জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/ষোড়শ পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী       
        
ষোড়শ পর্ব         

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

সম্রাট কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে তানসেন সরস্বতীকে ডেকে রূপোয়াতীকে তাঁর কক্ষে এসে দেখা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পরে রূপোয়াতী কক্ষে প্রবেশ করে বললেন "আপনি আমাকে ডেকেছিলেন"। তিনি সস্নেহে বললেন "দেখো রূপোয়াতী তুমি সেদিন অসাধ্য সাধন করে আমার জীবন বাঁচিয়েছ। তোমার এই ঋণ আমি কোনদিন ভুলবো না"। এইবলে তিনি সম্রাটের দেওয়া গজমতির মালা রূপোয়াতীর কণ্ঠে পরিয়ে দিয়ে বললেন "আমি সম্রাটের সাথে কিছুক্ষণ পূর্বে কথা বলে তোমাকে রানা প্রতাপের কাছে পাঠাবার সব ব্যবস্থা করেছি"। তানসেনের এই কথা শুনে রূপোয়াতী বিষন্ন মুখে বলল "আপনার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন, কিন্তু আপনাকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো? আপনাকে মনেপ্রাণে যে গুরুর আসনে বসিয়ে আমার এই দেহ মন সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিয়েছি"। তার কথা শুনে তানসেন বললেন "তোমাকে সেই রাত্রিতেই আমি বলেছি আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা সকলেই আমার প্রতি বিশ্বস্ত এবং আমি তাদের প্রতি দায়বদ্ধ। তাদেরকে ছেড়ে আমি তো তোমাকে নিয়ে আলাদা ঘর বাঁধতে পারবো না। আমি স্থির করেছি তুমি যাওয়ার সময়ে তোমাকে আমি আমার কাছে যা কিছু সোনা দানা, মনিমুক্তো, রত্নরাজি আছে সব তোমাকে দেব। রানা প্রতাপ অবশ্যই তোমাকে সু-পাত্রস্থ করবেন। তুমি নিজেও তাতে সুখী হবে আমি এই আশীর্বাদ করছি"। তানসেনের কথাগুলি শুনে রূপোয়াতীর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। তানসেনকে প্রনাম করে অশ্রুসিদ্ধ কণ্ঠে সে বলল "বেশ তবে তাই হোক। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না একথা আগেই বলেছি। আমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা আপনাকে কষ্ট করে করতে হবে না। আমি এখান থেকে স্ব-ইচ্ছায় এমন এক স্থানে চলে যাব যেখান থেকে আপনার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না"। এই কথা বলে সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। রূপোয়াতীর শেষের কথাগুলি শুনে তানসেনের মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।                                          

দ্বিপ্রহরে আহার পর্ব শেষ করে তানসেন নিজের কক্ষে এসে বিশ্রামের জন্য শয়ন করলেন। গবাক্ষ দিয়ে স্নিগ্ধ বাতাস আসছে। কিছুক্ষণ পরে কোন কিছু পোড়ার গন্ধ বাতাসে ভেসে আসতে লাগলো। প্রধান বাঁদী আয়েশাকে ডেকে বললেন "দেখো তো হাভেলির কোথাও আগুন লেগেছে কিনা? বাতাসে মাংস পোড়ার গন্ধ আসছে"। চতুর্দিক ঘুরে আয়েশা এসে জানালো "রূপোয়াতীর কক্ষের অর্গল বন্ধ এবং সেখান থেকেই পোড়া গন্ধ আসছে"। এই কথা শুনে তানসেন ত্বরিত গতিতে রূপোয়াতীর কক্ষের কাছে যেয়ে শুনতে পেলেন কক্ষের ভেতর থেকে রুদ্রবীণার দ্রুতলয়ের ঝঙ্কার এবং রূপোয়াতীর কন্ঠে দীপক রাগের সুর। তিনি বুঝতে পারলেন রূপবতী নিজেকে শেষ করার জন্য দীপক রাগ গাইছে। তিনি বারংবার কক্ষে আঘাত করে দরজা খুলতে বললেন এবং দীপক রাগ বন্ধ করতে আদেশ দিলেন। যখন রূপোয়াতী কিছুতেই দরজার অর্গল খুলল না তখন তানসেন প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন দরজা ভেঙে রূপোয়াতীকে কক্ষ থেকে বের করতে। প্রহরীদের ক্রমাগত ভারী কাষ্ঠখন্ডের আঘাতে এক সময়ে দরজার অর্গল খুলে যেতে তানসেন দেখলেন রূপোয়াতীর সর্বশরীর দীপক রাগের প্রভাবে ঝলসে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে রূপোয়াতীর হাত থেকে রুদ্রবীণা কেড়ে নিয়ে বললেন "এ তুমি কি করলে রূপোয়াতী? দীপক রাগের কি ভয়ঙ্কর পরিণতি তা তুমি জানতে। তা সত্ত্বেও আমার উপরে অভিমান করে কেন এমনভাবে নিজেকে শেষ করার ইচ্ছা তোমার হল? 

হাভেলীর বাঁদীরা রূপবতীকে ধরাধরি করে দ্বিতলের চত্বরে নিয়ে আসার পরে তানসেন রূপোয়াতীর মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে যেয়ে বললেন "এভাবে কেউ অভিমানে নিজের সম্ভাবনাপূর্ণ সুন্দর জীবনকে শেষ করে দেয়? তুমি তো কয়েকদিন পূর্বে দেখেছ দীপক রাগের প্রভাবে আমার কি ভয়ঙ্কর পরিণতি হয়েছিল" 

রূপোয়াতী কোনক্রমে বলল "আপনার কাছ থেকে আমাকে কোনদিন চলে যেতে হবে আমি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আপনার কাছ থেকে আসন্ন বিচ্ছেদের কথা শুনে স্থির করলাম আমার এই সুন্দর জীবন আর কার জন্য বাঁচিয়ে রাখবো? তাছাড়া রাজস্থানের মেয়েরা কারো কাছ থেকে মালা গ্রহণ করলে তাকেই মনে মনে স্বামীরূপে বরণ করে নেয়। কিন্তু আপনি তো আমাকে সে সুযোগ দিতে চাইলেন না। তাই আপনার কাছ থেকে শেখা দীপক রাগ গেয়ে আমি আপনার ঋণ শোধ করতে চেয়েছিলাম। আমার শরীরে বড় কষ্ট। আপনি আমাকে একবার মেঘমল্লার রাগ শুনিয়ে একটু জল এনে দেবেন"। এই কথা শুনে অসুস্থ শরীরে তানসেন বীণাযন্ত্র নিয়ে রূপোয়াতীর প্রতি সমস্ত আবেগ ভালোবাসা উজাড় করে মেঘমল্লার রাগ গাইতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘমল্লার রাগের প্রভাবে বাতাসে জলকনা এসে রূপোয়াতীর শরীরকে সিক্ত করে তুলল এবং বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির ফোটা গুলি জিভ দিয়ে চেটে রূপবতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আকাশের বৃষ্টির ফোঁটার সাথে তানসেনের চোখের জল মিশে যেয়ে রূপোয়তীর কন্ঠে যেয়ে তার পিপাসাকে শান্ত করল। তানসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল "আঃ কি শান্তি"। এই কথা বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে গেল। তানসেন রূপোয়াতীর মস্তক কোলে তুলে নিয়ে অশ্রুসজল কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে বললেন 'এক সম্ভাবনাময় সঙ্গীত জীবনের করুণ সমাপ্তি ঘটলো'।   

রূপোয়াতী মারা যেতে তানসেন এক গভীর অনুশোচনা ও হতাশায় ডুবে গেলেন। অবচেতন মনে তিনিও হয়তো রূপোয়াতীকে ভালোবেসে ছিলেন কিন্তু সমাজ, সংস্কার, পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতাকে সম্মান জানাতে যেয়ে তিনি হয়তো তা প্রকাশ করেননি। রূপোয়াতীও তাঁকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল। তাই নিজের জীবন বিপন্ন করে তানসেনের জীবনকে বাঁচিয়ে সে শুধু চেয়েছিল আগ্রার কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে মরুপ্রান্তরে একখানি ছোট ঘর বাঁধতে যেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের কলুষতা স্পর্শ করবে না। সেখানে সে আর তানসেন দুজনে দুজনার জীবনকে সঙ্গীতে ভরিয়ে তুলবে। কিন্তু সেই না পাওয়ার বেদনা সহ্য করতে না পেরে তানসেনের প্রিয় সঙ্গীতের মাধ্যমে আত্মাহুতি দিয়ে সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল দয়িতের প্রতি তার ভালোবাসা।                            
ক্রমশঃ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments