জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো /পর্ব ১ /সুকন্যা সাহা

আমি  আমার মতো
পর্ব ১
সুকন্যা সাহা 

মুখবন্ধ 


জীবন পথ একটা জার্নি। কত মানুষের  সঙ্গে পরিচয় যে হয়  এক জীবনে! কত ঘটনা,কত স্মৃতির মণি মুক্তো ছড়িয়ে থাকে জীবন  পথের  বাঁকে বাঁকে তার ইয়ত্তা নেই ! জীবন  সমুদ্রের তল থেকে সেইসব মণি মুক্তো তুলে এনে  মালা গাঁথার চেষ্টা এই লেখাগুলি।
প্রত্যেক মানুষের জীবন  স্বতন্ত্র। নিজস্বতায়  ভরা ... এক্কেবারে unique।কারো সঙ্গে কারো জীবন মেলে না ... তাই  এই সব কটি লেখারই মূল সুর একটাই ... আমি আমার মতো ... এত খানি জীবন পথ পার হয়ে এসে ফিরে দেখাও  বলতে পারেন। কত মানুষের সঙ্গে যে
আলাপ  হয় একজীবনে!কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার  ঝুলি!তার ইয়ত্তা নেই... বিশেষতঃ আমরা  যারা মানুষ দেখি,তাদের কাছে এ এক পরম পাওয়া ... ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি জীবনের নানা ঘটনাকে ঝাড়াই বাছাই  করে এই স্মৃতিগদ্যের স্বল্প পরিসরে নিয়ে আসা 
বড় সহজ কথা  নয়... তবুও যেসব স্মৃতি, যেসব মানুষ, আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে তারই  কিছু কিছু এখানে তুলে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র ।আপনাদের  ভালো লাগলে সে হবে আমার পরম পাওয়া ...

         নিজের মূল্যায়ন করিনি কখনও ; বোধহয় করাও যায় না ... তবু আয়নায়  নিজেকে দেখতে  গেলে বলতে হয় ঠোঁটকাটা মানুষ, সোজা সাপ্টা,সাংসারিক ঘোর প্যাঁচ থেকে শত হস্ত দূরে। তাই রাত্তিরে এখনও শান্তিতে ঘুমোতে পারি , হাসতে পারি অনাবিল, হিসেব কষে জীবন চালাতে পারি না ...
সব মিলিয়ে আমি আমার মতো ... আর সেই আমির জীবনের নানা ঘটনা, নানা মানুষের চরিত্র উঠে আসবে আজ  থেকে এই ধারাবাহিকের পাতায় পাতায়...বাকিটা আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম...

          একজন  মানুষের জীবদ্দশায় কত লোকের সঙ্গে যে আলাপ হয়! প্রতিটা লোকের সঙ্গে আলাপ মনের মণিকোঠায় রেখে  যায় কিছু স্মৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে  সেই স্মৃতির উজ্জ্বল রঙ কিছুটা ফিকে হয়ে আসলেও প্রতিটা স্মৃতির বর্ণ গন্ধ অনুরণন এক্কেবারে আলাদা স্বতন্ত্র । এই ধারাবাহিকে আমি চেষ্টা করেছি
কাগজে কলমে সেই অনুরণনের কিছু কিছু অংশ তুলে ধরার। মনের মণিকোঠার  গহ্বর  থেকে বের  করে আনতে সেইসব নানান বিচিত্র রঙের স্মৃতির ঝিলিমিলি।
         
        আমার আমি... নয় নয়  করেও পঁয়তাল্লিশ  বছর কাটিয়ে  দিলাম জীবনের এই আমিটাকে নিয়ে। এখানে যেন দুটো আমি।আমি প্লাস আমি।একটা আমি ধীর, স্থির,শান্ত তো আরেকটা আমি উচ্চকিত ; চঞ্চল।একটা আমি দুর্বার গতিতে সামনের দিকে এগোতে চায় অথচ আরেকটা আমি গোধূলিবেলায় ফেলা আসা দিনের 
স্মৃতি রোমন্থন  করে । তবে এই দুটো আমির কেউই একে অপরের বিরোধী নই। অতীতকে ভুলে  নয় ... অতীতের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত পালকের  সাহায্যেই ভবিষ্যতের পথ  চলা... এটাই আমার আমি ...আমি এক্কেবারে আমার নিজের মতো... এর কোনো কার্বন কপি হবে না। সেই আমার আমির জীবনের পথ চলার নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখার মালা...
ভালো লাগল কিনা আপনারাই বলবেন ... 
                                                                   

পর্ব ১

ছেলেবেলার গন্ধ ...

শহরের মধ্যে হলেও আমাদের ছোটোবেলায় গাছ গাছালির পাট একেবারে উঠে যায়নি ... তখনও পাড়া ব্যাপারটা ছিল... গগনচুম্বী  অভ্রভেদী ফ্ল্যাট বাড়ি তখনও গ্রাস করেনি মধ্যবিত্ত পাড়ার  নিজস্বতা। প্রত্যেক বাড়ি সংলগ্ন কিছু গাছ গাছালি থাকত।
আমাদের বাড়ির সামনেই ঠিক ঢোকার গেটের মুখে ছিল একটা শিউলি গাছ ... জল,বাতাস আর আলোর অভাব ছিল না বলেই হোক বা মাটিতে গজিয়ে উঠেছিল বলেই হোক গাছটা বেড়ে উঠেছিল তরতর করে।ছোটো থেকেই শিউলি গাছটা ছিল এক্কেবারে  আমার বন্ধুর মতো ।
কত গল্প,গান,অভিমান ... পুজো আসলেই ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুলে ভরে উঠত গাছের ডাল ... আর কি ঘ্রাণ ... সন্ধ্যে বেলা খেলা থেকে ফেরার সময় বুক ভরে নিতাম শিউলি ফুলের সুবাস ।রাতে বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখে দিতাম শিউলি ফুল । বিছানায় ঘ্রাণ হবে । ঠাম্মা বলতেন বালিশের তলায় ফুল রাখিস না ... অত তীব্র মিষ্টি গন্ধে সাপ আসতে পারে! ধুর!কে শোনে কার কথা ! বর্ষাকালে ঘন নরম সবুজ কচি কচি পাতায় ভরে উঠত গাছের গা। আর পাতায় পাতায়
সবুজ শুঁয়োপোকার ছড়াছড়ি। একদম বোঝাই যেত না। মহালয়ার দিন তো বন্ধুদের সঙ্গে রীতি মত কম্পিটিশন চলত কে কত শিউলি ফুল কুড়োতে পারে তার ... একদিকে রেডিওতে মহিষাসুর মর্দিনী অন্য দিকে শিউলি ফুল কুড়ানোর কম্পিটিশন। সাদা রুমালে জড়ো হত অজস্র শিউলি ।
ফুল শুকিয়ে গেলেও রুমালের গায়ে লেগে থাকত কমলা বোঁটার ছাপ আর সুঘ্রাণ ...শিউলি  গাছটা  ছিল  আমার মান অভিমানের সাথী; কথা  বলার বন্ধু। কেউ না বুঝলেও আমি ওর কথা বুঝতাম ঠিক। সেবার ধরা পড়ল চোখ খারাপ।ছোট্ট একটা মুখে এই ইয়াব্বড় ধ্যাবড়া একটা চশমা। একদিন শিউলি গাছটাকে 
জিজ্ঞেস  করলাম কেমন লাগছে গো নতুন চশমায় ? কিছুক্ষণ মুখের   দিকে চেয়ে চুপ করে রইল শিউলি গাছটা  তারপর গা দুলিয়ে জবাব দিল ..."উঁহু একদম বিচ্ছিরি... ঘরে এসে সে কি কান্না আমার ...মোটা কালো ফ্রেমের চশমা একদম যে মানাচ্ছে না আমায়! বলতে না পারলে কি হবে;সব বুঝতে পারতাম আমি ...
একদিন ঠাম্মা  বলল ,"কাল থেকে সকালবেলা শিউলি পাতার রস  খাবি ।"
না...না...বিচ্ছিরি তেতো... অজুহাত দিলাম আমি ।
আসল কথা হল পাতা ছিঁড়লে শিউলি গাছটার যে ব্যথা লাগবে!আমার বন্ধু না ? 
আমার সঙ্গে পাল্লা  দিয়ে লম্বা হয়ে উঠছিল শিউলি গাছটাও ... কত্ত ডাল!  পাতার কি বাহার !
শরতকালে ডালে ডালে পাতার ফাঁকে ফাঁকে  ছোট্ট ছোট্ট মুক্তোর  মত ফুল... কি সুন্দর !
একবার হয়েছে কি মামার বাড়ি  গেছি দিন দশ -পনেরোর জন্য । বাড়ি ফিরে গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম । কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল!!ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম...এক্কেবারে গোড়া থেকে পুচিয়ে কেটে দিয়েছে... পাশের বাড়ির পাঁচিল তৈরি হচ্ছে... এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে ঠাম্মাকে ঝাঁকাতে থাকলাম, “বল,আমায় না জিজ্ঞেস করে কেন কাটলে আমার শিউলি গাছ? জানো না আমার বন্ধু ছিল?” 
ঠাম্মা বলল," আরে ছাড় ছাড়!দেখো পাগল মেয়ের কান্ড!!আমি কেটেছি নাকি? পাশের বাড়ির পাঁচিল তৈরি হবে না?” আবার ছুটে গেলাম বাড়ির সামনে...দুচোখে উপচে পড়ছে জল...সেই বিচ্ছিরি কালো ফ্রেমের চশমার ওপারে অভিমানী দুটো চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে... শিউলি গাছ তুমি কি দেখতে পারছ? শিউলি গাছ?
 
(ক্রমশঃ)
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

4 Comments