জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৪৪/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব- ৪৪

গাইড টিকিট নিয়ে এসে প্রত্যেকের হাতে দিলেন, আমরা ক্যাসেলের ভিতরে এলাম।  গাইডবুক দেখে জানলাম এখানে অনেককিছু দেখার আছে। অস্ত্রশস্ত্র, পুঁথিপত্র, আরও অনেককিছু দেখলাম, ছবিও তুললাম। তবে সব জায়গায় ছবি তোলার পারমিশন নেই।ওপরে বেশ কিছুটা খোলা জায়গায় অনেকগুলো কামান সাজিয়ে রাখা আছে। এখান থেকে শহরটা দেখার চেষ্টা করলাম। শহরের মাঝ বরাবর একটা নদী, দূর থেকে মনে হচ্ছে নদীটা যেন কোনো সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। এটা আমার মনে হচ্ছে। আদৌ কাছাকাছি কোনো নদী বা সমুদ্র আছে কিনা জানিনা। গাইড বুকটাও ঠিকভাবে দেখা হয়নি। ক্যাসেলের ভিতর অনেকগুলি মিউজিয়াম আছে, মিউজিয়ামগুলিতে  ইউরোপের পুরনো রত্ন সমস্ত রাখা আছে। আর আছে রাজাদের পোশাক, মুকুট ও বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র। আর একটা জিনিস দেখলাম, সেটা হল রাজপরিবারের পোষা সারমেয়দের সমাধিক্ষেত্র।আমরা যে ছাদহীন খোলা জায়গার প্রাচীর থেকে বেশ কিছুটা নিচে তাকালে ত্রিকোণ আকৃতির সমাধিক্ষেত্রটি দেখা যাচ্ছে এবং প্রত্যেকটি সমাধি আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে। যাইহোক এখানে এত দেখার জিনিস রয়েছে যে এই অল্প সময়ে সবগুলি দেখে ওঠা সম্ভব  নয়। একটি অল্প বয়সী ছেলে স্কটিশদের ড্রেস পরেছিল, বনি তার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে সে রাজি হলনা। একসময় ওরা আমরা নিজেদের মত ঘুরছিলাম। সেইসময় আর একজন স্কটিশকে পেলাম, তিনিও লাল সাদা সবুজ চেকের স্কারট পরেছিলেন। তিনি খান সাহেবের সঙ্গে ছবি তুলতে রাজি হলেন।
      ক্যাসেলের মধ্যে বেশ কয়েকটি গিফট সপ রয়েছে, এনভারনেসে কিছু না  কিনে পারার ক্ষোভটা এখেনে মিটিয়ে নেব ভেবেছিলাম, কিন্তু দামের কারনে কয়েকটা জিনিস কিনে বেরিয়ে এলাম। ওখান থেকে বের হতেই আমাদের গ্রুপেরই কর্নেলের মিসেস আমাকে দেখে বললেন, আপনার জ্যাকেটটা খুব সুন্দর। কোথায় কিনেছন? নটিংহামে কিনেছি শুনে বললেন, আমাদের দেশে এত সুন্দর মেয়েদের জ্যাকেট পাওয়া যায় না। বনি ক্যামেরায় ছবি দেখতে দেখতে আমাদের কাছে আসছিল, জায়গাটায় বৃষ্টির জল গড়িয়ে যাওয়ার জন্য সামান্য নিচু নালার মত করা ছিল ও বুঝতে পারেনি, ঠোক্কর খেয়ে পড়ল ধপাস করে, হাত থেকে ক্যামেরা ছিটকে পড়ে সব খুলে ছড়িয়ে পড়ল। ভিতরে কিছু নষ্ট হয়নি, বাইরের অংশে টোল পড়েছে। এখানে একটি ফ্যামিলিকে বাংলায় কথা বলতে শুনে বুঝলাম ওনারা পশ্চিমবঙ্গর মানুষ। বাংলাদেশের ভাষা বাংলা হলেও উচ্চারণে পার্থক্যতে বোঝা যায়।
      আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে  ক্যাসেলের বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পর বাস এলে আমরা যে যার সিটে বসলাম। শরীর খুব ক্লান্ত, চোখ জড়িয়ে আসছে। বাস রওনা দিয়েছে। এখন আমরা গতকাল ছেড়ে আসা গ্লাসগো শহরে ফিরছি। আমাদের স্কটল্যান্ড ভ্রমণ শেষ। আজ গ্লাসগোর আগের হোটেলেই রাত্রিবাস। তার আগে কোহিনূর রেস্টুরেন্টে আরও একবর ডিনার করার সুযোগ। পরদিন বাস টুরিস্টদের নিয়ে লন্ডন ফিরে যাবে। মাঝে বারমিংহামে আমাদের নামিয়ে দেবে। 

    এবার আমরা হোটেলের ৫তলায় রুম পেয়েছি। সবে রুমে ঢুকে বসেছি, বনির ফোন, কাকিমা কি করছেন? আমি তখন স্নান করার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু ওর জেদের কাছে হার মান্তেই হল, কাকিমা, ডিনার করে এসে স্নান করবে। তোমাদের রুমে যাচ্ছি, জমিয়ে আড্ডা দেব। ওরা এলে আবার চা বানালাম। আড্ডা চলল আটটা পর্যন্ত। তারপর একসঙ্গে কোহিনূরে ডিনার করতে গেলাম। আমরা পাঁচজনে এক টেবিলে বসলাম। আজ রান্নায় সামান্য ঝাল হয়েছে। তমালের ছেলে সান খেতে পারছিলনা। খাওয়ার মাঝখানে একজন ওয়েটার এসে জানিয়ে গেল, দরজার পাশের টেবিলে ফ্রায়েডরাইস, ক্ষীর ও ডাল রয়েছে। আমি একটুখানি ফ্রায়েডরাইস ও ক্ষীর নিয়ে এলাম। ক্ষীর ঠিক নয়, ফিরনি বলা যায়, হিদু বাড়িতে যেমন সুগন্ধি গোটা চালের পায়েস রান্না হয়, তেমনই মুস্লিম বাড়িতে সুগন্ধি চাল গুঁড়ো করে ফিরনি রান্না হয়। এটা পায়েসের থেকে তরল হয়। কোহিনূর থেকে ফিরে আরও ঘণ্টাদুই আড্ডা চলল, বনির ওঠার ইচ্ছা ছিল না। তমাল জোর করে  নিয়ে গেল।

      পরদিন সকালে টাইম ছিল ৭ টা থেকে ৮টা। আমরা দুজনেই ৭ টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট করার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। আজ করনফ্লেক্স আর ডিম খেলাম। আমরা বের হচ্ছি, তমালরা এসে বসল। হাতে সময় আছে, তাই রুমে ফিরে মিনিট ১৫ রেস্ট নিয়ে তারপর লাগেজ নিয়ে নিচে এসে বসলাম। অনেকেই  বসে আছেন। ফোন নাম্বার দেওয়া নেওয়া করছেন। আমি আজ আবার শালোয়ার কামিজ পরেছি। ড্রাইভার আর গাইডের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে ওনারা খুশি মনে রাজি হলেন। তবে গাইড অভিযোগ করলেন, এতদিন সুন্দর ড্রেস পরছিলেন, তখন কেন ছবি তুল্লেন না? আমাদের মধ্যে আজ একটি বাচ্চা মেয়ের জন্মদিন। নাম আংশি। আজ ওর একবছর পূর্ণ হল। ওর বাবা মা মেয়েকে কলে নিয়ে প্রত্যেকের কাছে গিয়ে চকলেট বার দিল এবং নিজেরা প্রণাম করে মেয়ের জন্য আশীর্বাদ চেয়ে নিল।
    এই কয়েকদিনে কোথায় চলে গেছলাম। কোনোদিন এইসব জায়গা যাওয়ার কথা কল্পনাতেও আসেনি। সেই কোন ছোটবেলায় গল্পে পড়েছিলাম ‘মনস্টার’এর কাহিনী। সেই লেক স্বচক্ষে দেখব কখনো ভাবিনি। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে জানালায় চোখ রেখে শেষ বারের মত দেখে নিচ্ছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর স্কটল্যান্ডকে। যেটুকু দেখলাম, তাতে কিছুটা বুঝলাম ইউরোপকে কেন সবচেয়ে রূপসী মহাদেশ বলা হয়। দুপুর দেড়টা নাগাদ একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাস এসে দাঁড়াল। এখানেই লাঞ্চ করে নিতে হবে। এত ভিড় এখানে যে টয়লেটে লাইন দিতে  হল। আমরা দুজনে হাল্কা কিছু খাবার আর কোল্ড ড্রইংস নিয়ে লনে বসলাম।  পাশেই আমাদের সহযাত্রী, যাকে আমরা কর্নেলের মিসেস বলেই চিনেছি। তিনি আজ আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বললেন। উনি বাংলা বোঝেন এবং বলতেও পারেন। কিন্তু আজই প্রথম বাংলায় কথা বললেন। আরও কয়েকজন যে বাঙ্গলা জানেন, সেটা ধিরে ধিরে জেনেছি। আরও একটি অল্প বয়সি বাঙালি দম্পতি রয়েছে, মেয়েটি পরিচয় করার সময় জানিয়েছিল, সে একজন নৃত্যশিল্পী।

    একসময় আমাদের নিয়ে স্টার টুরের বাস বারমিংহামের রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াল। বাসে চড়ে ছিলাম যেখান থেকে, এটা তার বিপরীত দিকে।তবে যাওয়া আসার জন্য একটা ট্যানেল রয়েছে। আগের ড্রাইভার জাবেদই আমাদের নিতে এসেছে। কিন্তু আমাদের বের হতে দেরি হচ্ছে তমালের জ্যাকেটের জন্য।। শেষ পর্যন্ত সেটা পাওয়া গেল। ৫০ মিনিটের মধ্যে আমরা নটিংহামে পৌঁছে গেলাম।

      প্রচণ্ড ক্লান্তির কারনে রাতে ভাল ঘুমিয়েছি। এই কয়েক দিন দেশের কোনো খবর নেওয়া হয়নি। আজ ফোন করতে হবে। আমাদেরও দেশে ফেরার দিন এগিয়ে আসছে। জারাকে ছেড়ে কী করে যাব? জানিনা। কথায় আছে ‘আসলের  চেয়ে সুদের মায়া বেশি। দীপ অনেক আগেই হাসপাতাল চলে গেছে। খান  সাহেব  পেপার পড়ছেন। নিশ্চয় পুরনো পেপার। বাড়িতে পেপার নেওয়া হয় না। এখানে বাসে অনেক পেপার থাকে, প্রায়দিনই দীপ ওখান থেকেই পেপার নিয়ে আসে। দেশের সব পেপার তো নেটে পড়া হয়ে যায়।  চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ফোন  করতে শুরু করলাম। বকুল এই সময় কলেজে থাকে, তবে ডেপুটি রেজিস্টার হওয়ার সুবাদে ওকে খুব একটা ক্লাস নিতে হয় না। তাই সবার আগে বকুলকে ফোন করে জানলাম ও ভালই আছে। মেদিনীপুরে ভাইকে ফোন করতে ও বলল, এমনিতে সবই ঠিক আছে, তবে কাজের মেয়ে প্রতিমাসের মাইনে নিয়ে যেতে  ভুলেনা, শুধু গাছে জল দিতে ভুলে যায়। তাই কিছু গাছ মারা গেছে। শুনে মনটা  খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু করার নেই। মঙ্গলাপোতার খবর জানতে বোনকে ফোন করলাম। মা ভাল আছে, ওরাও ভাল আছে।

       এখন জুন মাস, এখানে ভালই ঠাণ্ডা। দেশে এখন প্রচণ্ড গরম। আজ সকালে উঠেই মেদিনীপুরে পাপুকে ফোন করলাম। ও মঙ্গলাপোতা গেছে। দীপা বলল ভাড়াটিয়ার সঙ্গে পাপুর ভাড়া নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। ওরা বাড়ি ছেড়ে দেবে, মাসের অর্ধেক হয়ে গেলেও এমাসের ভাড়া দিতে চাইছিল না। শেষপর্যন্ত  হাফ ভাড়া দিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। গাছের আম একটাও নেই। প্রচুর কাঁঠাল ধরেছিল,নাইম(নাইম রাতে এই বাড়িতে ঘুমায় ) গতকাল একটা কাঁঠাল ওদের দিয়ে গেছে। বলেছে, কাঁঠাল সব চুরি হয়ে যাচ্ছে। তাই নাকি সব কেটে নিয়ে ঘরের মধ্যে রেখেছে। যে যা খুশি করছে, কিচ্ছু করার নেই।

                                ক্রমশ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments