আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে
পর্ব ১৮
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
আত্মার আত্মীয়
মানুষের রক্তেই আছে আত্মীয়তার গন্ধ। আত্মীয় কি কেবল পরিবারের নিকট সম্পর্কের লোকজন? এবং দূর সম্পর্কের লোকজন? নাকি যাদের সঙ্গে কেবল রক্তের সম্পর্কে আছে তাঁরাই আত্মীয়?
আমার মনে হয় আত্মার সঙ্গে যার সম্পর্ক সেই আত্মীয় । আমি তো বাস্তবে দেখি স্বর্ণ তার ভাই এর জন্মদিনে আমাদের নিমন্ত্রণপত্র দিয়েছে। হাম্পি স্বর্ণর আদরের ভাই এর জন্মদিনে সবাই জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করবে, আনন্দ করবে। হাম্পি আসলে একটি প্রিয় পেট ওদের।
তবে হাম্পি কি আত্মীয় নয়?
এই যে মানুষ কেন আমরা তো সবাই কে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়াতে চাই।এই ভাবে personalize করা আমাদের স্বভাবজাত। বীরভূম জেলার একমাত্র পাহাড় "মামা ভাগ্নে" খুব বিখ্যাত পাহাড় ।
মামাভাগ্নে পাহাড়টি গ্রানাইট শীলায় তৈরী।
বীরভূম জেলার দুবরাজপুর শহরের নিকট অবস্থিত। মামা আর ভাগ্নে একটি চিরন্তন সম্পর্ক। সেই আত্মীয়তার ছোঁয়া পাহাড়ের গায়েও লেগে গেল কি মাজার বলুন তো! "আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা ".... এই ছড়াটি সব শিশুদের মুখের মিষ্টি ছড়া। এখানে চাঁদকে মায়ের ভাই মামা বলা হয়েছে। আবার দেখুন সূর্যকেও মামা বলে ডাকা হয় নজরুলের বিখ্যাত ছড়া "... রবিমামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ঐ / দারোয়ান গায় গান/ শোনো ঐ রামা হৈ" সূর্য পূব আকাশে ওঠে যখন লাল রঙের জামা পরে আছে বলে মনে হয় তাই গায়ে রাঙা জামা বলা হয়েছে।
বেড়ালকে বাঘের মাসি বলা হয়। কারণ বাঘ হচ্ছে বিড়াল গোত্রের প্রাণি। "মায়ের বোন মাসি ভাত কাপড়ে পুষি" খুবই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য এটি।
মা সন্তানের সব চেয়ে কাছের জন, মাসি সেই মায়েরই বোন তাই সেও বড় আপন আমাদের।
মানুষের নামও আমরা পশু পাখির নামে রাখি। আমরা বাচ্চাদের নাম দিই টিয়া, ময়না, তিতির, বুলবুল, পতত্রী এগুলো সবই পাখির নাম।
হিমাচল প্রদেশের লাহৌল অঞ্চলের একটি নামহীন চূড়া। অভিযাত্রী দলের নেত্রী সুজয়া ঘোষ, সুদীপ্তা সেনগুপ্তক, কমলা সাহা প্রথম এই চূড়ায় পা রেখেছিলেন। তাঁরাই এই চূড়ার নাম দিয়েছিলেন "ললনা" যার অর্থম মহিলা। আসলে সব কিছুতেই আত্মার ছোঁয়া না থাকলে ভালোবাসা যায়না। নাম না দিলে কি করে পরিচয় হবে? রবীঠাকুরের "পরিচয়" কবিতা "মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক / আমি তোমাদেরই লোক"।
আত্মার সঙ্গে যিনি মিলিত হতে পারেন তিনিই আত্মীয়। বাংলাদেশে রূপসা নদীর নাম কার নামে রাখা হয়েছে জানেন?
এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের একটি নদী এবং এটি গঙ্গার একটি শাখা নদী।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় নড়াইল জেলার ধোন্দা গ্রামে রূপচাঁদ সাহা নামে এক ধনী লবণ ব্যবসায়ী ছিল। লবণ ব্যবসা করে তিনি বিরাট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্থানীয়
ছোট নদী কাছীবাছার সাথে ভৈরব নদের সংযোগ করতে হলে একটা খাল কাটতে হবে। তাহলে বাণিজ্যের খুব সুবিধা হবে। তাই তিনি খাল কাটলেন এবং নাম হল রূপচাঁদ সাহা খাল। পরবর্তীকালে ভাষার পরিবর্তনে লোকমুখে তা রূপসা নদী নামে প্রচলিত হয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা "রূপশার ঘোলা জলে হয়ত কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ভিঙা বায়"।
আজও সবার মুখে মুখে ঘোরে এই নদীর কথা।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের একটি জায়গার নাম কল্যাণী। দেশের নাম জায়গার নাম বদল হয় কালের নিয়মে। আগে এই শান্ত শহরটির নাম ছিল চাঁদমারিহল্ট। পরাধীন ভারতে সামরিক উপনিবেশ সেই হিসাবে নদীয়া জেলার গঙ্গার ধারে পঁয়তাল্লিশ টা গ্রাম নিয়ে তৈরী হয় রুজভেল্ট নগর।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের নামেই এই নামকরণ করেছিলেন। রুজভেল্টের সামরিক শহরকে নতুন ভাবে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলেন স্বাধীনোত্তর ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধান চন্দ্র রায়।
ডাক্তার নীলরতন সরকারের মেয়ে "কল্যাণী"র নাম অনুসারে এই পরিত্যক্ত সামরিক শহরের নাম হয় কল্যাণী। এটি সবার মুখে মুখে প্রচলিত আসল সত্য কি আছে এর ভেতরে তা আমার জানা নেই।1954 সালে চাঁদমারিহল্ট নাম মুছে ফেলে লেখা হয় কল্যাণী। আমার মনে হয় কল্যাণ বা মঙ্গল অর্থে কল্যাণী রাখা হয়েছে।
অনেক পুরনো বট গাছকে আমরা বৃদ্ধ বট বলে ডাকি। আত্মীয়তার বীজ আমরা সব জায়গায় ছড়িয়ে রেখেছি। চাঁদকে কখনো কখনো সুন্দরী রমণী হিসাবে কল্পনা করি, কবি,সাহিত্যিকদের কলম বিশেষণে বিশেষিত ক'রে রচিত হয় চাঁদের গুণ কীর্তন। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে পৃথিবী বিখ্যাত মানুষদের নামে জায়গার নাম যেমন ধরুন নিউটন, আইনস্টাইন এই মুহূর্তে সব মনে পড়ছেনা তবে শুনে প্রথমে খুব বিস্মিত হয়েছিলাম।
জামসেদপুর এ "ভালোবাসা" বলে একটি জায়গা আছে, কি মিষ্টি নাম বলুন তো?
আমরা বলি আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ।
নদীকে কেন্দ্র করে শহর, দেশ সভ্যতা, ব্যবসা বাণিজ্যের আদান প্রদান সংস্কৃতির বিনিময় হয়।
নদী মায়ের মতোই আমাদের বুক দিয়ে আগলে রাখে। রক্তের যে সব সম্পর্ক এতটুকু মনে আনন্দ দেয় দেয়না উল্টে জীবন তছনছ করে দেয় তাদের তবু আমরা আত্মীয় বলে স্ট্যাম্প মারি, টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু যে সম্পর্ক আপনাকে শান্তি দেয়, বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে সাহায্য করে এবং যে সম্পর্ক শ্রদ্ধা এবং প্রেমের অথচ তাঁর সঙ্গে আপনার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, আমার প্রশ্ন তিনি আপনার আত্মীয় নন? আমার মনের ঘরের যে পড়শি সেই তো আমার আপন। যে আমাকে বিপদে, অসময়ে বলবে "এই তো আমি আছি চিন্তা কি?" আপনার নিজের দুহাত বাদ দিয়ে যে হাত গুলো আপনাকে বাঁচতে বলবে আরো দীর্ঘদিন সেই তো আপনার আপন, আত্মীয়। আপনার পরম আত্মীয় আপনার প্রেমিক বা আপনার স্বামী একবার ভাবুন তো সে কি আপনার রক্তের সম্পর্কের? সারাজীবন সে যে আপনার আত্মার আত্মীয়।
সবথেকে বড়কথা আমরা দেশকে মা বা দেশমাতৃকা বলে সম্মান করি। আমাদের মায়ের মতোই আমাদের জন্মভূমি।
যে দেশে আমি বাস করি, যে দেশের খেয়ে পরে আমি বড় হয়েছি, আমার রক্তে মিশে আছে সেই দেশের জল হাওয়া। আমি শরীরে ধারণ করি সেই দেশের ধূলিকণা।
যদি বাইরে যাই সেখানে গিয়েও বাংলার খাবার খুঁজি, বাংলা বলা লোক দেখলে নিজের থেকে এগিয়ে যাই। মনে হয় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম শান্তিতে দুটো কথা বলে। তখন সেই অচেনা মানুষ অচিরেই আমার আত্মীয় পরিজন হয়ে ওঠেন। খুব সত্যিকথা বলতে আমার চেনা জায়গা, চেনা মানুষ, চেনা ভাষা, চেনা পোশাক, চেনা খাবার, আমার মানিয়ে নেওয়া জলবায়ু এই যা যা কিছু উল্লেখ করলাম সবই আমার আত্মীয়। সে স্পর্শে আমি সজীব হয়ে উঠি, অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিই, আপন ভাষায় ঝগড়া করে মনের ঝাল মেটাই সেখানেই তো আমার আত্মার সম্পর্ক। আত্মীয়তা মানে বন্ধন কিংবা গৃহ বা ঘর বলা যেতে পারে। যেখানে আমি বাস করি বা আমার ভেতর যারা বাস করে। আমি একা হতে পারিনা কারণ আমি মাটি ফুঁড়ে উঠিনি। আমি মানে সমষ্টি। আমি মানে বংশ, আমার পরিবার, আমার কর্মক্ষেত্র, নিজের পাড়া পড়শি এবং নিজের দেশ।
শুধু কি তাই সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গেই আমি জড়িত।
আমার চিন্তা আমার অনুভবের জাল চারিদিকে বিছানো। মানুষের মন সবসময়ই আত্মীয়তা খোঁজে, সে আপন করে কিছু আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। মনে পড়ে বিখ্যাত নজরুল গীতি "আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়"।
0 Comments