জ্বলদর্চি

ফিরে আসা (বগটুই গ্রামের গণহত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা)/অর্ণব মিত্র

ফিরে আসা 
(বগটুই গ্রামের গণহত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা)
অর্ণব মিত্র 

 
পায়রাগুলো আবার ফিরে এসেছে 
সেই বাড়িতে
সেদিন রাতে তারা উড়ে গেছিল 
তাদের বহুকালের আশ্রয় ছেড়ে-
আগুনের তাপে জ্বলতে থাকা 
মাটির উত্তাপ থেকে
বাঁচবার জন্য, 
আর উড়ে যেতে যেতে 
শুনেছিল আর্তনাদ,
তাঁদের যারা আশ্রয় দিয়েছিল 
এতকাল,
দেখেছিল তাঁদের 
শেষ মুহূর্তের অসহায়তা-
দেখেছিল ছায়ামূর্তির মত 
আততায়ীদের উল্লাস 
রাত্রির অন্ধকারে, 

বহুবছর ধরে 
এই মাটির বাড়িতে তাঁদের বাস
টিনের ও খড়ের চালের নিচে 
ছিল তাঁদের ছোট্ট সংসার
বকম বকম আওয়াজে 
মেতে থাকতো এই ঘরগুলো
দিনরা্‌ত,
ঘরের মেয়েরা উঠোনে ছড়িয়ে দিত 
চালের দানা,
ধানঝাড়াই-এর পর উঠোনে 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো 
ধান আর খড়,
গোয়ালঘরে বাছুরকে তাঁর মা 
গা-চেটে আদর করতো,
গোয়ালঘর থেকে দুধ-দুইয়ে আনতো 
বাড়ির মেয়েরা, 
রোজ সকালে ঝলমলে আলোয় 
খড়ের স্তুপের আসেপাশে 
খেলে বেড়াত
কতকগুলো কুকুরছানা, 
ঝলমলে রোদে ভরা উঠোনে 
দেখা যেত তাঁদের মায়ের স্তন থেকে 
দুধ খাওয়ার চঞ্চলতা,
ছায়াঢাকা পুকুরের শান্ত জলে
কয়েকটি মা-হাঁস তাঁর বাচ্ছাদের নিয়ে
ঘুরেবেড়াত দুপুরজুড়ে,
বর্ষার দিনে পুকুরের জল 
উঠে আসত উঠোন অবধি,
গোয়ালঘরের পাসে আমগাছ থেকে 
ভেসে আসত কোকিলের গান।
তাঁরা ফিরে এসে দেখে 
পড়ে রয়েছে সেই ঘরগুলো,
আগুনে পুড়ে যাওয়া দরজা-
জানলার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে 
আজ নিঃশব্দ থমথমে সেই বাড়িতে 
আবার ফিরে এসেছে তাঁরা । 
কিন্তু এসে শুধু তাঁদের দু –চোখ 
খুঁজে বেড়ায় যাদের
তারা আজ কোথায়!!,
কোথায় সেই স্নিগ্ধ হাত!    
কোথায় সেই দিনরাত 
ঘরোয়া কাজের ব্যস্ততা, 
কোথায় সেই মেয়েলি শব্দের
স্নেহময় কোলাহ্‌ল,
বাচ্ছাদের মায়ের স্তন থেকে 
দুধ-খাওয়ার চঞ্চলতা্,
পুকুরের জলে বাচ্চাদের 
স্নানের উল্লাস,
রান্নার ও 
বাটনা-বাটবার আওয়াজ, 

সেই সাজিনা বিবি , 
শে্লি বিবি ,
রুপালী বিবি, 
নাজিমা বিবি,
আজ কোথায়!!

বৃষ্টিস্বপ্ন  

বৃষ্টির ছবি ভেসে আসে 
ফিরে আসে পুরনো সেই 
স্নিগ্ধ শীতল বৃষ্টিময় দিনরাত ।

সন্ধের বৃষ্টিতে দেখা যায় 
ঝাপসা পাড়া 
ও রেল-কোয়ার্টার 
আর ভাঙ্গা দোকানঘরের সারি, 
ঠাণ্ডা হাওয়ার সাথে সাথে 
ভেসে আসে বৃষ্টির শব্দ,
কোন হিন্দি গানের সুর 
ও চলমান ম্রিদু কোলাহল।  

কেউ হেঁটে যায়  
ও চলে যায় দূরে, 
তাঁর অন্ধকার অবয়ব গিয়ে মিশে যায় 
বৃষ্টি ভেজা পাড়ায় , 

দেখা যায়  
রেল-কোয়ার্টারের ধারে ধারে  
লাল মাটির উপর 
পায়ে চলা পথ 
জেগে ওঠা ঘাসের সবুজ রঙের মধ্যে দিয়ে 
অদৃশ্য হয়েছে 
আবছা বৃষ্টিসন্ধার অন্ধকারে ,
 
খুঁজে ফিরি 
ফেলে আসা কৈশোরের 
পুরনো দিনরাত 
বৃষ্টির কুয়াশায় ঢালুপথে  
আবছা আলোয় ডুবে থাকা 
মায়াবী পাড়ায়, 
দেখি -টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার 
সেই জলে ডোবা পথ,
বাল্বের আলোয় দেখা যায় 
মসজিদ পুকুরের উপচে পড়া জল 
আর তার উপর বৃষ্টির ফোটা,

শুনি সেই স্কুল থেকে ফেরার কোলাহল,
যেন দেখি - স্কুল থেকে 
বাড়ি ফিরছি আমি  
ভেজা দুপুরে -ট্রেনলাইনের ধার দিয়ে
ধ্বসে যাওয়া লাল মাটির পথে,
দূরে বৃষ্টিভেজা লোকাল ট্রেনের 
যাওয়া আসার শব্দে।

গাছপালার শেষ সীমার ওপারে 
দিগন্তে আলো কমে এসেছে,
সন্ধের ঠাণ্ডা হাওয়ার সাথে
ভেসে আসে পুরনো পাড়ার 
বৃষ্টিভেজা ঘরবাড়ির ছবি,
দেখা যায় তরুণ সঙ্ঘ ক্লাব 
ভেসে আসে আড্ডার শব্দ 
আর ক্লাবের সামনে 
নেতাজীর মূর্তির উপর
বৃষ্টি পড়ে চলে সারারাত।

দেখি ,দুটি রেল –কোয়ার্টারের মাঝে 
বৃষ্টি ভেজা সেই গলিপথ
আর 
বৃষ্টি থামার পর 
সেই নিম গাছের মাথায়    
গলির উপর 
এসে দাঁড়িয়েছে চাঁদ,

এমনই এক বৃষ্টিময় দৃশ্যের মধ্যে 
বৃষ্টিস্বপ্নের ভিতর 
ঘুমিয়ে থাকি- 
সারারাত বৃষ্টি পড়ে স্বপ্নের ভিতর। 



শেষ দেখা 

(২২ শে শ্রাবণ স্মরণে)


আজও সকাল থেকেই মেঘলা 
অন্ধকার আকাশ 
জানলা দিয়ে দেখি 
বৃষ্টি নামবে আজ 
শহরতলির দিগন্তজুড়ে 

খুব জানতে ইচ্ছা করে 
যখন চলে গেলে 
সেদিনও কি শেষ দেখায় 
বৃষ্টি ভরা আকাশ 
দেখেছিলে ,
জলে ভেজা হাওয়ায়
দুলেছিল পাতা আর 
ঝাপসা হয়ে এসেছিল চোখ ।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments