জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/ সপ্তদশ পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
সপ্তদশ পর্ব         
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বেলাশেষে 

প্রকৃতির নিয়মে দিনগুলি পেরিয়ে যায় রূপোয়াতী মারা যাবার প্রায় দশ বারদিন পরে নিজের শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তিনি পুনরায় নবরত্ন সভায় অংশগ্রহণ করলেন। যথারীতি ভোরবেলায় প্রাতস্নান করে নিজের রেওয়াজ করেন। নিজের রেওয়াজের পরে সরস্বতীকে গানের তালিম দেন। এরপরে দরবারে যেয়ে দুপুরে নিজের হাভেলিতে ফিরে আসার পরে মধ্যাহ্নভোজ সমাপনান্তে সংগীত কক্ষে প্রবেশ করে গ্রন্থ রচনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে এক একদিন দ্বিতলের চত্বরে বসে যমুনায় অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে পুরাতন দিনগুলির কথা চিন্তা করেন। এই চত্বরেই সম্রাটের দরবারে দীপক রাগ গাইবার পূর্ব রাত্রিতে রূপোয়াতীর গাওয়া মালকোষ রাগের গানে তানসেনের ঘুম ভেঙ্গে গেছল। এই চত্বরেই রূপবতী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। কত যে বিক্ষিপ্ত এলোমেলো চিন্তা তার মনকে গ্রাস করে। সন্ধ্যের সময় পুনরায় নিজের কক্ষে রেওয়াজ করে আহার সমাপন করে শয্যা গ্রহণ করেন অথবা কোন কোন রাত্রিতে সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য সংগীত পরিবেশন করেন। কখনো বা সম্রাটের সাথে চন্দ্রালোকে যমুনাতে নৌকা বিহার করতেও যেতে হয়। দীপক রাগের প্রভাবে দগ্ধ হওয়ার পরে তানসেনের শরীর ইদানিং খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তার উপরে রূপোয়াতীর মৃত্যু তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।                             

ইতিমধ্যে সরস্বতীর বিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট বীণাবাদক ও সঙ্গীতপ্রেমিক সিংহলগড়ের চন্দ্রবংশীয় রাজা মিশ্রিচাঁদের সাথে। বিয়ের সময় মিশ্রিচাঁদ দীন-ইলাহী ধর্মমত গ্রহন করার পরে তাঁর নতুন নাম হল নবাদাত খাঁ বা নউবত খাঁ। বিয়ের পরে সরস্বতী সিংহলগড়ে চলে যাবার পরে আগ্রা দুর্গে তানসেন একা হয়ে পড়লেন। বয়সের ভার ধীরে ধীরে তাঁর উপরে পড়ছে। শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না, কিন্তু তাঁর সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই। যার জন্য সম্রাট আকবর তাঁকে ছাড়ছেন না। দু একবার সম্রাটকে বলেছেন " জাহাঁপনা, বয়স তো হলো এবারে আমাকে নিজের জন্মভূমিতে যেতে অনুমতি দেন"। তানসেনের এই কথা শুনে সম্রাট বললেন " মিঞা আপনার কি কোন তকলিফ হচ্ছে এখানে, তাহলে আপনি বলুন আমি তা দূর করার চেষ্টা করব"। তানসেন বললেন " না আপনার কাছে আমার কোন তকলিফ হচ্ছে না ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝে জীবনের বেলাশেষে ছেলে-মেয়ে, বিবির জন্য মনটা খুব উতলা হয়। এছাড়াও দীপক রাগ গেয়ে অগ্নিদগ্ধ হবার পরে মধ্যে মধ্যে শরীরের ভিতরে এক প্রকার অস্বস্তি অনুভব করি। বহু হেকিম কবিরাজতো দেখলেন কিন্তু কোন উপকার হচ্ছে না। গান গাইতে গাইতে শরীরের ভেতরে একটা হাঁফের টান আসে"।  মাঝে মাঝে বীরবল বা রাজবাহাদুরের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেন দরবারের শেষে অথবা নিজের হাভেলির কক্ষে।                                              

ইতিমধ্যে আকবর গোয়ালিয়র থেকে তানসেনের বিবি হোসেনীকে যথোচিত মর্যাদায় আগ্রা দুর্গে তানসেনের হাভেলিতে নিয়ে এসেছেন যাতে মিঞার কোনরকম অসুবিধা না হয়। 

১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র মাস থেকে আগ্রা নগরীতে প্রচন্ড দাবদাহ। এই গরমে তানসেনের শারীরিক খুব কষ্ট হচ্ছে। একটু হাঁটাচলা করলেই হাঁপিয়ে পড়ছেন। ২৬শে এপ্রিলের দ্বিপ্রহরে আহার সমাপন করে নিজের কক্ষে যেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে গ্রন্থ রচনায় মগ্ন হলেন। সন্ধ্যার সময় সামান্য রেওয়াজ করার সময় হোসেনিকে বললেন "আমার শরীরটা আজকে ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে আল্লাহর কাছে যাওয়ার ডাক আসছে"। রাত্রে সামান্য আহার করে তিনি শুয়ে পড়লেন। বুকের মাঝখানে একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলেন। হোসেনী বললেন সামান্য জল খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি বরং তোমার শয্যার নিচে গালিচায় শুয়ে পড়ছি। যেকোন প্রয়োজনে তুমি আমাকে ডাকবে"। কিন্তু সেই যে তিনি শুলেন সেটাই তাঁর শেষ নিদ্রা। নিদ্রাকালীন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি জীবনের অপর প্রান্তে চলে গেলেন। হোসেনীকে ডাকারও আর সুযোগ ঘটেনি। 

ভোরবেলাতে যখন তানসেন শয্যা ত্যাগ করেননি তখন হোসেনী তাঁকে ঘুম থেকে তুলতে যেয়ে দেখেন তাঁর শরীর বরফের মত শীতল ও কঠিন। তাঁর চিৎকারে হাভেলির বাঁদীরা সবাই ছুটে এলো। প্রধান বাঁদী আয়েশা যেয়ে সম্রাটকে খবর দেওয়ার পরে সম্রাট একজন হেকিমকে তলব করলেন। তিনি এসে দেখলেন তানসেনের নাড়ির স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তিনি মাথা নিচু করে বললেন রাত্রিতে ঘুমের মাঝে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।         

আশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন আকবরের 'নবরত্নসভা'র অন্যতম রত্ন মিঁয়া তানসেন। কি অদ্ভুত সমাপতন জন্মেও ছিলেন ২৬শে এপ্রিল চলেও গেলেন একই দিনে। তার মৃত্যুর পরে নবরত্ন সভার সদস্যেরা তার হাভেলিতে এসে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পরে স্থির হল সংগীত সম্রাটের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মৃতদেহের সৎকার হবে গোয়ালিয়রে গুরু ঘাউস মহম্মদের সমাধির পাশে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে দিল্লির আবাল বৃদ্ধ বনিতা শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে তার হাভেলিতে এসে চোখের জলে তাঁকে বিদায় দিলেন। সম্রাট আকবর ও নবরত্ন সভার সদস্যেরা স্থির করলেন সঙ্গীতসম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মাস ধরে শোক পালন হবে এবং সেই মতো ফরমান জারি হল। তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আকবর ও নবরত্ন সভার সদস্যেরা তাঁর মৃতদেহ আগ্রা থেকে গোয়ালিয়র নিয়ে গেলেন রাজকীয় শকটে। 

সেখানে যেয়েও আবার বিপত্তি। তানসেনের শেষকৃত্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হল ব্যাপক বিক্ষোভ। হিন্দু সমাজ ঘোষণা করলেন তানসেন হিন্দুর ঘরের ছেলে। নাম রামতনু মিশ্র, পিতা মুকুন্দ মিশ্র (মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষন ও সুগায়ক। জনৈকা মুসলিম রমনীর (তানসেনের স্ত্রী হুসেইনি বেগম) চক্করে পড়ে ধর্ম পরিবর্তন করলেও, তার শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। তাই তার শেষকৃত্য হিন্দুশাস্ত্রমতেই হওয়া উচিত। কিন্তু নারাজ ইমাম-মৌলবীরা। তারা বললেন ধর্ম বদল করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন। তাই ইসলাম মতেই পালন করা হোক সুরসম্রাটের শেষ যাত্রা। উভয় পক্ষের যুক্তিই সঠিক। সম্রাট আকবর ও নবরত্ন সভার সদস্যেরা কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না।        
                                                                 ক্রমশঃ

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments