জ্বলদর্চি

কোজাগরী /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কোজাগরী                 
                                                       
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

শাল পিয়াল মহুয়ার বন পেরিয়ে বাবলা কাঁটায় শাড়ির আঁচল বিঁধিয়ে বিপর্যস্ত আমি উদাসী হাওয়ায় অজয়ের তীর ধরে হেঁটে চলেছি। নদীর বাঁকের ধুধু বালির সোনালী চর ছাড়িয়ে এসে পড়েছি বাঁকুড়ার পূর্ব প্রান্তে রাঢ় বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতরে।

সেখানে  রাঙা মাটির পায়ে চলা পথের দুই ধারে গাছেদের নিবিড় সমাবেশ। শিমূল মহুয়ার নেশা জাগানো বুনো গন্ধের নিবিড়তায় স্নিগ্ধ হয়ে উঠছে হৃদয় মন। সকালের  কয়েক পশলা বৃষ্টির পর শরতের আকাশে মেঘ ভাঙা রোদ্দুর  নিজেকে উজাড় করে দেখা দিয়েছে মুক্ত নীল আকাশ জুড়ে।  অজয়ের বুকে শিহরণ তুলে বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা বাতাস ঝিকিমিকি জলে অবিরাম ঢেউ খেলে যায়। তার স্পর্শে  মাঝে মাঝেই উতলা হয়ে উঠছে দুইপাশে সুদূর বিস্তৃত ফসলের সবুজের ক্ষেত। একচালা মাটির ঘরে কাঁচা মাটির প্রলেপ বুলোনো দেওয়ালে বেড়ার জানলা ঘিরে এঁকেবেঁকে খাপড়ার চালা ছুঁয়ে আছে চাল কুমড়োর লতা, পুঁই মেটুলীর তরতাজা সবুজ ডগা। কোথা ও বা নাচের ভঙ্গিমায় জড়িয়ে আছে চিকন পাতার কুঞ্জলতা। মাটির মজবুত স্তুপে সিঁড়ি গেঁথে তোলা মাঠ কোঠা দোতলা ঘর গুলো সবুজ ধানের ক্ষেতের মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মাথা তুলে আছে। ক্ষেতের আলপথ ধরে চলতে গিয়ে দেখি গোবরে পাকে মিশিয়ে ঘরের সামনে ঝকঝকে তকতকে উঠোন গুলো নিপুন ভাবে নিকিয়ে তাতে চক খড়ি দিয়ে আল্পনা আঁকা রয়েছে, লতাপাতা আঁকা গেরুয়া বা মেটে সিঁদুরের রঙে রাঙা অদ্ভুত সুন্দর খড়ের চালার তলে মাটির দেওয়াল। আদিবাসী সাঁওতালি ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণীর খুব নিম্নবিত্ত মিশ্র মানুষের বস বাসের গ্রামের সবার বেশীর ভাগ দিন কাটে জলার ধারের নটে ,কলমীর শাক বা কচুর লতির ঘন্ট সম্বল করে। মোটা চালের ভাতে জল ঢেলে নুন কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজের সাথে তেঁতুল গাছের তলে পরে থাকা পাকা তেঁতুল চটকে। কিন্তু আজ দিন টা অন্য রকম। কোজাগরী পূর্ণিমা! আজ যে মহা উৎসবের দিন মা লক্ষ্মীরপূজো হবে। সাজ সাজ রব পাড়াগাঁয়ের চারিদিকে। এদিকের একমাত্র বর্ধিষ্ণু পরিবার চ্যাটার্জী বাড়ির পূজা দালানে বৎসরান্তরে দেবীর নতুন বিগ্রহর প্রতিষ্ঠা হবে। আমি ও সেখানে আজই --সে বাড়ির বড়ো ছেলে আমাদের  পারিবারিক বন্ধু ব্রতীন ও মাধবীর নিমন্ত্রনে এসেছি। এর আগেও অনেক বার ওদের  গাঁয়ে বেড়ানোর নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম কিন্তু সময় সুযোগ করে উঠতে পারিনি।  এবারে এলো সেই সময় গ্রামের পথে পা ফেলেই মন আনন্দে ভরে গেল।পূজা শেষে শুনেছি প্রসাদ বিতরণের পাট চুকলে রাত ভর এখানে যাত্রা পালা, লোক সংগীত ,ঝুমুর নাচ হবে। আনন্দে মাতবে আপামর গ্রামবাসী।  

 মেঠো পথের দুই পাশে সাদা ধব ধবে কাশের বনে হাল্কা হাওয়ার নাচন লেগেছে। পাশের ছোলা ক্ষেতের জমিতে একঝাঁক একরত্তি ধূসর ছাতারে দের  জোর গলায় কিচিরমিচির চলছে একটানা। সে দিকে নজর দিয়ে দেখি বড়োসড়ো দুই চারটে হলদে বেনেবৌ মাথার ওপর গোল হয়ে ঘুরছে। ওদের দাদাগিরি তেই  যত আপত্তি! ঝগড়া জমে উঠেছে। বেলা শেষের পড়ন্ত সূর্য যাবার বেলায় ফিস ফিসিয়ে কানে কানে কত কি যে বলে যায় --,কাশের বন শেষ হলে চমক লাগায় কচি ধানের ক্ষেতের সবুজ সীমাহীন প্রান্তর।   

 লাল মাটির রাস্তা ধরে চলেছে এক লম্বা মিছিল।     সুরেলা কণ্ঠের হৈ চৈ শব্দে কানপাতি, সচকিত হয়ে দেখি একটু দূরে দল বেঁধে চলেছে গ্রামের কচি কাঁচা দের এক বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা।  পাঁচ থেকে সাত আট দশের মধ্যে বাচ্চা থেকে কিশোর কিশোরীর দল সবমিলিয়ে  বারো-- চৌদ্দ জন হবে।
 সোনালী সূতোয় নক্সা করা লাল পাড় আর হলুদ রঙে মিশোনো ছোট্ট শাড়ি গুলো নিপুন ভাবে শরীরে জড়িয়ে গাছ কোমর বেঁধে কোমড়ে হাত দিয়ে তালে তালে পা ফেলে চলেছে শশী রুমি উজি সীতা সাবিনা শবনমের দল। ভারী চমৎকার লাগছে ওদের পাট ভাঙা একই রকম নতুন শাড়ির পোশাকের সাজে। জয় ধ্বনি দিয়ে নেচে গেয়ে মনের খুশি টুকু প্রকাশ করে একটানা তাল পাতার ভেঁপু বাজিয়ে চলেছে একদম কচিবাচ্চা গুলো। পিছনে বান্টি বুবাই রতুয়া ষষ্ঠী চরণের মাথায় মা লক্ষ্মীর এক অনিন্দ্য সুন্দর মুর্তি। দুই হাত মুঠো করে পুউ-উউ --পু--উ--উ--  শব্দ তুলে শাঁখে যেন ফুঁ দিয়ে চলেছে।খেলনার ভেঁপু হলো সানাই ,পুরোনো কয়েকটা  টিনের কৌটো কে মাদল বানিয়ে  কাঠি দিয়ে দিম-দি ম -দিম  করে  বাজিয়ে সে এক বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা চলেছে তাদের। মনে হলো  ঐ গড্ডলিকা প্রবাহে -- আমি ও ওদের একজন হয়ে যদি মিশে যেতে পারি ওদের দলে ঠিক ওদের মত টি করে। কিন্তু ওরা ওদের খেলায় আমায় নেবে না। হেসে গড়িয়ে পরে মুখ লুকোয়। আমি যে ওদের মত পুচকি নয় ঐ এত্ত বড় লম্বা-- হাত দিয়ে  উচ্চতা  মেপে দেখায়।ওদর ছোট দের দলে খুব বেমানান।
গ্রামের প্রান্তে আদ্দিকালের ঐ বুড়ো বট গাছটির থেকে অজস্র শিকড়ের মত ঝুঁড়ি ঝুলছে , যে বটের ঝুড়ি মুঠোর মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে এখোনো এই বয়সে ও মনে হয়,যাই গিয়ে কয়েক পাক দোল খেয়ে আসি। সে বটের তলে পূজো হয়ে যাওয়া রোদে পোড়া বৃষ্টির জলে রং চটা পাঁচটা বিবর্ণ মূর্তির মধ্যে সদ্য কেউ আজ ই বসিয়ে গেছে মা লক্ষ্মীর  লাল টুক টুকে বেনারসি শাড়ি পরানো গত বছরের এক প্রতিমা। ছোটো দের এই দল টির চোখ পড়েছে বলা যায় মন কেড়েছে ঐপুরোনো দেবী মূর্তিটি। ওরা তাকে নিয়েই আজ আসর জমিয়ে পূজার খেলায় মেতেছে । 

  দীঘির ধারে রুমি দের বাগানের পেয়ারা তলে রকের মত সিমেন্টের বাঁধানো বেদীতে শবনম খুব যত্নে ওর নতুন সালোয়ারের গোলাপী ওড়না ভাজ করে মা লক্ষ্মীর আসন পেতে দিলো । উল্লাসের লহরী তুলে দেবী কে আসনে বসিয়ে এবারে তাকে মনের মত সাজানোর কাজ চলছে। সঙ্গে গল্প ও চলছে মুখ  হাত নেড়ে ঠিক বড়োদের মত-।--রাঢ় বাংলা বাঁকুড়া বীরভূম অঞ্চলের এই প্রত্যন্ত পল্লীর আঞ্চলিক ভাষায় এতো মিষ্টত্ব এতো মাধুর্য্য আমাকে মোহ মুগ্ধ করেছে। সূর্যাস্তের গোধূলি বেলায় বালকের দল মগ্ন নানা রঙের ঘুড়ির কাগজ কেটে মালা বানিয়ে পেয়ারা তলা সাজিয়ে তুলতে। সাবিনা বরাবর রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকে। দেবী মূর্তি টির ঠোঁটের ওপর লাল রঙ ,ছলছলে কান্না ভেজা চোখের পাতায় কালো কাজলের তুলি বুলিয়ে নিমেষে হাসি ময় করে তুলেছে দেবীর অনিন্দ্য সুন্দর মুখ মন্ডল টি। শাড়ির রঙ একেক জায়গায় ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়াতে  লাল আর সোনালী  মিশিয়ে শিল্পীর অসাধারণ কুশলতায় কয়েকটা টান মেরে সুন্দর মেকাপ করে দিয়েছে।  সোনালী রাংতায় মাথার মুকুট, গলার হাড় ,হাতের গয়না ঝকমক করে উঠলো। লক্ষ্মী দেবী মূর্তির সাজ এখন নিটোল পরিপাটি। গৌরী সীতা ছোট্ট কচি হাতে খড়ি মাটি গুলে আঁকিবুকি কেটে পূজা বেদীর তলায় আল্পনায় আঁকছে ধানের শিষ পেঁচা পদ্ম । একটু তফাতে গাছের তলায় মাটির ঢিবির ওপর বসে এই ক্ষুদে দের পূজার আয়োজনে রবাহূত অতিথি হয়ে নীরব দর্শক আমি। অমন সুন্দর  গ্রামীণ আঞ্চলিক ভাষার কথোপকথন কান পেতে শুনতে বেশ লাগে। আফসোস হচ্ছিল ওদের ভাষায়  কথা বলতে পারিনা। ওদের মন ভোলানো গুনগুন  সুরে  গান গাওয়ার  সাথে প্রাঞ্জল আলাপচারিতায় যোগ দিতে পারছিনা।সব কথার শেষে দেখি একটি 'বটেক' যোগ করে। মাধবী দিব্যি ওদের ভাষা জানে। ওদের কথ্য ভাষা -আমায় বোঝায় তর্জমা করে।  

 গৌরী মহা উৎসাহে গল্প করে,হাত যথা সম্ভব উঁচুতে তুলে দেখায়  চ্যাটার্জী দাদুর বাড়ির পূজা দালানে লক্ষ্মীর এ--তো-- বড়ো প্রতিমার সাথে  পট --সড়া-- ও থাকবে। ও বাড়ির ছোটমা সেবারে পটুয়া পাড়া থেকে লক্ষ্মীরপট চিত্র আঁকা এক সুন্দর সড়া এনেছিল। সেখানে সুন্দর  সুন্দর সব  ছবি আঁকা, নদীর জল আলোময় করে অজস্র পদ্ম ফুটে আছে। ধান বোঝাই নৌকায় লক্ষ্মীদেবী পেঁচা সমেত বসে আছেন। লাল পাড় সাদা শাড়ি তে গায়ের বৌ রা সব জোড় হাত করে গলায় আচঁল জড়িয়ে পাঁচালি পড়ছে।  
ছোটোমা বলে আজ গৃহস্থ দের  সব ঘরের  দোর  খুলে রেখে সবাই কে রাত জেগে পাশা খেলতে হয়। আজ যে -বৈকুন্ঠ থেকে পেঁচার পিঠে চড়ে আকাশ পথে মা নেমে এসে সবার ঘরে ঢুকে ধন সম্পদের হদিশ নেবেন। দেখবেন কো --জাগতী রে ? যে ঘরের দ্বার রুদ্ধ থাকবে সে ঘরে মা ঢুকতে না পারলে বেশ রাগে করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবেন যে। ধানের ক্ষেত থেকে গোলায় মাঠে ঘাটে ফসলের ক্ষেতে গৃহস্থের ঘরে ফুল ফলের বাগানে ঘুরে বেড়াবে মা। তাই  উঠোন নিকিয়ে আতপ চালের পিটুলি গুলে আল্পনা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হবে বাড়ি ঘর দোর। দালান থেকে গোয়াল ঘর ,ধানের বড়ো বড়ো গোলা মরাই ঢেঁকি সবে দেবীর পদ চিহ্ন আঁকা চাই। শবনম সীতা গৌরী সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে যদি একবার দেবীর দেখা পাই তাহলে বলবো 'হেই মা! আমাদের সবার ভালো করে দিস রে। খরা দিস না মা রে। পানি দে, মেঘা দে বটেক, বারিষ দিস মা গো,মাঠ ভরা হরিয়ালী দিস । রোগ শোক দিস না,সব্বাই কে ভালো রাখিস মাগো।' এমন কত সব মনোস্কামনা, কত প্রার্থণা তাদের।                     
ওদের মা রেনু পিসি,ছুটকি পিসি বড়ো কাকী দের  দিন ভর ভারী কাজের চাপ পড়েছে বড়ো বাড়িতে। লাল সাদা ঝালর দেওয়া চাঁদোয়া টাঙানো হয়েছে। সারা গ্রামের মানুষ প্রসাদ পাবে ,সে যে বিশাল আয়োজন। সীতার স্বপ্ন মাখা মুখে উজ্জ্বল লোভাতুর চোখ,শুকনো ঠোঁটে লালা গড়ায় ,জীভ দিয়ে চেটে  নিয়ে দুই হাত জোরা করে দেখিয়ে বলে এই এত্তো বড়ো মুড়ির মোয়া , খৈয়ের মোয়া তিল নারকেলের নাড়ু , খাঁজা ,তক্তি। নারিকেল ছাপা বেসমের লাড্ডু ও হবে।  সব চমৎকার স্বাদের মিষ্টি গো।                                                                                                                                           খিচুড়ি ছ্যাছড়া চাটনী ঘন দুধের হলদে পায়েস ! শেষ পাতে আবার একটা করে বড়ো রসে টুসটুস পান্তুয়া। উফঃ ক-ত-দিন পর এ-ত খাওয়া  হবেক গো মোদের "।  লম্বা টানা মাটির দাওয়ায়  লাইন দিয়ে সব পাত পেড়ে বসে যাবে কলাপাতা নিয়ে। মাটির গ্লাসে পিতলের জগ থেকে জল গড়িয়ে দেবে রামু দাদা। সেই ক-ত -বড়ো নৌকার মত খিচুড়ির গামলা তলায় চাকা লাগানো ঠেলে দিলে সোজা গড়িয়ে যাবে। সেখান থেকে বালতি , ভরে গরম খিচুড়ি নিয়ে এসে ডাবু হাতায় করে পাতায় ঢেলে দিলে, বা -প- রে সব যে গড়িয়ে সামনে আসতে চায় । গতবারে ইশ ! খুব কষ্ট পেয়েছিলো  গো! বোকা রুমি গরম খিচুড়ি তে তড়িঘড়ি  হাত ডুবিয়ে দিলো , ওর কচি নরম হাত লাল হয়ে পুড়ে গেলো। সেই কি কান্না কেঁদেছিল খেতে  পারলো না বেচারা আর যাত্রা পালা শুরুর ঘন্টা বাজলে কেঁদে কঁকিয়ে ঘুমিয়ে গেল। " বান্টি বলে "গত বারের কথা মনে নেই? সীতা হরণ পালায় হনুমান বেশে মদনা দাদার লঙ্কায় যাওয়ার আগেই লেজের আগুন  নিভে গেছে আর মুখে বলছে-কি- না -সোনার লঙ্কাপুরী জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। সবাই হেসে গড়িয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে ।হনুমান যেই ঝাঁপাতে গেল লেজ খসে কাপড় খুলে সে  এক কান্ড সব মিলে মাটিতে গড়াগড়ি। সাধের যাত্রা পালা পন্ড হয়ে গেল,আর রাবণ রাজা  রাগে চিৎকার করে নিজের  দশটা মাথা হাতে নিয়ে ঘুরতে লাগলো ---কি মজা ---হিঃহিঃহিঃ"। সব গল্প হচ্ছে ওদের আঞ্চলিক ভাষায়। আর আমি একান্তে বসে  নিজের ভাষায় ওদের কথা গুলো মনের মাঝে সাজিয়ে  নিচ্ছিলাম।       

ছোট্ট উজি ছুটে এসে হাত পা নেড়ে আমাকে দেখায় ---ক-ত --ফুল মায়ের সাথে ভোর বেলায়  শিউলী তলা থেকে কুড়িয়ে কাঁচ প্যাকেটে যত্ন করে ভরে রেখেছে। সীতা শবনম বুনো ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছে।পদ্ম দীঘির জলে পদ্ম নেই বরং অজস্র শাপলা আর পানিফল আছে। দামাল ছেলের দল নাইতে গিয়ে তাই তুলে নিয়ে এসেছে এখন সবার হাতে হাতে শাপলা কুঁড়ি। দেখি সবাই ফুল ফোটাতে ব্যস্ত । গাঁয়ের বাগানে ঘুরে কেউ এনেছে দুটো কলা একটা শসা বেদানা কয়েক টুকরো নারকেল। বাতাবী লেবু গাছ থেকে মস্ত দুটো লেবু পারা হয়েছে। কারো আঁচলের কোঁচড় ভরা খৈ, চিড়ে ,নারকোলের নাড়ু। কেউ বা এনেছে  চিড়ে মুড়ির মোয়া দুটুকড়ো আমসত্ত্ব। ছোট্টো ইয়াসিন আর ইকবাল গাঁয়ের লাল সুড়কি ঢালা পথের ওপারে মিষ্টির দোকান থেকে  এনেছে গোটা পাঁচেক গুজিয়া,দুটো জিলিপি আর কুচো নিমকির সাথে শুকনো বোঁদে।  খুব যত্ন করে পদ্ম পাতার থালায়  ঢেলে  দিয়ে ভোগ সাজিয়েছে। ওদের চোখে মুখে  বইছে আনন্দ ধারা।  গৌরী কোথা থেকে ধুপ ধুনো মোমবাতি এনে জ্বালিয়েছে বেদীর সামনে । তুলসী , সন্ধ্যা মালতী লাল রঙ্গন যত বুনো ফুলে পূজার থালায় সাজানো , ইটের টুকরো ঘষে চন্দন ও হলো।  তাদের সকলের স্বকণ্ঠে উচ্চারিত স্বরচিত মন্ত্রে চলছে দেবীর আরাধনা। গৌরী বেশ বড়োদের মত  জিভ নেড়ে উলু  দিতে শিখেছে , উজি সীতা ওকে প্রাণ পণ নকল করছে। তবু ও কি মহা জ্বালাতন! অনেক চেষ্টা করে ও বের হয় না উলুর মিষ্টি সুর ধ্বনি। দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে লজ্জায় মুখ লুকোয় দুজনে।           
         
লেবুর ফুলের গন্ধে বাগান ভরে আছে। সূর্য অনেক আগেই শাল পিয়ালের মাথার ওপর দিয়ে বনের গভীরে ডুবে গিয়েছে। অবারিত সন্ধ্যা রাতের নির্মল আকাশে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙ্গা আলোয় ভাসছে বন পাহাড় অজয়ের ঢালু বালু চর। মা যেন স্বর্গ থেকে টুপ করে নামলেন রুপোলি আলোয় ঝলমলিয়ে কাঁচের মত স্বচ্ছ পদ্ম দীঘির জলে ডুব সাঁতার কেটে ঘাটের সিঁড়ি ধরে উঠে এসে বসলেন পূজা মঞ্চে। অবাধ চন্দ্রালোকে অবোধ এই নিষ্পাপ সরল শিশুদের সাথে পূজার খেলায় মাতলেন দেবী পরমা প্রকৃতি। বাগান আলো ময় করে কচি কাঁচাদের স্বরচিত মন্ত্রে জমে উঠেছে দেবীর বন্দনা।  ঠিক তখনই এই অনাসৃষ্টির পূজা ভেঙ্গে দিতে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা  দল বেঁধে --রে-- রে করে তেড়ে এলো । মাতব্বর গোছের মহাদেব দাদু খেটো ধুতি হাঁটুর ওপর তুলে চোখে গোল কাঁচের চশমা ,হাতে লাঠি নিয়ে হৈ হৈ করে আসছে দেখেই মেয়েরা প্রসাদের থালা নিয়ে ছেলেরা প্রতিমা নিয়ে দে ছুট বাগানের ভিতরে সারি সারি শাল গাছের পিছনে।  একদম ছোট্ট বাচ্চা তিনজন এসে অন্ধকারে আমার শাড়ির আড়ালে লুকিয়েছে।  মুহূর্তে বেশ হত চকিত হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বয়স্ক দুজন কে থামাতে বাধ্য করি। দেখি আশপাশ থেকে আরো গ্রামবাসীরা দৌড়ে  আসছে। অবাধ্য ছেলে মেয়েদের চাবকে কঠোর শাস্তি না দিলে ওদের সর্বনাশী খেলার মাত্রা দিনদিন বেড়েই যাবে।  

  ওদের বোঝাই এটা সত্যিকারের পূজা নয়। এই শুধুই খেলা। এতে কোনো অন্যায় নেই কোনো পাপ  লাগেনা। ওরা  দরিদ্র  নিরক্ষর গ্রামবাসী  ,অজানা আশঙ্কায় হা হুতাশ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে ,শুধু  বলে ''দিদি গো বড়ো পাপ লাগবে যে। মোরা নীচু জাত আছি। মোদের হাতে ঠাউর দেওতা জল লিবে না। আমরা যে বাগ্দী হাড়ি ডোম মুদ্দাফরাশ আছি গো বটে।  আমাদের ঠাউর দেবতা ছুঁতেক লাই , পূজা লিয়ে হাসি  তামাশা করতেক লাই বটে।  মারি  মড়ক  পিছু ছাড়ে না। খাদ্য পথ্য কিছুক লাই ; খরায় সব মাঠ কে মাঠ উজাড় হয়ে জ্বলে যায়। এই বার দেবী রুষ্ট হয়ে শাপ দিবেক, সব ছারখার হইয়ে সংসার রসাতলে যাবেক বটে। " শবনম দের মায়েদের ও এক ই ভয় '' বড়ো অধম্মো হইবেক ,মস্ত পাপ লাগবে বটেক ''। আমি ভাবি  ওদের মনে যে কুসংস্কার বাসা বেঁধে আছে তার থেকে বোধহয় জন্ম জন্মান্তরেও ওদের মুক্তি নেই। বলি মা  তো সবার মা হন। ধনী দরিদ্র উঁচু নীচু  খারাপ  ভালো  সব মায়ের সন্তান।  বোঝাই  নিষ্পাপ এই  শিশুদের কোনো জাত ধর্ম হয় না ,তারা ঈশ্বর আল্লার প্রেরিত শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মিথ্যা ভয় পাচ্ছো ,বাচ্ছাদের মারধর বকুনি দিলে বরং দেবী রুষ্ট হবেন। ছেলে মেয়েরা ততক্ষণে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে প্রসাদ ভাগ করে নিচ্ছে। মনে হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ এক কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর পূজো দেখলাম।  দূরে অনেক দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে মাঠের প্রান্তে মহুয়া তলে সাঁওতালি আদিবাসীরা চাঁদের আলোয় তখন গোল হয়ে নেচে নেচে মাদল বাজিয়ে চলেছে। আমি দুচোখ ভরে দেখেছি আনন্দ ধারায় ভাসছে নিখিল ভুবন। এতো টানাপোড়েন এত অভাব অভিযোগ এত বিভেদ এত বৈচিত্রের মধ্যে ও অদ্ভুত সুন্দর এক মহা মিলনের ভারতবর্ষ হাতে হাত রেখে আগামীর পথে এগিয়ে চলেছে। ওরা জাত পাতের ভেদাভেদ জানে না। কোনো মলিনতার ছোঁয়া নেই ওদের চিন্তায়।এই সদ্য জন্মানো কচি কাঁচার দল যেন এক অখন্ড ভারতবর্ষের স্রষ্টা। এই শিশু প্রাণ গুলো তার রূপাকার।  

 গত বারে  মাঘের শীতে জয়দেবের কেন্দুলির মেলায় এসেছিলাম। কথা থাকলে ও সেবারে বাউলের আখড়ায় ধুনি জ্বালিয়ে শীত তাড়িয়ে সারা রাত মেলায় রাত কাটানো হয় নি। বাউল গানের সাথে কপালে তিলক কেটে তার ই সাথে মাধুকরীর সঙ্গী হয়ে পথে পথে ঘোরাও হয়নি।  তবে এবার সুযোগ এলো এই কোজাগরীতেই নদীর চরে।     

                গেরুয়া আলখাল্লা, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি জড়ানো গলায় তুলসীর কন্ঠী মালা,কপাল  জুড়ে  তিলক কাটা। একতারা হাতে টুং টাং শব্দ করে নন্দ বাউল এসেছে  আমাদের  কেন্দুলীতে নিয়ে যেতে ওর গুরু উদ্ধভ বাউলের আখরায় । ওর সাথে জোৎস্না ধারায়  ভিজে  চলেছি বাউলের আখড়ায়। কেন্দুলি তে বাউল পাড়ায় তার যে বেশ খ্যাতি নাম যশ। দূর দূরান্ত জুড়ে  নন্দ বাউলের মত কত শিষ্য শিষ্যা।   সে যে  বিশেষ কথা দিয়েছে তার সদ্য রচিত নতুন গান গুলো প্রথম আমাকেই শোনাবে। সে যখন একতারায় সুর তুলে গান ধরবে তার বাউলিয়া উদাত্ত কণ্ঠের সুরের  সংগীতে অজয়ের  দুকূল ছাপিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আলোড়ন তুলবে নদীর চরে।                         

জোৎস্না ভেজা রাতে নিস্তব্ধ বালুচরে আমরা বন্ধুরা ক'জনে গা ভাসিয়ে শিশির সিক্ত বলিতে পা ডুবিয়ে চলেছি । নির্জনপথে  চলতে চলতে  একতারায়  টুং টাং সুর  তুলে নন্দ বাউল এবার রাতের আকাশ কাঁপিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরেছে  ''মায়া নদী কেমনে যাবি বাইয়া '' শেষ হলেই আবার নতুন গান টুটাং শব্দে বেজে ওঠে '' আর কত কাল রইবো গুরু তোমার এই ভুবনে ''----ব্রতী বলে এসে গেছি আর বেশী দূরে নয় ঐ দেখা যায় নদীর ধার ঘেঁষে উদ্ধভ বাউলের টিমটিমে আলো জ্বেলে সারা রাত প্রতীক্ষায় থেকে জেগে কাটানোর সেই আখড়া।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

4 Comments

  1. উপস্থাপনা ও বিষয়বস্তু উল্লেখ্য তবে বিবরণ আরোও সংক্ষি্প্ত হতে পারতো

    ReplyDelete
  2. প্ৰিয় দিদি, "কোজাগরী" যেনো এক দর্পন, যেনো এক পদাবলী! আমি তো পড়তে পড়তে লেখার পরতে পরতে চলে গিয়েছিলাম ওদের কাছে! কি যে ভালো লাগলো!
    লেখার সার্থকতা তো সেখানেই যেখানে শব্দ দিয়ে মায়াজাল সৃষ্টি হয়, নিজেকে সব চরিত্রের একজন মনে হয়! ধন্য তোমার লেখনী, ধন্য তোমার নিখুঁত চোখে সব দেখা! শুভেচ্ছা জানাই!🙏🙏💐💐

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর লেখা, পড়ে মন ভরে গেল।

    ReplyDelete
  4. ভালো হয়ে ছে!লিখতে থাকো!সেজদি!!

    ReplyDelete