জ্বলদর্চি

আবুল বাশার /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল হয়েছে তার। বিষয়— আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)

বাংলা গল্পের পালাবদল—১৯  

আবুল বাশার

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


 
রাজশাহী-মুর্শিদাবাদের মাটি ও মানুষ, তার আজান-ধ্বনি, আয়েত-বয়েত আবুল বাশার (জন্ম-১৯৫১)-এর গল্পের প্রধান বিষয়। পরবর্তীকালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার গ্রামীণ আবহ নিয়েও গল্প লিখেছেন প্রচুর। শহর-জীবনও ব্রাত্য নয় তাঁর লেখায়। এরই সঙ্গে আরব-দুনিয়ার লোককথা ইত্যাদিও অনায়াসে উঠে এসেছে গল্পে। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের, বিশেষত গ্রামীণ মুসলমানদের চিন্তা-ভাবনা, জীবন চর্যা ও জীবনবোধ তাঁর গল্পের প্রধান উপজীব্য।

আবুল বাশারের শৈশব-কৈশোর কেটেছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। লালবাগ মহকুমার নতুন হাসানপুর গ্রামে জন্ম তাঁর। সেখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে টেকরায়পুরে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন মাত্র ছ-বছর বয়সে। তাঁর জন্মগ্রাম এবং বসতগ্রাম ছিল তিনটে নদী দিয়ে ঘেরা। গোমোহিনী, ভৈরব এবং ছোটোনদী। নদী-তীরের মানুষের দুঃসহ জীবন-যন্ত্রণার ছবি মূর্ত হয়ে আছে তাঁর প্রথম গল্প ‘মাটি ছেড়ে যায়’-এ। এই গল্পে একটি পরিবারকে নদী শুধু ঘর ছাড়া করেনি, তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। ভালোবাসার সন্তান। ভবিষ্যৎ। শরীরটাকেও। ছোটোবেলা থেকে তিনি দ্যাখেছিলেন মানুষের জীবনের উপর অমোঘ প্রভাব নদীর। মানুষ নয়, নদীই বলছে শেষ কথা। নদীর সঙ্গে দারিদ্র্যও। জমি কেনার সামর্থ্য থাকলে অন্য কোথাও অন্য কোনও গ্রামে জমি কিনে বসত গড়তে পারত নদীসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষজন। নদীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যেতে পারত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের তো সেই সামর্থ্য নেই। তাই কালের হাতেই সঁপে দিতে হয় নিজেদের। নদীই হল সেই কাল—মহাকাল। সবাই তার ক্রীড়নক মাত্র। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থের নামও ‘মাটি ছেড়ে যায়’। 

শৈশব-কৈশোরে লেখকের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হয়েছে লেখককে। ছাত্রাবস্থা থেকেই কবিতা লিখতেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রত্ন তথা, প্রথম কাব্য ‘জড় উপড়ানো ডাল-পালা-ভাঙা এক ঋতু’। এই কাব্যগ্রন্থের কল্যাণে স্টাইপেন্ড পান কলেজে। টিউশন ফিজও মুকুব হয়ে যায়। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। কৃষক আন্দোলনের শরিক ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রকাশ করতে পারছিলেন না। তারপর বিশ শতকের আশির বছরগুলি থেকে তিনি নিয়মিত গল্প লিখতে শুরু করলেন। লেখকের রাজনৈতিক ভাবনার ফসল ‘অগ্নিবলাকা’ উপন্যাস। 

আবুল বাশারের লেখক জীবনের শুরুতে অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর অবদান ছিল অপরিসীম। ‘রৌরব’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘চোর’ গল্পটি ‘শিলাদিত্য’ পত্রিকায় রিপ্রিন্ট করে বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন সুধীরবাবু। তাঁর মাধ্যমেই কলকাতার বড়ো কাগজগুলিতে বাশারের লেখা ছাপা হত। তাঁর উৎসাহেই লিখেছিলেন প্রথম উপন্যাস ‘ফুলবউ’ (১৯৮৭)। ‘ফুলবউ’ প্রকাশের পরে গ্রামে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। গোঁড়া মুসলমানেরা প্রবল বিরোধিতা করে তাঁর। বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় এলেন তিনি। এই ব্যাপারে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

বহু উপজীবিকা নিয়ে গল্প লিখেছেন তিনি। সেই উপজীবিকাগুলি একটা সময়কে চিনিয়ে দেয়, একটি অঞ্চলকে চিনিয়ে দেয়। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই নায়িকাপ্রধান। এই উপজীবিকা-নির্ভর বহু গল্পেতেও প্রাধান্য পেয়েছেন নারীরা। যেমন তাঁর ‘কান্নার কল’। গল্পটিতে অদ্ভুত একটি উপজীবীকার কথা বলেছেন। সেই পেশাটি হল কান্না। কারো মৃত্যু হলে শুধু পেট-ভাতায় সেখানে গিয়ে কেঁদে আসে সতী। মুসলমানদের সম্বন্ধ ডালে-পালায় পাতায়-লতায় শেকড়-বাকলে। খুঁজে বার করতে পারলে সকলেই নিকটজন জ্ঞাতি-গুষ্টি। হিন্দুরা সব একা একা। খুব খাটো করে সম্বন্ধ চায়। আর মুসলমানেরা অমুকের অমুককে গুরুত্ব দেয়। আর তাই তখন ওরে আমার ভাইজান গো, বাপ গো, ফুফা গো, মামু গো বলে কাঁদা যায়। মানুষ একলা কাঁদতে পারে না। তাই দরকার হয় সতীর। 

জন্ম-অভাগী এই সতীর চোখের পেছনে একটা অদৃশ্য জলাশয় স্থাপন করেছেন আল্লাতালা। অন্যের জন্য কাঁদবার অনায়াস দক্ষতা তার। গতবার মুন্সীবাড়ি কাঁদতে গিয়ে আলম মুন্সীর কাছে নাম পেয়েছিল ‘কান্নার কল’। এ-নামে অপমানিত বোধ করেছিল সে। সেবার মুন্সীর বউকে সেই তো বাঁচিয়েছিল। সতীর চোখের কান্নার পানি আর গলার সহসা বেগ ধরা কান্নার আছাড়ি পিছাড়ি দেখেই না কেঁদে উঠতে পেরেছিল মুন্সীবউ। নাহলে শোকের চাপে দম আটকে মরে যেত! 

ছোটোবেলায় মা-বাপকে হারিয়ে নানির কাছে মানুষ হয়েছিল সতী। নানি মরে যাওয়ার পর থেকে সেই কাঁদতে শিখল। প্লুতসুরে টেনে টেনে মাঝরাত্তিরে কেঁদে ওঠা একাকী নিশুতির পর্দায়। একটা স্বভাব তৈরি হল তার। সকলে জানল। এইভাবে কেঁদে ব্যাড়াতে ব্যাড়াতে কান্নাকেই করল জীবন-অস্তিত্বের আশ্রয়। আশেপাশের পাঁচটা গ্রামের মানুষ জানল। 

সতী দেখেছে কান্নার মূল ধারা দুটি। কান্না না-হওয়া কান্না ; আর বে-আগল কান্না হয়ে যাওয়া কান্না। একটা হতে পারছে না, গলতে পারছে না, জমাট-বাঁধা আটক কান্না। আর অন্যটি বাঁধ-না-মানা আকুল ঢালু ফোয়ারা। “তার হাজার এক কান্নার বয়ান মুখস্থ আছে, উন্নাসিক নানান স্বর আয়ত্ত আছে, চণ্ডরোখ আর মায়া আছে ভাষার মীড়ে মীড়ে। যথা—সাধের স্বাদ, পরানের পরান, জানের জান, চোখের তারা, কলিজার টুকরো, নয়নের পুতলি, বেহেস্তের মোয়া, নাড়ির ধন, কবরের কাফন, পুলসেরাতের বুরবাক আদরের ভাইজান আবু রে! তুই কুতায় গেলি রে!” 

এই কান্নার ঠিকেদারি নিয়েই সে গিয়েছিল লগড়াজল। ভোরবেলা সেখান থেকে ফেরার পথে কাকের ডাক শোনে। অর্থাৎ কোথাও মরেছে কেউ। এর মধ্যে দ্যাখে গরুর গাড়ি করে রাঙাবুবু চলেছে বাপের বাড়ি। সতীকে সে তুলে নেয় গাড়িতে। বড়োলোকেরা কাঁদতে পারে না। বড়োলোক রাঙাবুবু সতীকে নতুন জামা দেয় তার ছেলের জন্য। ছোটো ছেলে চুন্নুকে লোকের কাছে রেখে ভিন্‌-গাঁয়ে কাঁদতে গিয়েছিল সে। রাঙাবুবুর বোন নাদিরার জান কবজ হল তারা আসার পর। আগেই উঠেছিল নাভিশ্বাস। রাঙাবুবুর বর বান মেরেছে তাকে। বুবু তাকে আগেই বলেছে ভালো করে কাঁদতে। ভ্রাম্যমান কান্না কাঁদতে পারছিল না আর সতী। সে চেয়েছিল এমন মৃত্যু যা দীর্ঘতমকাল শোকের আঘাত পায়। সতীর কান্না যার কাছে জরুরি মনে হয়। বিনিময়ে খেতে পরতে দেয়। সে চেয়েছিল সুন্দরী নাদিরার মৃত্যু হোক অপঘাতে। রাঙাবুবুর মনে দুঃখ-জাগানিয়া একটা ক্ষতস্থান থাকুক। সতীর মনে হয় তার কান্নার শাপেই মৃত্যু হল নাদিরার। 

কান্না শুরু করল সে। নিজেকে আছাড়ি-পিছাড়ি করল। বুক চাপড়াল। তারপর সে যেন নিঃস্ব হয় গেল। গলা বসে গেল। বোবা হয়ে গেল সে। কিছুতেই কাঁদতে পারে না! পরে খাওয়ার সময় রাঙাবুবু তার পাশে বসে চাপাসুরে বলে— “অত হাপুস-হুপুস খাচ্ছিস কেন সতী, নিঃসাড়ে খা। লোকে কী ভাববে, তুই আমার ভাড়া-করা লোক। তা যতটুকুন কাঁদলি, তাতে অমন ক’রে হাপ্‌সে পান্তাগেলা ঠিক নয় সতী।...তোর মায়া-দয়া নেই চুন্নুর মা? তোর রহম নেই ? এমন ক’রে মেপে মেপে কাঁদিস তুই? আগে জানলে তোকে সঙ্গে নিতাম না!...”

আর খেতে পারে না সতী। লাশ ধোয়ানো হয় জল-সাবান দিয়ে। সেই লাশের করুণ চোখ ছুঁয়েও বুকে জোর পেল না সতী। এক ফোঁটা কাঁদতে পারল না। মনে পড়ল আসার সময় দেখেছে কুপক্ষীটা তার বাড়ির চালে বসেছিল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। বিদায় নেওয়ার সময় দেখল রাঙাবুবু স্বামীর সঙ্গে হাসাহাসি করছে কী নিয়ে। আর দ্যাখা করে না সে। রাতে গ্রামে ঢুকে চোখে পড়ে পার্টি অফিসের ছাদে জনসমাগম। কে এক নেতা খুন হয়েছে, তারই শোকসভা। 

বাড়িতে এসে দেখল চুন্নু এন্তেকাল করেছে! পথশ্রান্ত সতী বুঝতে পারে— “কান্না একধারা দৈবশক্তি। যা দেহ থেকে নিঙড়ে বার হয়ে গেছে। দেহ না কাঁদতে পারলে চোখ কাঁদে না।” সন্তানের কাফনের জন্য সে যায় পার্টি অফিসের মৌনীসভায়। শুকনো গলায় ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাফন কেনার টাকাও জোগাড় হয়। কিন্তু ছেলের জন্য কাঁদতে পারে না আর। একজন বুড়ো বলল— “কাঁদ্‌ মা, কাঁদ্‌! পরের জন্যি এত কাঁদিস, নিজের জন্যি চোখে পানি নাই তোর ?” 

রাতে একলা শোয় সতী। হঠাৎ সে লক্ষ করে তার তলপেট আশ্চর্য রকম কাঁদছে। চুন্নুর জন্যই কাঁদছে। তার দেহে জমজমে কান্নার পানি ফিরে এসেছে। এরপর থেকে সতী কাঁদে তামাম নিশিকাল। চুন্নু আর নাদিরার জন্য। 

গল্পের নাম ‘কান্নার কল’ হলেও সতী কল নয়, যন্ত্র নয়। তার কান্না উঠে আসে হৃদয়ের গভীর থেকে। সে যন্ত্র হতে চায়নি। কিন্তু কাঁদতে চেয়েছিল। বাঁচার জন্য কাঁদতে চেয়েছিল। দারিদ্র্যের জন্য কাঁদতে হয়েছিল। সন্তানকে বাঁচানোর জন্য কাঁদতে চেয়েছিল হতভাগী। সন্তান বাঁচল না। কিন্তু সেই কান্নাই চিরসঙ্গী হল তার! সতীর নিঃসঙ্গযাপনে একমাত্র অবলম্বন এহেন কান্ন।   

জীবনের সব স্বাদ নিয়েও দূর থেকে জীবনকে দ্যাখেন লেখক। তাঁর অধিকাংশ চরিত্ররা বড়ো নিঃসঙ্গ। এক মহার্ঘ বিষণ্ণতা ছুঁয়ে থাকে তাদের। ‘অগ্নিবলাকা’ উপন্যাসের রাহুলের বাবা রাহুলকে বলেছিলেন— “কেউ তোমার আসল নয়, তুমি একা। একজন মুসাফির। সতীও যেন তাই। শিল্পীর একাকিত্ব চারিয়ে গিয়েছে তার মধ্যে।    

ধর্ম আর রাজনীতিকে যখন অধিকাংশ লেখক এড়িয়ে চলেন, তখন আবুল বাশার বারবার তাঁর লেখায় এই দুটি আপাত স্পর্শকাতর বিষয়কে তুলে ধরেন। তিনি সেফ জোনে থাকেন না বলেই তাঁর লেখায় গোটা সমাজের বাস্তব স্বরূপটা উঠে আসে। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন— “ধর্ম আর রাজনীতিই তো জীবন।...সাহিত্য সবসময় কন্ট্রাডিকশন অফ লাইফ। ইনার কন্ট্রাডিকশন অফ লাইফ। মানুষের মনোজাগতিক, মনের অন্তঃস্থলে, হৃদয়ের খুব গভীরে যে দ্বন্দ্ব-জটিলতা, সেটাই কিন্তু আত্মপ্রকাশ করে গল্প উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে তো হবে না। আমাদের জীবনে প্রেম নিয়ে কতটুকু সমস্যা হয় ? প্রেমের মধ্যে যখন রাজনীতি এসে ঢোকে, তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়।” (‘বইয়ের দেশ’, মার্চ ২০১৯) 

সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় মানুষের সামাজিক জীবনবোধ। রাজনীতি এবং ধর্মবোধও। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি-বিভেদের বয়ানও বদলে যায়। বাশারের ‘নিশি-কাজল’ গল্পে এসেছে সেই বদলের প্রসঙ্গ। লাল পার্টির কিশোর নেতা মহিম এবং তার পিসি দুজন দুটি ভিন্ন সময়ের প্রতিনিধি। বিদুষী পিসি দুটি সময়ের হাবভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। 

দলুইডাঙা, কাঁকুরগাছি, বাজিতপুর, মেথিডাঙ্গা, নস্করপুর ফুঁসছে এখন। কোর্টে কোরান তুলে দেওয়ার মামলা, কোরানের বাকারা সুরার মধ্যে গো-হত্যা বিদ্বেষ আবিষ্কারের মোহন্তীয় ব্যাখ্যা, সাবানের মধ্যে শূকর ও গোরুর চর্বি, দেওয়ালে দেওয়ালে ত্রিশূল এসব নিয়ে আলোচনা। এগুলিই পীড়িত করে মহিমকে। বিশ বছর আগে উক্ত অঞ্চলে দাঙ্গা হয়েছিল। সেই দাঙ্গার কথা শুনেছে সে পিসি সারদার কাছে। সেই দাঙ্গার চরিত্র ছিল সোজা। লোকগুলিকে চেনা যেত ধুতি ও দাড়িতে, লুঙ্গি আর টিকি পৈতেয়। দাঙ্গার একটা প্রত্যক্ষ কারণও ছিল ; পিসি বলেছে সে কথা— “ভগবান ঈদ আর দোলকে একই দিনে টেনে আনলেন কেন, মানুষের ধর্মবুদ্ধিতে তার বিচার ছিল না। মানুষের ধর্ম ভালো। ধর্মবুদ্ধি খারাপ।”

এই ধর্মবুদ্ধি দিয়েই একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাচ্ছে। পুলিশ এসে বন্ধ করে দেয় আজান দেওয়া। তা মুসলমানদের কতটা আহত করে তা বোঝা যায় ইমাম খতিবের কথায়— “আমরা মুসলমানরা সংখ্যায় কম, এতগুলো গাঁয়ে একটাই বড় মসজিদ, তার আজান যদি বন্ধ হয়, কোথায় গিয়ে আঘাতটা লাগে, মহিম তুমি ভেবে দ্যাখো বাবা!”

আজান দিলে হিন্দুদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়, শেহরীর সময় মাইকে জোরদার যারা তাদের ডাকাডাকি করা হয় বলে হিন্দুরা তেতে উঠেছে। অথচ মহিমের দাদু, সারদার বাবা খুব মনোযোগ দিয়ে আজান শুনতেন। আজানের সময় বাচ্চারা গোলমাল করলে বিরক্ত হতেন। তিনি বলতেন— “সুরটা শুনে মনটা যে কোথায় চলে যায়! সুরের তো জাত  নাই হে! আমি সুরটা শুনছি আর কথাগুলো তো ভগবানের নামগান হচ্ছে, আজান কি আমার জাত মারতে পারে!” সে আমলে তাঁর মতো হিন্দুরা মুসলমানদের সব দিক থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তখন মুসলমান ছেলেরা হঠাৎ হঠাৎ দাড়ি রেখে কলিদার জামা আর কিস্তি টুপি পরে মুসলমান হয়ে যেত। তাতে ভয় পেত না হিন্দুরা। 

এতদিন পরে মহিমের কাছে এসে ইমাম সারদার সঙ্গে সেই দিনগুলির স্মৃতি চারণ করেন। এখন সময় বদলেছে। মুসলমান ছেলেরা বেশি বেশি করে মুসলমান হচ্ছে বাঁচার তাগিদে। এখন মসজিদে মাঝরাত পর্যন্ত মুসল্লির ভিড় জমছে। আগে এতজন  আসত না  নামাজ পড়তে। হিন্দুরাও ধর্মসভার আয়োজন করছে। আসলে শঙ্কা থেকে একত্রিত হচ্ছে মানুষ। আর এই একতার কাজটা করছে  ধর্ম। ধর্মকে কেন্দ্র করে শক্তি সঞ্চয়। 

ইমাম চেয়েছিলেন পার্টি হস্তক্ষেপ করুক। কিন্তু বাস্তবে দ্যাখা যায় পার্টি প্রকারান্তরে দাঙ্গাকে উসকে দেয়। রাতের অন্ধকারে পরস্পর বিরোধী পোস্টার ফ্যালে পার্টির ছেলেরা। সেই পোস্টার পড়তে পড়তে মহিম দ্যাখে— সুবিধাবাদী মারাত্মক চাতুরি! হিন্দুকে খুশি করে, মুসলমানকে খুশি করে তারা। ভোট আসে, ভোট যায়। জীবন বদলায় না। 

সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে মহিম দ্যাখে পিসি তুলসীতলায় সাঁঝ প্রদীপ দেয়নি। কারণ জানতে চাইলে পিসি বলে, ‘আজান হোক, তবে তো!’ আজান হবে না শুনে প্রদীপ জ্বালতে যায় পিসি। প্রদীপে দিয়াশলাইয়ের কাঠি ছোঁয়ানোর আগে বলে— “জীবনের অভ্যাস কী অদ্ভুত দ্যাখ্‌। ভুল হয়ে যাচ্ছে রে। আজান পড়বে, প্রদীপ ছোঁয়াব। তাই না ? ভুল  তো হবেই। ছন্দটা যে হারিয়ে যাচ্ছে রে। বড় পুরনো নিয়ম। আজান পড়বে। জল ছল হবে, প্রদীপ ছোঁয়াব। সুরটা যে কেটে গেল বাছা! মনের মধ্যে আজান বাজবে, মন তখন বলবে, আলো দাও— বলতে বলতে পিসির প্রদীপ জ্বলল।”  

বাশারের বহু গল্পে এরকম একটা সুর ধ্বনিত। ধর্মীয় অনুষঙ্গের গল্প। কিন্তু লেখক শেষ পর্যন্ত একটা ধর্মসমন্বয়ের জায়গায় নিয়ে গেছেন গল্পটিকে। একটা উত্তরণের জায়গায় গিয়েছেন। লেখকের অন্যন্যতা এখানেই। 

আবুল বাশারের গল্পে আরব মরুর লোককল্প, আরবি উপকথা ঘুরে ফিরে আসে। ছোটোবেলায় দাদি-নানির মুখে এবং গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তির কাছ থেকে এই গল্পগুলি শুনতেন লেখক। আরবি লোককথাগুলো যেখানে ইসলাম গিয়েছে, সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই লোককথাগুলির সঙ্গে ধর্মের উচ্চ চিন্তা যুক্ত রয়েছে। তাঁর বহু গল্পের জমি তৈরি হয় এই উপকথাকে ঘিরে। আরবের প্রতিটি ধূলিকণায় জড়িয়ে আছে লোককথা। তার সঙ্গে ধর্মের যোগ আছে। বাশার তাঁর গল্পে লোককথাগুলির পুনর্গঠন করেছেন। তার সঙ্গে মিশিয়েছেন ইতিহাসকে। ‘রুকু দেওয়ান’ গল্পে এসেছে এরকমই একটি আরবি উপকথার প্রসঙ্গ। গল্পের প্রধান কাহিনির সঙ্গে বাশার চমৎকারভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন এই উপকথাকে।

মসজিদ পাড়ার বালিকা ছিল রুকু। অন্ধ সে। এই পাড়ার মানুষদের জীবনের তিন ভাগ দারিদ্র আর একভাগ ধর্ম। কিন্তু সেই একভাগ ধর্মের দাপট কম ছিল না। রোজা-নমাজ-ফিতরা-জামাত-মহরম-আকিকাহ্‌-তসবিহ্‌-সুন্নাহ্‌-হারাম-হালাল-কলমা-সুর্মা-নুর-ফরিস্তা-জাকাত-জুমার্না-হুরি-হুসনা-কেয়ামত-কোর্মা-শিরনি-খোর্মা-মক্কা-মদিনা-মুর্দা-হাসর-গোর-দোয়া-দরুদ-জন্নত-জহন্নম-তল্লাহ-নিকাহ্‌-জানেজা-সজদা ছাড়া কথা ছিল না। মাঝে মাঝে এখানে তালাক হয়। হঠাৎ করে দুয়েকটি কচি বালিকা উধাও হয়ে যায়।

এহেন অঞ্চলের সুন্দরী অন্ধ মেয়ে রুকুর সঙ্গে শাদি হল জুম্মার। জুম্মা তাকে মাসখানেক ভোগ করে তালাক দিয়ে বিক্রি করল দাস পাড়ার ধনাইকে। ধনাই গোরুর ব্যাপারী এবং বেপাড়ার দালাল। গোরু আর মেয়ে সমান তার কাছে। নিকাহ করে দুমাস রেখে রুকুকে ধনাই দিল বদরুহ্‌ কেওড়ার হাতে। সে কলকাতায় চালান করল রুকুকে। বদরুহ্‌ খাসি মাংস ভাত খাওয়ালো আটষট্টির দুর্ভিক্ষে। খাসি মাংসের পাটায় ভোগ করে নিয়ে এল সোনাগাছিতে। খাসির মাংস আর রুকুর মাংসের মধ্যে ভেদ নেই যেন। রুকু মানুষ নয়। মাল। মালের মতো হাত ঘুরে ঘুরে বিক্রি হল। নিজের কোনও মতামত নেই, অস্তিত্ব নেই। কারণ সে যে মেয়ে! 

মসজিদ পাড়ার রুকু হল সোনাগাছির রুক্মিণী দাসী। তারকনাথ নাহার রাতের রক্ষিতা— তার ঔরসে জন্ম নেয় পুটু। রুক্মিণী হয়েও রুকু নিয়মিত নামাজ পড়ে। কিন্তু পুটুকে এই সবের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বড়ো করে তোলে সে। মুসলিম অন্ধ সুন্দরী পতিতা চাইত তার হিন্দুপুত্র হবে সম্বুদ্ধ সন্ন্যাসী। স্কুলে ভর্তির সময় সত্যানন্দ মহারাজ ভর্তির খাতায় পিতৃত্ব ভিক্ষা দিয়েছিলেন। এম পাশ করে সেই পুটু একদিন হয়ে ওঠে সম্বুদ্ধ সন্ন্যাসী।

সেই সন্ন্যাসী অদ্ভুত এক পরণকথা শুনিয়েছেন, যে পরণকথা তাঁর মায়ের কাছে শুনে ছিলেন তিনি। রুকু পুটুকে ছাদে নিয়ে গিয়ে দ্যাখাতে চাইত আকশের জহুরা নক্ষত্র। রুকুর পরণকথার নায়িকাই তো জহুরা। জহুরাও একজন নিঃসঙ্গ রূপাজীবা। 

গণ-বিনোদিনী জহুরা দেহের বেশাত করে বাঁচতেন। ভাবতেন তিনি এতদূর পতিত যে খোদাকে ডাকারও অধিকার নেই তাঁর। একবার মরু প্রান্তরে দেখতে পেলেন এক মুমুর্ষু কুকুরকে। তাকে জল দেওয়া দরকার। কিন্তু কাছাকাছি কোনও কূপ দ্যাখা গেল না। অনেক খুঁজে যদিও একটি কূপের সন্ধান পাওয়া গেল, সেখান থেকে জল তোলার উপায় নেই। মৃত্যুন্মুখ কুকুরটার দিকে চেয়ে পতিতা আজ পরমেশ্বরকে ডাকলেন। মরুভূমির ঈশ্বর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর মগজে বুদ্ধি দিলেন। পরনের বসন ছিঁড়ে দড়ি বানালেন। পায়ের জুতো খুলে সেই দড়িতে বাঁধলেন। আর তা দিয়ে জল তুললেন। জুতো ভর্তি জল উঠে এল। অতি যত্নে কুকুরটিকে জল দিয়ে বাঁচালেন। কুকুরটি উঠে দাঁড়ালে জহুরা বললেন— “তুমিও অপবিত্র জীব, আমিও না-পাক ঔরত, এসো আমরা একসঙ্গে বাঁচি।”

মরুভূমির বেশ্যা-বাজারে থেকে গেল কুকুরটি। একদিন অপঘাতে মারা গেলেন জহুরা। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও কেউ আসে না জহুরার খোঁজে। কুকুরটি একা বসে রইল মৃতদেহ আগলে। হঠাৎ কুকুরটি লক্ষ্য করল— “সম্মুখের মৃতদেহ থেকে ঠিকরে বার হচ্ছে আশ্চর্য জ্যোতি আর ধীরে ধীরে দেহটি জ্যোতির্বলয়ে বদলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে দেহটি আর রইল না। আলোর বলয়টি ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে আকাশের দিকে উড়ে চলল। এবং সংহত হতে লাগল। তারপর সেই আলোক-বলয় নক্ষত্রে পরিণত হয়ে আকাশে স্থির হয়ে দীপ্তি পেতে থাকল।”

রুকু নিজেকে আবিষ্কার করত এই পরণকথার মধ্যে। সম্বুদ্ধ নক্ষত্র দেখে পথ হাঁটছেন কথা শেষ করে। সেই নক্ষত্র মাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে— লেখকের উপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তাঁর মা জহুরা খাতুনের। আর শুক্রগ্রহকে জহুরা নক্ষত্র বলে। 

তাঁর ‘উৎসর্গ’ গল্পটিও একটি আরবি মরু কাহিনি থেকে নেওয়া। উপকথাকে লেখক তাঁর মতো করে লিখেছেন। গল্পে এই বিষয়গুলির ব্যবহার তাঁর মুসলিম মানসেরই পরিচয় বহন করে।   

 আবুল বাশারের গল্পে যৌনতা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। সেখানে যৌনতা মানুষের অস্তিত্বের একটা অংশ হয়ে উঠেছে। তিনি মনে করেন— যৌনতা মানুষের আদিম অস্তিত্ব। চালিকাশক্তি। তাকে এড়িয়ে মানুষ হয় না। নারী-জীবনের যৌনতায় ঝোঁক আছে তাঁর। নারীমনের মুক্তির কথা তাঁর লেখায় আসে যৌনতার পথ ধরে। তার নানা রকম রূপবৈচিত্র্য। যুগে-যুগে তা বদলাচ্ছে। মনে পড়ে তাঁর ‘মরুস্বর্গ’ উপন্যাসের রিবিকাকে। তিনজন পুরুষ কামনা করেছে তাকে বিভিন্ন রূপে। ‘নরম হৃদয়ের চিহ্ন’ উপন্যাসে যৌনতাকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন গবেষণার স্তরে।    

‘আমকুসির গন্ধ’ গল্পটির কথা মনে পড়ে। এ লেখার কেন্দ্রে একজন যৌনকর্মী। অথচ, যৌনকর্মী সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মেলানো যায় না। প্রগাঢ় মূক এবং বধির এই রূপাজীবীর চোখ দুটি অবোধ-সরল-ছায়াময়-শান্ত-বড়বড়। এই চোখই আকৃষ্ট করেছিল দীপায়নকে। রঙ্গিনী সামন্ত তাকে বিট্রে করার পর মদ খেয়ে পাগলপ্রায় দীপায়নকে বন্ধু রমেনই এনেছিল এখানে। ভোগ করতে করতে দীপায়নের মনে হল মেয়েটি বোবা। আর সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর শিথিল হয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শিরশিরে কী একটা ঠান্ডা অনুভূতি। নিজেকে সে মেয়েটির ভেতর থেকে টেনে বার করে নিল।

যৌনকর্মীটির সঙ্গে অর্ধ-সহবাস। অর্ধও নয়। সিকি সহবাস বলা যেতে পারে। তারপর মেয়েটির শরীরে শাড়িটা ছড়িয়ে দিয়ে চেয়ার আগলে বসে থাকে সে। বড়ো করুণ এবং মায়াবী মেয়েটির শরীরী বর্ণনা।

• “শরীর এত করুণ হয়। গায়ের গন্ধ আমের কচিপাতার মতো এবং মৃদু।”
• “এ এক অকাট্য পাষাণ যেন বা। বুক দুটিও করুণভাবে ছোট। কপালে একটি নীল রাজশিরা দপদপ করে উত্তেজনা হলে। বাহুমূল শিশুদের মতো খাদালো এবং ভাতরোম আছে।”
• “বুকের পাঁজরের হাড় শিশুদেহের মতো গোনা যায়, রোগা নয়, কিন্তু করুণাময় হাড়ের মজ্জা এখনও গাঢ় নয় বলে মনে হয়।”
• “একটি বুক শাড়ির পাশ ঠেলে বার হয়ে সকরুণ চোখের মতো তাকাচ্ছে।”
• “বুক দুটি এতই গরিব! এতই করুণাঘন! যেন বোবা চোখের মতো বাঙময়!”
• “গাভীর চোখের মতো সরল নির্লোভ চোখে, কোনও বিস্ময়-বিদ্যুৎ ছিল না”। 

মেয়েটির শরীরী বর্ণনা-সংক্রান্ত কিছু বিচ্ছিন্ন লাইন তুলে দেওয়া হল। কী মায়াবী এই বর্ণনা! একজন যৌনকর্মীর যৌনাঙ্গের এহেন বর্ণনা আমাদের অভিভূত করে। কোনও যৌন-উদ্দীপনা জাগায় না। বিস্মিত করে। মায়া হয়।

একসময় শরীর থেকে তার শাড়ি সরে যায়। বোবা মেয়েটিকে সহসা ছেনে ফেলতে উদ্যত হয় দীপায়ন। যৌন-প্রহারে পাষাণ দেহে একটু একটু করে জেগে ওঠে প্রাণ। মুখে ভরে ওঠে আহ্লাদ। 

“মেয়েটি তার অকপট চোখের ভাষায় মমতা দিয়ে দীপায়নকে যেন লেহন করছিল। আর পুরু জিভটা বার করে, তার উপর ডান হাত, কিছু একটা চেটে খাওয়ার কেতায়, ওঠা-নামা করে ঘষছিল, এটা আসলে খেতে চাওয়ার অভিনয়— জিভে আঙুল বা চেটো কিন্তু ছোঁয়াচ্ছিল না বোবা দেহ-পসারিনি। ছোঁয়ানোর ভান করে খেতে চাইছিল।...কী যে হল দীপায়নের, সুখের উষ্ণতম শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছে নিবৃত্তির পর মেয়েটির গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে দিয়ে নিজেকে আলগা এবং পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে নিল”

রাত সাড়ে তিনটে তখন। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে এসে ট্রেনে চেপে বসে। হঠাৎ মনে পড়ে বোবা মেয়েটিকে চুক্তি মতো দেড়শোটা টাকা দেওয়া হয়নি। পরের স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি ধরে। কিন্তু ড্রাইভারকে জায়গাটার নাম বলতে পারে না। ব্রথেলে ব্রথেলে হানা দেয়। বছরের পর বছর ধরে দীপায়ন খুঁজতে থাকে সেই বোবা মেয়েটিকে। এদিকে স্বামী পরিত্যক্ত রঙ্গিনী একসময়ের কলেজ পার্ট-টাইমার, এখন অধ্যাপক দীপায়নের কাছে ফিরে আসে। দীপায়ন খুঁজে ফেরে সেই মেয়েটিকে। টাকাটা দিয়ে রঙ্গিনীর কাছে ফিরে আসতে চায়। বছর সাতেক পর বন্ধু রমেন বলে সেই বোবা রূপাজীবীকে ঠিক সে খুঁজে বার করবে। খুঁজে পায়ও সে। রমেনের সঙ্গে দীপায়ন যায় সেখানে মফস্‌সলের বেপাড়ায়। ইলেকট্রিসিটি নেই। তালপাখার আচমকা ঝাপটায় কুপিও নিভে যায়। দীপায়ন টাকা না দিয়েই তমসালিপ্ত নারীতে লিপ্ত হয়। তারপরই ভোগ-তাড়িত ক্ষুধার্ত পুরুষের মনে হল, সেই বোবার গায়ে আমকুসির গন্ধ আর নেই। গল্পটি শেষ হচ্ছে এভাবে :
 
“একসময় দীপায়নের গাল বোবা মেয়েটির কান্নায় ভিজে গেল। কামদ-কান্নায় ভিজে যাচ্ছিল কামাদ্রি-কুসুম। যোনিপুষ্পের অর্ধ কিশলয় বোবা-বেদনায় দীর্ণ হচ্ছিল। দাঁতে-দাঁত কান্নাকে চেপে কথা বলছিল নৈঃশব্দ্যে, রঙ্গিনীর শরীর। হায় ভগবান, ভালোবাসায় মানুষ বোবা হতেও রাজি।”
 
পুরুষতন্ত্র যৌনদাসী করে রাখতে চেয়েছে মেয়েদের। যৌনদাসত্ব থেকে মেয়েদের মুক্তি নেই! রঙ্গিণীই এখানে বোবা রূপাজীবী সেজে দীপায়নের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। দীপায়নকে সুস্থ করতে, চিন্তামুক্ত করতে, সম্পূর্ণ করে পেতে, রূপাজীবীটির ভাবনা তার মাথা থেকে তাড়াতে প্রেমিকা রঙ্গিনীর এরকম সমর্পণ। ভালোবেসে প্রেমাস্পদের কাছে পতিতা সেজে, নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে সমর্পন করেছে। যৌনতা এবং প্রেম একাকার এখানে। পবিত্র ও মায়াবী অদ্ভুত এক যৌন-ডিকশান গল্পটিতে প্রতিভাত।

কৃষক-আন্দোলনের সূত্রে সাধারণ গ্রামীণ মানুষদের খাদ্যাভাব-দুঃখ-যন্ত্রণার ছবি দেখেছেন কাছ থেকে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। বিশেষত ছোটোগল্পে। মুসলমান জীবনের নানান ধর্মীয় প্রথা, যুক্তিহীন সংস্কার ইত্যাদি আবুল বাশার তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং বহু-বিবাহকে কেন্দ্র করে পারিবারিক জীবনে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তাও তাঁর গল্পের বিষয় হিসেবে উঠে আসে। তালাক-ঈদ্দত-তহলীলের জটিল জালে আবব্ধ নরনারী তাঁর গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছে। নিয়মের দুর্নিবার নিগড়ে শুধু মেয়েরা নয় পুরুষরাও যে নিরন্তর ছটফট করে তা বোঝা যায় তাঁর গল্পের পাঠক্রিয়ায়। লেখক নিজের স্বতন্ত্র নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়গুলিকে লক্ষ্য করেছেন। তাঁর নিজস্ব চেতনার আলোকে কখনও কখনও ব্যাখ্যা করবারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কখনোই তিনি যুক্তিহীন কুসংস্কারের পক্ষে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেননি। বিগত চার দশকের পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সমাজমানস আবুল বাশারের লেখায় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। বাংলার মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ এখনও অশিক্ষা দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের আবহে রয়েছেন। সেই বদ্ধতা পশ্চাৎপদতা যে কতটা তা বহু ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনারও বাইরে। সেই মুসলিম সমাজের বহু অকথিত কথা, অজানা তথ্য সম্পর্কে আমরা সচেতন হতে পারি তাঁর গল্পের পাঠক্রিয়ায়। সেদিক থেকে আবুল বাশারের গল্পের ঐতিহাসিক মূল্যও অস্বীকার করা যায় না। 
 
তাঁর কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে ছোটোগল্পের দৃষ্টির একটা সাদৃশ্য রয়েছে। তাঁর গল্পগুলি একইসঙ্গে সাংগীতিক, কাব্যময়, ছন্দময় এবং চিত্রময়। আরবি ছন্দ নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন তিনি— ‘দশ পারা’।   

তাঁর গদ্যে সংগীতের প্রভাব রয়েছে। গদ্যকে দিয়ে গান গাওয়ান তিনি। সংগীতের জ্ঞান স্বচ্ছ বলে তাঁর গল্পে চমৎকার ধ্বনিরসের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করেন সুরই ধর্মকে মেলায়। উচ্চাঙ্গ সংগীতের উৎসে রয়েছে হিন্দুমুসলমানের মিলিত রূপ। স্মরণীয় তাঁর ‘সুরের সাম্পান’ উপন্যাসটির কথা। সুর দিয়ে সেই ঐক্যটাকেই দেখিয়েছেন এই আখ্যানে।   

ইসলামিক মিথ, রূপকথা তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। উর্দু, আরবি, ফারসি ভাষা থেকে সৃষ্ট মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতির সেতু বন্ধন করেছে তাঁর লেখাগুলি। তাই ইসলামিক প্রেক্ষিতে লেখা তাঁর আখ্যানগুলিও আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে সমানভাবে আদৃত।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. আলোচনাটি মনোজ্ঞ। তথ্যবহুল। কান্নার কল গল্পের আলোচনা পড়তে পড়তে যেন ঘটনাগুলো দেখতে পেলাম। আবুল বাশারের জনপ্রিয়তা আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।
    এর জন্য আলোচক বিশ্বজিৎ পাণ্ডার মূল্যায়ন দক্ষতার তারিফ করতেই হয়। নির্মল চট্টোপাধ্যায়

    ReplyDelete
  2. অত্যন্ত প্রাঞ্জল লেখা। আবুল বাশারের সাহিত্য একটা সময়ের দলিল। লেখক আবুল বাশারের লেখনি শক্তির একেবারে ভেতরটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

    ReplyDelete