জ্বলদর্চি

সর্বকালের প্রবাদপ্রতিম কবিসত্তা শক্তি চট্টোপাধ্যায় /প্রসূন কাঞ্জিলাল

সর্বকালের প্রবাদপ্রতিম কবিসত্তা শক্তি চট্টোপাধ্যায়

প্রসূন কাঞ্জিলাল

অতিথি অধ্যাপক হয়ে এসে বেশ কিছুদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন পূর্বপল্লী গেস্ট হাউসের দোতলায় তেইশ নম্বর ঘরে। সারাদিন আড্ডা আর অধ্যাপনায় কেটে যেত কবির। একদিন কবি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শরৎ মুখোপাধ্যায় একত্রিত হয়েছিলেন এক কবিতা পাঠের আসরে। আসর বসেছিল বিকেলে। তারিখটা ছিল উনিশে মার্চ, উনিশশো পঁচানব্বই। শতরঞ্জি পাতা বড়ো ঘরে সবাই বসেছে। চায়ের পালা শেষ করে কবিতা পড়তে শুরু করলেন শক্তিই। একটার পর একটা। কী অসম্ভব ভেতর থেকে একটা তাগিদ আর আবেগ অনুভব করছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কেউ আবার পড়তে বলছে কি বলছে না – সেদিকে তাঁর দৃষ্টি নেই। তিনি একটির পর একটি কবিতা পড়ে চলেছেন পাতা উল্টে উল্টে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন তাঁর মধ্যে নেই। হারিয়ে গেছেন। বই হাতে তুলে বাবু হয়ে বসে পড়ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি যেন অনেক দূরের কোনও কবি, যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কী দীপ্তি বলিষ্ঠ সুউচ্চ উদাত্ত আত্মহারা কণ্ঠ! ধ্বনিত হোলো কবিতার লাইনগুলো –
‘সেগুনমঞ্জরী হতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে
আমি আছি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে
আমি আছি সর্পদষ্ট, জাগাও আমাকে
বৈবানে সন্ন্যাসে আছি, জাগাও আমাকে
আমি জাগবো না, আমি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে
যথাব্রত করো, তুমি জাগাও আমাকে
আগুনের ছোঁয়া দিয়ে জাগাও আমাকে
পাপ স্পর্শ করে তুমি জাগাও আমাকে ... ।‘

শেষ দুটি ছত্রে কবির উচ্চারণ –

‘আমি সব দিয়ে যাবো জাগাও আমাকে
শুধু জাগরণ চাই বারেক জীবন।‘

যে মানুষটা তাঁর গভীরতম তীব্র আবেগে জেগে ওঠার প্রার্থনা জানালেন তাঁর কবিতাপাঠে, সেই মানুষটাই দু’দিন যেতে না যেতে তেইশে মার্চ রাত্রে সেই যে শুলেন, আর জাগলেন না। থেমে গেল শক্তি চাটুজ্যের’পদ্য’।
মৃত্যুর পূর্বে সত্যিই কিন্তু শান্তিনিকেতনে শক্তি জেগে উঠেছিলেন। শান্তিনিকেতনে সবাই তাঁকে জাগতে দেখেছিলেন। বলেছিলেন কলকাতায় ফিরে গিয়ে আবার কবিতা লিখবেন। এখানে বসে কবিতা লেখা যায় না, এখানে সংগ্রাম নেই, সংঘাত নেই – চারিদিক জুড়ে শুধু শান্তি আর শান্তি। শান্তির শান্তিনিকেতনে বসে আর যাই হোক, কবিতা লেখা যায় না। তবুও কি কিছু লেখেননি। অন্তত ছোট্ট একটি কবিতা এখানে বসেই লিখেছিলেন। কবিতার নাম “অকাল বৃষ্টিতে”। ছ’লাইনের কবিতা –


‘ হঠাৎ অকালবৃষ্টি শান্তিনিকেতনে 
রাত ভোর বৃষ্টি হোলো শান্তিনিকেতনে
আমের মঞ্জরী পেলো বৃষ্টি ও কুয়াশা
বসন্তের মুখোমুখি শিমুল পলাশ
ফুল বৃন্তচ্যুত হয়ে খসে পড়ে ঘাসে
মানুষ স্থগিত ঘরেচক্রে বসে আছে’।

শক্তি তাঁর সেই সময়ের মনের কথাটাই কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। যা লিখেছেন সাহিত্যিক অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। আবার অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ উপলক্ষে রচিত এক নিবন্ধে বলেছেন, “শক্তির প্রয়াণ ঘটল অতর্কিতে। কিন্তু সে জন্য আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠার দায় নেই তাঁর, কেন না জীবদ্দশাতেই তাঁর কবিতার একূল-অকূল পূর্ণিমার যশোরেখায় ছেয়ে গিয়েছিল”। 
মরার আবার সময় – অসময়। শক্তি নিজেই লিখেছিলেনঃ “মৃত্যু থেকে পার নেই, যেন তালকানা পাখি উড়ে এসে পড়বেই ফাঁদে”। কেমন সে মৃত্যু ? গোড়ার লেখাতেই অনেক বার শক্তি লিখেছেন মৃত্যু আর শবযাত্রা আর চিতার কথা। শুরু না হতেই এত মৃত্যু কেন ? শক্তি লিখেছেন, “ তবে হয়তো মৃত্যু এসব করেছিস জীবনের ভুলে”। আবার লিখেছেন, “তাঁকে চিতায় বেঁধে উল্লাস করছে মেঘেরা সারা রাত” – যেন সুখ করে লিখেছেন। পরে সেই মৃত্যুকে নিরূপিত করেছেন এই স্তবমালায় –

“মৃত্যু, তুমি খাপছাড়া ইশকুলের টিফিনে ছেলে,
মৃত্যু, তুমি রাসবিহারী ট্রামলাইন,
মৃত্যু, তুমি মেয়েদের চুলে ভরা নীল কাঁচ পোকা ...”

বর্ণালি ভরা এই মৃত্যুর রূপ বদলে গিয়েছিল পরের দিকে। তখন মৃত পিতার মমতাহীন চোখের মতন মৃত্যু এসে দেখা দেয় রাতে। মনে হয় সব পাওয়া,পাওয়া হয়ে গেছে, ফসলের কাল এসে গেল; ‘এখন শান্তি, ওঁ শান্তি, দাবা জুড়ে ধানের মঞ্জরী’। তবু যখন মুখ ঘুরিয়ে বলতে শুনি কবিকে –

“এখন যাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে; আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে; আয় আয় –
যেতে পারি
যে কোনো দিকেই চলে যেতে পারি।
কিন্তু, কেন যাব ?”

কেন যাব ? এই সপাট অঙ্গীকারের ভেতরেই কানে আসে পায়ের নিচে জল সরার আওয়াজ। তারপর কবি মিনতি করেছেন দেখি আর কাউকে নয়, আগুনকে; “চলচ্ছক্তি হারিয়ে বসেছে পা, তাকে পোড়াও; দায় বইতে নুয়ে গেল কাঁধ, তাকে পোড়াও;” এখন দেখার বাকি থাকে যদি কিছু ‘সেই অশ্রুপাত শেষ হলে নষ্ট করো আঁখি’। শেষে বলেছেন, ‘হে চিরপ্রণম্য অগ্নি, আমায় পোড়াও’।
এ তো ব্যাপক মানুষের নিয়তি। কেবল কবিই টের পান অভিযোগ। অকালমৃত্যু হয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। অকালমৃত্যুই বলবো। কাগজে, সভায়, আকশবাণীতে হাজার বার করে বাজলেও বিশ্বাস হতে চায়নি। শুনেছিলাম কবিতা উত্তমর্ণ অধমর্ণ কোন প্রশ্ন ওঠে না। শুধু পূর্বসূরি হিসাবে জীবনানন্দের রক্তি ভূমিকা আছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট থেকে হাংরি ধর্মান্তরিত হয়েও কোথাও দীক্ষিত হতে পারেননি। স্থায়ী হতে চাননি, হয়তো সম্ভবও হয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাংরি জেনারেশনের অংশ গ্রহণ প্রসঙ্গে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন ১৯৬৩ –তে ‘এষনা’ পত্রিকায়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত হাংরি জেনারেশনের কোনো মুখপত্র নেই – বস্তুত হাংরি জেনারেশন একটা আইডিয়া – যার বিষয়ে শক্তি গ্রন্থ সমালোচনা করতে গিয়ে প্রথমে কিছু লেখে। শক্তি খুবই অন্যমনস্ক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাগুলি লেখেন। আমরা বন্ধুরা কেউ জানতাম না শক্তি এরকম ভাবছে, কিন্তু ঐ নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ... পাটনা থেকে মলয় রায়চৌধুরি নামক এক যুবক এটির নেতৃত্ব কিছুদিন করেন। সাথে ছিলেন – সুবিমল বসাক, সুবোধ আচার্য্য, ত্রিদিব মিত্র। কিন্তু হাংরি জেনারেশন এমন এক জিনিস যে কারো হাতেই নেতৃত্ব বেশিদিন থাকে না’।
সেদিক থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপর প্রভাব বলতে জীবনানন্দই ছিলেন। পঞ্চাশের কবিদের অতিক্রম করার মত এক জীবনানন্দ ছাড়া তেমন কোনো কবি ব্যক্তিত্বই ছিল না যা কবিতার রক্তমজ্জায় আক্রমণ করতে পেরেছিল। তখন অবশ্য আধুনিক বাংলা কবিতার সাম্রাজ্যের শাসনভার ছিল বুদ্ধদেব বসুর হাতে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য ‘পূর্বাশা’ বা ‘নিরুক্ত’ সম্পাদনা করেও সে শাসনভার পাননি। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার পর ‘কৃত্তিবাস’ বাংলা আধুনিক কবিতায় এক কবি সংহতি গড়ে তোলে। গোষ্ঠীর ক্ষমতায় অনেক বেশি ক্ষমতাবান এবং পরবর্তীতে এই ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠী এস্টাব্লিশমেন্টের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে কবিত্বের সহজাত অধিকারী। জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতা চিরপদার্থ’ বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন তাও ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অন্তরসত্তার অন্তর্গত। কবিতাকে তিনি একমাত্র অবলম্বন বলে স্বীকারোক্তি করেছেন, ‘আমার নিজের কাছে একাকীর কাছে, কবিতা অবলম্বন। নিজেকে নিজের মত করে দেখার চমৎকার জলজ দর্পণ এক’। কবিতা তাঁর আত্মজৈবনিক উচ্চারণ হয়ে গেছে প্রথম থেকেই। প্রকৃতি, নরনারী সম্পর্ক কিংবা ঈশ্বর চেতনা এসব নিয়ে কখনই তাঁকে আলোড়িত হতে হয়নি। জীবনের স্বতোৎসারিত ভাবনাই তাঁর কবিতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। এমন কী রাজনৈতিক ও সামাজিক কোন সমস্যাও নয়, কবির একাকী জলজ দর্পণের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে যখন যেমন মানচিত্র; যা কবি মনের রহস্য কুহকময় সব সময় তা মনননিষ্ঠ হয়ে ওঠে না; - 
“কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র।
তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস।
অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে
সমুদ্র সরে যাবে, শীতল সরে যাবে, মৃত্যু সরে যাবে।
তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে।
অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, অন্ধকার হবো।
আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে”।

বিষাদ নয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় মাঝে মাঝে আক্রান্ত হয়েছেন এক অসম্ভব হৃদয়ভারী বেদনাবোধে, পরবাসী আক্রান্ত অস্থিরতায়। এ তাঁর একাকিত্ব, নাকি কবির চিরন্তন দুঃখবোধ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বেদনা বোধ কখনই স্থায়ী হয়নি কিংবা তাঁর বেদনা বিষাদের রূপ নেয়নি। প্রকৃতির কাছে ছুটে গিয়ে অরণ্য, নদী, জল, ঝরণায় তাঁর আত্মার আরগ্যলাভ ঘটেছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্বভাবের মধ্যে ছিল স্বেচ্ছানির্বাচিত এক স্বেচ্ছাচারিতা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছিল এক পর্যটন মন, সবকিছুতেই ছিল মানিয়ে নেওয়ার মনোভঙ্গি তা কখনও জঙ্গলে বা বিদেশ বিভুঁয়ে, তবে তাঁর কবিতার শিকড়ে ছিল জননী জন্মভূমির মৃত্তিকা রসসম্পৃক্ততাই;
“এই বিদেশে সবই মানায় –
পা-চাপা প্যান্ট, জংলা জামা
ধোপদুরস্ত গলায় রুমাল, সঙ্গে থাকলে অশ্বত্থামা
এই বিদেশে সবই মানায়।
ব্রায়ার পাইপ, তীক্ষ্ণ জুতো
নাকের গোড়ায় কামড়ে – বসা কালো কাঁচে রোদের ছুতো
এই বিদেশে সবই মানায়”। (এই বিদেশে)

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থে ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্যে’ থেকে ‘ও চির প্রণম্য অগ্নি’ পর্যন্ত চলেছে জলজ দর্পণে প্রতিবিন্বিত নিরন্তর প্রবাহিত অনুভূতি, যেখানে সহজাত কবিত্বের বর্ণময় প্রকাশ, যে বর্ণ প্রকৃতির পরাগ মাখা কখনও কখনও তীব্র বনবন্ধী। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় নাগরিক জীবনের টেনশন সেভাবে নেই, যেভাবে অরণ্য প্রকৃতির মদির আকর্ষণ আছে কিংবা নিসর্গে আত্ম আবগাহন। 
“এবার জঙ্গলে সরাসরি নয়, পথ খুঁড়ে খুঁড়ে
দুপাশে জঙ্গল রেখে ক্রমাগত ছুটে দৌড়ে যাওয়া
জঙ্গলের মায়া মেখে, ছায়া মেখে উত্তরের দিকে
ক্রমাগত দৌড়ে যাওয়া, পিছনে বলেও যাওয়া নয়
শুধু যাওয়া, শুধু চলে যাওয়া”।
কিংবা
“গাছগুলো তুলে আনো, বাগানে বসাও
আমার দরকার শুধু গাছ দেখা
গাছ দেখে যাওয়া
গাছের সবুজটুকু শরীরে দরকার
আরোগ্যের  জন্যে ঐ সবুজের ভীষণ দরকার”।

মৃত্যুর পর সারা দেশ জাতীয় কবির মতোই দুর্লভ গৌরব দিল কবিকে। আরম্ভের দিন ছিল আরেকরকম। সে ছিল চাপা প্যান্টালুন, চোখরা-বখরা হাওয়াই জামা, হাওয়াই চপ্পলের, বিরোধী বিপরীত কৃষ্টি সাধনার, ক্ষুৎকাতর হাংরির, নৈরাজ্য বোহেমিয়ানা আর যথেচ্ছাচারের,অবিরল কলাহলের দিন। আত্মপ্রাবল্যময় ভাঁজ-ধরা, জট-ধরা লেখারও দিন। ‘এমনও দিন কেটেছে একটিমাত্র ভাষাকে উলোটপালোট করে’-

অথবা,
“পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ,
ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভিতর বাড়ি, পায়ের ভিতর পা,
বুকের ভিতর বুক”।
কিংবা
“আমি একটি সোনার মাছি মারিয়ে ফেলব রাত দুপুরে
স্বাদু ফলের চতুর্দিকে জালের তৈরি শক্ত বেড়ায়
বাদুড় তুমি একলা পড়ো”-
কিংবা,
‘ভাষার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে’…………

পোকায় কাটা কাগজপত্র দেখলে শব্দ মনে পড়ে কবির – ‘রূপসীর বগলের কনিফেরাসার মত মেঘ’, ‘চৌরঙ্গির দশ ফুট উঁচু দেয়ালের মতো পোস্টারে পোস্টারে ভরে’ গিয়েছেন কবি।
এ তো ‘ রবীন্দ্রনাথের হেলাফেলা সারা বেলা নয়’, ‘হৃদয়পুরের জটিলতার’, ভেতরে বসবাস, ‘প্রত্যেক কবির পাশে শোয়া’ আর হয়তো তারই ফলে কবি লিখছেন, ‘তোমার কবিতার ভিতর অমানুষিক পরিশ্রম’। অমানুষিক পরিশ্রমের স্থানে অবশ্য চোখে পড়ে সুছন্দ ছক একটুখানি, অনায়াস ভাষা বিন্যাস মুক্ত আর একটা পুনরাবৃত্ত রিফ্রেনের রোমাঞ্চ – সামান্য লক্ষণের মতো। ‘বাগানে কি ধরেছিল হাত / বাগানে কি ধরেছিল হাত’, ‘আজও আমি তেমিনই আনাড়ি / ‘আজও আমি তেমিনই আনাড়ি’ বা ‘কোনোদিন পাবে না আমারে / ‘কোনোদিন পাবে না আমারে’ – এই ভাবের অজস্র কবিতাশেষে স্তবকে স্তবকে বাজানো দ্বিরুক্তি, তারই ভেতর মায়া জমে ওঠে কোনোখানে ঃ ‘অবনী বাড়ি আছো, কিংবা ‘যেখানে সকলে বাঁধে ঘর / আলোতে ছায়াতে বসে / ভোগ করে নারী ও ঈশ্বর’। ‘প্রত্যেক কবির পাশে শোয়া’ও অনেকটাই এসেছে মিলের বা আবহের ঝোঁকে ঃ ‘লেভেল ক্রসিং, দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন / এখন তুমি পড়ছ কি হাট ক্রেন’ কিংবা ‘দুঃখের নিস্পৃহ তুমি বটফল নাকি? / কীটসের হাইপেরিঅন?’ কিংবা ‘প্লাতেরো আমারে ভালোবাসিয়াছে, আমি বাসিয়াছি / আমাদের দিনগুলি রাত্রি নয়, রাত্রি নয় দিন......’ এইশক্তি কবিতা লিখছেন নব্য দিনে যখন অ্যান্টিএসটাব্লিশমেন্ট আর মড বীটনিক রকার, রবিবাসরীয় সাহিত্য আর ইলেকট্রিক গিটারের মাদক হাওয়ায়। পান-রমনের খোলা আমন্ত্রণের ছাউনি ঢেলে বিকল্প কলাকৃষ্টির স্ফুর্তি। কবিতার একান্ত ঝোঁক যখন স্বভাবোক্তির দিকে, তাঁর “খুব বেশিদিন বাঁচব না আমি, বাঁচতে চাই না”র মতো প্রসিদ্ধ পঙতির নিচেও গুঞ্জন করে হীট মড গানঃ “Hope I die before I get cold.” 

তবু আস্তে আস্তে সব খুলে রেখে শক্তি কখন গলিয়ে নিয়েছেন আরেকটা সহজ দিশিয়ানা; ধুতি পরেন। শুনি বলছেন, ‘আমি একটু সহজ করে কথা বলব ভেবেছিলাম’, ক্রমে ক্রমে বলেছেন। এখানে বৃষ্টিপতনের মতো, পাথর ভেজানো হালকা স্রোতজলের মতো, ‘নীল একটা ছেলে ভুলানো ছড়ার’ও মতোঃ

মা হয়েছেন ফটিকজল, পিতা জোনাক পোকা”
কিংবা
“বাজারটা ঘুরে আসি
ছেলেবেলার বাঁশি
কিংবা জলছবি
কিনেই তো লুকোবি”।
কিংবা

“পাতার ফাঁকে উঠছে শামুক, শিকড় কাটে উঁই
আমার মতন একলা মানুষ দুখান হয়ে শুই”।

একলা মানুষ দুখান কেন, রুজু রুজু গেরস্থ সংসার হয়ে উঠেছেন ক্রমে ক্রমে লেখার ভেতরে। প্রথম বইয়ের সম্ভাব্যতা যেন ছাপা হয়েছিল। যেন অবিচ্ছেদ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এবার। সেই যে অন্ধকার ভাঁড়ারের নুন-মশলার পাত্রের মতো পচা ধান, শ্যাওলা, তেচোকো মাছের আঁশ গন্ধ, সেই মরা মাছ, কুঁচ, স্প, নালডাঁটা, মুচিডাব, সেই আমরুলের পুঞ্জ পুঞ্জ নীল অম্লতা – প্রকৃতি-গেরস্থালির এই মিলমিশের ভেতরেই যেন এবারে তাঁর সহজ নিজস্ব লেখা। সে লেখায় মিটমিটে জমিজিরেত চরণ দাসের গাই গরু, নজরালির তালপুকুর, চকদিঘির মুচ্ছুদি খলিল আর নেয়েপাড়ার কান্ত, আবার আদায় তসিল ধার-কর্জ, ইশকুল-পাঠশালা, ছাঁচতলা উঠোন, তরজা কবি, কাপ মায়ের ঝরাপাতার কথকতা সব আছে, আবার আছে খেয়াঘাট, ইস্টিশন, টকিহাউস, মিস্ত্রিরির কারখানা, কলকাতার ছন্নছাড়া গলি – সবের মাঝখান দিয়ে আগাগড়া একখানা গেঁয়ো পথই যেন ফুঁড়ে চলেছে এপার ওপার, আর কবি টের পেয়েছেন, ‘সাত গাঁয়ে আমিই এক চলার লোক, পথটাও কম নয় নিতান্ত’ – সে পথ “ সব দিকেই যাওয়া চলে কিন্তু পিছু ফেরার রাস্তা নেই, ফিরলেই চাবুক”, কবি বলেছেন, ‘যাবেই যদি ঘন ঘন / পিছন ফিরে তাকানো কেন?’ 
সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক কৌটিল্যমারির আঘাত শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সেভাবে আলোড়িত করে না, যেভাবে প্রকৃতির মধ্যে পুরনো চাঁদ তাঁর চেতনার জাগরণ ঘটায়, গ্রিস দেশে স্মৃতির ভেতরে জেগে ওঠার বেদনা অনুভব করেন।

“কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুৎ চমকে জাগিয়ে রেখেছিল
আমায় পুরানো চাঁদ
পল্লীদাস ক্ষণে ক্ষণে আমায় সেই স্বপ্ন ছায়াময় ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেছিল
এই তো গ্রিস দেশ, এখানে কেউ ঘুমায় না –
তখনই চাঁদ অস্পষ্ট কালো এক ঝিনুকের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো
আমার আর গ্রিস দেশ দেখা হলো না।
দেখা হলো না পল্লীদাসের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে
অসচরাচর গ্রিসের হাজার হাজার বছরের শৌখিন সমাধি স্তবক বাগানের ফুল”।

  পিছুটান ছেঁড়া এই যাওয়া যেন ত্রস্ত প্রেমিকের মতো, যেন সন্ন্যাসীর মতো। প্রেমিকের ‘লালচে’ আর সন্ন্যাসীর ‘পরিব্রিজ্যা’ দুই অভিজ্ঞানই তিনি বদলে বদলে দেখতে দিয়েছেন পাঠককে। আগুন লাগলে পোশাক যেভাবে ছাড়ে তেমনি ভাবে সব ছেড়ে যাওয়া, আবার ভালবাসার ভাঙাচোরা উত্থান-পতন মাড়িয়ে যাওয়া আরো পরে, আরো পরে। গেরো খুলে ছড়িয়ে যায় খিড়কি পুকুরের মতো সমুদ্র। টান লাগে অতিদূর জঙ্গলের। হাট, মেলা, খুঁটিমারি বাংলো ছাড়িয়ে এসে পড়ে হিংস্র বন। কিন্তু হিংস্র তো তেমন হিংস্র নয়। ভালোবাসার বন কি হিংস্র হয় ? সন্ন্যাসীর বনও কি হিংস্র হয় ? শক্তির ভালোবাসার বন হল ঢেউতোলা হেমন্তের অরণ্য, পর পর চিঠি বিলোবার পোস্টম্যান বেরিয়ে আসছে গাছের কোনা দিয়ে। হয়তো চিরকেলে ভালোবাসার বাঘ বেরোলে হঠাৎ। শিরীষে ফুল এসেছে, নাগকেশরের গন্ধ পাই, মাথার ওপরে ঠেলা দিয়ে উঠল টেরা চাঁদ, কবি বলেছেন,

“আকাশে চাঁদ শায়া শুকচ্ছে, কী নরম জ্যোচ্ছনা আলোয়
আমরা দু’জন ছড়িয়ে বসছি…”

আবার কবরের পর কবর পেরিয়ে পাতার করাতে ছিন্নভিন্ন চাঁদের সঙ্গে প্রব্রজ্যার জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জিরোতে বসেও দেখা সেই ‘সুন্দর আমার কাছে শুয়ে আছে মানুষের মতো’। হয়তো মানুষীরই মতো, হাট বাড়িয়ে আছে আসঙ্গ লিপ্সায়। কিন্তু যখন লেখেন –
“দু গণ্ডা লোক দু গণ্ডা পোক নেবু ঘাসের রসে
পটাক করে চুল্লু মারে বিসরগ-সন্ন্যাসে …”

মনে হয় এ তবে সঙ্ঘের সন্ন্যাস।

আসলে শক্তি পুরোপুরি সঙ্গলিপ্সু মানুষ, মুহূর্ত চারণ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েও ছোটো ছোটো গেরস্থালি চৌকোনার ভেতরে তাঁর তৃপ্তি। মানুষ ও প্রকৃতি দুয়েতেই তাঁর স্পৃহা। ‘আমি ভাঙায় গড়ায় মানুষ’ শক্তি লিখেছেনঃ ‘আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমায় ক্ষুধা আর প্রাণপণ গাছের শিকড়’, কিন্তু এখানেও সবই খায় তাঁর ভালবাসা – এঁটো পাতা, হেমন্তের খড়, সে রাবীন্দ্রিক,তাত্ত্বিক ও মনশ্চর কিছুই নন, তাঁর সন্ন্যাসী গুহাতেও তিনি টের পান ‘মানুষ লুকিয়ে থাকে ঘাস হয়ে মনের গভীরে’। ঘাস ও মানুষের এমন একটা অন্যোন্য তিনি গড়ে তোলেন যে মনে হয় অতি সাম্প্রতের চাপ। তিনি এড়িয়ে গেছেন, মানুষ প্রকৃতি মিলে এখন তাঁর মানুষ, এমন কি সামাজিক মানুষ; আবার প্রকৃতি-মানুষ মিলে এখন তাঁর প্রকৃতি, এমন কি অরণ্য প্রকৃতি। যখন তিনি লেখেন, ‘বৃষ্টি হলে মনে হয় আমি ঐ বৃষ্টির জলের সঙ্গে ঢুকে মিশে যাব পড়ে থাকা ভুবনে, মাটিতে’, কিংবা ‘যেন আমি মাটি, যেন পোড়ো ঘর, পুকুরেরপাঁক’, মনে হয় সর্বাত্ম প্রকৃতিরই কবি তিনি। আগের দিনের কবিরা যেমন, আবার দেশ প্রকৃতির কবিও তিনি। স্বদেশ প্রকৃতিরও। প্রকৃতি গ্রাম আর কথ্য গ্রামীণের মধ্যে যে মিশেল পড়েছিল নব্য রীতি আর কাউন্টার কৃষ্টির সে তাঁকে যেন আত্মহারা করেনি হয়তো আরেকটা ধরন দিয়েছে বয়ানে বিন্যাসে, সেই বাঁকটুকু বদলে যেতেই শক্তি লিখেছেনঃ ‘চলো গিয়ে দেখে আসি দেশ আমার, দেশ আমার মা’। লিখেছেনঃ ‘জন্মভূমি কথাটার মধ্যে এক আশ্চর্য মাদুর বিছানো আছে’। আবার লিখেছেন, ‘আরে বাপু আমি যে ওইটুকুর জন্যেই ব্যাকুল’। সত্যি তাই? ব্যক্ত করে বলতে দেখি তাঁকে তিনি দেশপ্রেমী,রাজনীতিবিদ নন। ‘সভায় যে কাঁদে, সে সংসদে / মানুষের শুভ পন্য বিক্রি করে দেশবন্ধু সাজে’, সেও নন তিনি। তিনি খালি ‘গন্ডগ্রামে ঘুরে / চাষিদের, হরিণের ঘাস খাওয়া এবং না খাওয়া’ অনেক দেখেছেন, তিনি দেখেছেন দুটো ইট পেতে খেলাচ্ছলে নিরন্নের বনভোজন,

“কিছু পাতা-পুতো কালো তিজেলে ফুটছে ভাত
জোর বরাত, আমাদের ঘরে রোদ্দুর এসেছে
ভাতের গন্ধে পেটে ভোঁচকানি লাগে”।
এই দেশখন্ডের সঙ্গে এমনি একাত্মা হয়েছেন বলে যেন সহজে লিখতে পেরেছেনঃ-

“ছাতা নেই, ভাত নেই – কোন কাম পাথরে, মোচ্ছবে তোমাদের ?” 
এ তো প্রতিবাদী অসামাজিকের নয়, সপাট বক্তব্যের লেখা, কথ্য গ্রামীণের শব্দ কটি ছাড়া কোন তির্যক বা অস্বচ্ছতাও নেই বয়ানে, কিন্তু এমনি অপরোক্ষ ভালোবাসায় লিখতে পেরেছেন যিনি দেশকে, দেশ তাঁকে আপন কবির ভালবাসা দেবে, সে আর বেশি কী ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রকৃতি আদিম প্রেরণার মত, কবিতার মেদ মজ্জায় প্রোথিত হয়ে আছে। আদি কবির মত নিসর্গ প্রকৃতির কাছে প্রার্থী হয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ভীষণ পর্যটনময়; তাই উত্তর বাংলার অরণ্য প্রকৃতির কাছে বার বার তিনি ছুটে গেছেন, অনেক কবিতার উৎস স্থল এই অরণ্য, নদী, উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল। লোথার লুৎসের কাছে এক অনুষঙ্গ প্রসঙ্গে ‘ফুটবল’ কবিতাটি প্রসূতি পরিবেশ সম্পর্কে জানাচ্ছেন ভুটান গিরিমালা ও জয়ন্তী নদীর সান্নিধ্যে। নিসর্গ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার আদি উৎস এবং পৃথিবীর আদিম কবিত্বের মতন অবিনাশী। যে উত্তরবঙ্গের অরণ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বরের ঘর গড়ার সন্ধান পান ডুয়ার্সের জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যে কবি তাঁর হৃদয়ের সাত মহলের সন্ধান পান। পরাবাস্তব কবিতায় জঙ্গল এসে যায়। 

“বৃষ্টিতে ডুয়ার্স খুবই পর্যটনময়।
মেহগনি-বীথি পার হলে পাবে দোতলা বাংলোটি
কাঁটাতার বেড়া ঘেরা সবুজ চাদরে ঘাস বড়ো উচ্ছৃঙ্খল
এখন এখানে।
…………
জঙ্গলের মধ্যে ঘর ঈশ্বর গড়েন”।

স্বেচ্ছাচারীর মতন শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঘুরেছেন; বন, পাহাড়, নদীর তল্লাস নিয়ে ফিরেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতন ব্যাপক ভ্রমণ বাঙালির কম কবিই করেছেন, শোনা যায় একসময় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘টুরিস্ট গাইড’ লিখেছেন। শুধু প্রকৃতির মধ্যে নয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও মাঝে মাঝে ঢুকে যেতে চেয়েছেন এক ধ্বংসের ভেতর, যে ধ্বংস সভ্যতা বহন করছে। যার বাসিন্দা হয়ে ব্যর্থ, ভাগ্যহত আরেক ক্লাউন –এর সন্ধান পান কবি; 

“মাঝে মাঝে স্পষ্ট কোন ধ্বংসের ভিতরে আমি ঢুকে যেতে চাই
যেখানে নিষিদ্ধ যাওয়া, সেখানে সার্কাসে ব্যর্থ, ভাগ্যহত আরেক ক্লাউন
দর্শক কীভাবে বসে ? খেলা দ্যাখে, বগল বাজায় ? মাঝে মাঝে –
এতো স্পষ্ট, রোদ্দুরে পুড়ন্ত তামা, ছেঁড়া জামা, কুহকে পথিক
যেভাবে বিচিত্রগামী, যাই আমি ধ্বংসের ভিতরে ঢুকে, মুখোমুখি
দাঁড়াই জীবনে, চোখ মারি, আয়নার স্পর্ধাকে কবি কাঁধ ঝোঁকে কুর্নিশ এবং
নিজের পেন্টুলে মুতি অস্তি নিরস্তিত্ব কম্পমান
ঘরের বাইরে রোদ মিছিমিছি দ্রুত পায়ে হাঁটে”।
কবিতার ভুবন, কবিতার শব্দ এবং কবিতার দর্শন কোথাও কোন সেতুবন্ধন নেই, শুধু সম্পর্ক উত্তরসূরি, পূর্বসূরির।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমৃত্যু প্রকৃতির কবি, সময় কিংবা সময় সংক্রান্তির চেতনা তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত। শুধু প্রকৃতি তাঁকে আকর্ষণ করেছে এবং কখনও কখনও পরাবাস্তববাদী কবির মতই সেই প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন, ‘জঙ্গলে সবার জন্যে অকৃপণ নিয়ন্ত্রণ আছে’। এমন পঙক্তি তাঁর কবিতাতেই পাওয়া যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে মানসচিত্র।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সার্থকতা বা ব্যর্থতার কবি নন, তিনি তাঁর নিজস্ব চমৎকার জলজ দর্পণটি আবিষ্কার করে শুধু আত্মমগ্ন হয়ে দেখেছেন নিরন্তর তাঁর মনের ছবিকে, যা তাঁর কবিসত্তার আদিম আলো অন্ধকারে ঢাকা ছিল। সহজাত কবি প্রতিভার মহৎ অধিকারী।
কেউ কেউ বলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবনানন্দমুখীদের মধ্যে সার্থকতম কবি। রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ যেমন, জীবনানন্দও তেমনি শক্তির চেতনার মধ্যে নিরুচ্চারে প্রবাহিত। এটাই তো স্বাভাবিক; এই চেতনার ধারা স্বকালের জীবন প্রবাহে অন্য বাঁকে মোড় নেবে; যে এই বাঁকে ঠিক নিজের নৌকো নিয়ে পাড়ি দিতে পারে, সে কবিই কবিতায় নতুন সকাল এনে দিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ তো বটেই, আরও অতীতের মননে সমৃদ্ধ না হয়ে বর্তমানের চেতনার মর্মমূলকে কেউ আবিষ্কার করতে পারেন না। যাঁরা হঠাৎ নতুন বাঁক নেওয়ার চমক দিতে চান তাঁরা কৃত্রিমতায়, প্রচ্ছন্নতায়, আত্মম্ভরিতায় কিছু লেখেন, নতুনভাবে সবাক হয়ে যান অবিরলধারায় কিন্তু পাঠক কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। শক্তি ভেঙেছেন, গড়েছেন, শক্তি অকপট অকৃত্রিম থেকেও স্বতন্ত্র থেকে গেছেন।

“ আমি যাকে ভালোবাসি সে অন্তত আমাকে গোপনে মেরেছে সহস্রবার
কিন্তু আমি মরিনি একাকী
দৃশ্যত নিস্তব্ধ হয়ে, তাকেও মুখর করে রাখি
ক্রন্দনে, মরিনি বলে তাকেও মুখর করে রাখি”।
(আমি যাকে ভালোবাসি)

কোথায় কীভাবে এ স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পেয়েছে, কীভাবে ওঁর কবিতা একটা নতুন বাঁক নীল, ওঁর কবিতার প্রসাদগুণ কোথায়, এ সব নিয়ে বিশদ আলোচনা চলবে। চলতেই থাকবে।

“মানুষের কাছে এক শর্তে আমি বন্দী – আমি বন্দী!”
(পথ তোমার জন্যে)

তথ্যসূত্র –
১) ‘শক্তি সঙ্গ’- অরণি বসু। (পরবাস – ১৪০৬)
২) কবিপত্নি মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার – পারমিতা দাস। (১৪০৬ – পরবাস, তৃতীয় বর্ষ, তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা)
৩) ‘শক্তির কাছাকাছি’ – সংকলন ও সম্পাদনা – সমরজিৎ ও ইনা সেনগুপ্ত।
৪) ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ – সমীর সেনগুপ্ত (জীবনীকার)।
৫) ‘হাংরি জেনারেশন ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ‘এষণা’, ১৯৬৩।
৬) ‘হাংরি কিংবদন্তী’ – মলয় রায়চৌধুরী।
৭) স্মৃতিচারণা – অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।
৮) ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ – দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ময়ূখ’, জুলাই ১৯৯৫, (দ্বিতিয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)
৯) “দুই মেরুর দুই কবি – জীবনানন্দ দাশ ও শক্তি ছত্তপাধ্যা” – সুব্রত রাহা, ‘ময়ূখ’, জুলাই ১৯৯৫, (দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments