তের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তিনি সংগ্রহ করেছেন নিরলসভাবে। তাঁর সেই প্রচেষ্টার লিখিত রূপ পাই নানা বইয়ের মাঝে। ড. সুকুমার মাইতি লিখেছেন তাম্রলিপ্তিক উপভাষা জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতি (১৯৮৯, ১৯৯১), সাহিত্য ইতিহাস অনুধ্যান (১৯৯৮), নরসিংহ বসুর ধর্মমঙ্গল (২০০১), সুবর্ণ সাক্ষর (১৯৯৫), কোম্পানী আমলে দক্ষিণবঙ্গে ভূমিব্যবস্থা ও কৃষি অর্থনীতি চর্চার তথ্যাবলী, উনিশ ও বিশ শতকের দলিন দস্তাবেজে আইন আদালত ভাষা সমাজ ও সংস্কৃতি (২০০৪), মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যসৃষ্টি সংগ্রহ সংরক্ষণ পাঠ প্রকরণ ও গবেষণা, বৃহৎ বঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম জগন্নাথদেব শ্রীচৈতন্যদেব : তত্ব ও তথ্যের নীরিক্ষা, বিজন পঞ্চানন সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র -- বিবরণাত্মক সংগ্রহসূচী (২০২২), রাইসুদ্দীন আহম্মদ জীবন ও সাধনা (২০০৮, সম্পাদনা), সুরেন্দ্রনাথ জানা রচনা সমগ্র (২০০৮, সম্পাদনা), বৃহত্তর ময়নার ইতিবৃত্ত (১৯৭১, সম্পাদনা), নদী মাটি প্রাণ (২০০৯, উপন্যাস), বধূমাতা, শিলালিপি (১৯৯৩, কাব্য), প্রত্যয় (১৩৭২, কাব্য), এ জীবন সমুদ্র সফেন (২০০৪), শঙ্খ জীবন (২০১০), শাস্তি একটি নমস্কার (১৯৯৩, ছোটগল্প), অমৃতময় এ ভূবন মধুময় এ জীবন, গীতিমালিকা, দক্ষিণ ভারতের পথে, উত্তর ভারতের পথে ইত্যাদি গ্রন্থ। 

সদা হাস্যময় এবং মিতবাক এই মানুষটির কাছে গেলে মেলে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক নানা সহায়তা। আঞ্চলিক ইতিহাস আজ তাঁরই মদতপুষ্ট হয়ে প্রাণ পেয়েছে। তাঁর কথায়, "হারানো গোরু খোঁজ করার মতোই পরিশ্রমসাধ্য কাজ বা তথ্যানুসন্ধান করতে হয় গবেষকদের। ধৈর্য্যধরে সূত্রানুসন্ধান করে যদি সঠিকভাবে চলা না যায় তাহলে যেমন হারানো গোরু সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি গবেষণা করে আসল তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়। এ কথাও সত্য একজন গবেষক তাঁর স্বল্পায়ূ জীবনে পরিপূর্ণ সত্যের সন্ধান নাও পেতে পারেন। এমনকি তাঁর আবিষ্কৃত সত্য পরবর্তীকালে মান্যতা নাও পেতে পারে। তবে তিনি যে সত্যানুসন্ধানের পথ আবিষ্কার করে যান সেই পথে উত্তরসুরীদের যাত্রা সহজতর হয়ে ওঠে"।

একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী তাঁর মধ্যে মেলে। তাই খ্যাতিহীন গ্রামের মানুষ হয়েও আজ তিনি খ্যাতির শিখরে। মেদিনীপুরের এই সন্তান আজ তাঁর নিজস্ব কর্মগুনে হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments