জ্বলদর্চি

রাষ্ট্রের প্রবণতা হল তার বাইরে অবস্থিত সব কিছুই গ্রাস করা/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

রাষ্ট্রের প্রবণতা হল তার বাইরে অবস্থিত সব কিছুই গ্রাস করা

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


পান্ডবরা পাশা খেলায় প্রথম হেরে যেতে, ধৃতরাষ্ট্র মানবিকতার খাতিরে তাদের আবার ফিরিয়ে আনলেন। ফিরিয়ে আনতে শকুনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন - রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাদের সব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তা নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবে আর একবার পাশা খেলি আসুন। যুধিষ্ঠির তাতে সম্মত হয়ে পুনরায় পাশা খেলতেই, সব খুইয়ে বনবাসে গেলেন। এ কাহিনী আমাদের সবার জানা। এর ভেতর অন্যায় আছে বলে বোধ করি না। কারণ, রাষ্ট্রের প্রবণতা হলো, তার বাইরে অবস্থিত সবকিছুই গ্রাস করা, বা কুক্ষিগত করা। এটাই করে দেখিয়েছেন দুর্যোধন। 

তাই আমরা দেখতে পাই পঞ্চায়েত, স্কুল, হাটবাজারে, প্রভৃতি জায়গায় নির্বাচনের নামে শাসকদলের দৌরাত্ম্য। কিন্তু আমরা জানি রাষ্ট্র সজীব নয়। রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ভর করে তার শাসন প্রণালীর বৈশিষ্ট্যের উপর। এই শাসন প্রণালী সবার এবং প্রত্যেকের জন্য হতে চায়। অর্থাৎ এই শাসন প্রতিটি ব্যাক্তি ও জনসমূহ, এই দুইয়ের জন্যই হতে চায়।

আবার দেখতে পাই, মহাভারতের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন শরশয্যায় শায়িত, কৃষ্ণ, অর্জুন, যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে গেলেন। তখন ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন - রাজা হচ্ছে কালের কারণ। আবার রাজা তার রাজত্বের পরিবর্তন কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখতে, নিজেই কালস্বরূপ হয়ে ওঠেন। ভীষ্ম আবার রাজাকে ধর্মস্বরূপ বললেন। তিনি বললেন- "আচারমেব মন্যন্তে গরীয়ো ধর্মলক্ষ্যনম"। আচারই সবচেয়ে বড়ো ধর্মের লক্ষণ। কেউ তার ধর্ম সঠিকভাবে পালন করছে কিনা, তার আচরণ দেখে বোঝা যায়। শাসকের ধর্ম কী? প্রত্যেকের স্বাধীনতা রক্ষা করা। সকলের হিতসাধন করা। বস্তু সামগ্রীর বিলিবন্টন ব্যবস্থা করা। 

কিন্তু যে নিজে স্বাধীনতার দ্বারা গঠিত নয়, কিংবা যে নিজে স্বাধীন নয়, তার দ্বারা জনসাধারণের স্বাধীনতা রক্ষিত হয় না। যদি সত্যিই সরকার স্বাধীনতা দিয়ে গঠিত হতো, তবে যে কোনো নির্বাচনে আমরা এত রক্তক্ষয়, লুঠতরাজ, ধর্ষণ কিংবা ঘরছাড়াদের মিছিল দেখতাম না। 

এর পরের বিষয় সকলের হিত সাধন। হিত সাধন মানে আইনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এখানে প্রশ্ন ওঠে - কে শাসন করছে? এই শাসনের উৎস কোথায়? এর বৈধতার ভিত্তি কী? এই সকল প্রশ্ন মাথায় নিয়ে যখন বর্তমান সময়ের কথা ভাবি, তখন দেখতে পাই- রাষ্ট্রের প্রতি আশা আশঙ্কা ভালবাসা ভয় বিতৃষ্ণা এইসব কিছু লগ্নি করে, আমরা মুখোমুখি হয়েছি রাষ্ট্ররূপী এক 'শীতল দানব'-এর কাছে।

বর্তমানের কিছু মানুষ ভাবে কোনোরকম বেঁচে গেলেই হলো। আর কিছু মানুষ ভাবে-  কোনোরকম টেকা নয় ফুটে  ওঠা। আর ফুটে উঠতে গেলে চাই, এই পৃথিবীর সব রূপ রস গন্ধ ভোগ করা। কারণ তারা ভাবে এসব সম্ভোগ না করলে, দেহ, মন, সরস হবে না। আর দেহ মন সরস না হলে, আমি  বিকশিত হবো কি করে? তারা মনে করে যাদের মন বিকৃত, তারা সত্য ন্যায়ের দোহাই দিয়ে, আত্মনিপীড়নে বাহবার কারণ খুঁজে পায়। সুস্থ মন চায় সম্ভোগ। তাদের ভেতর একটাই রসায়ন কাজ করে, এই আধুনিক জীবনে বাঁচতে গেলে নিজের নায়কোচিত ধাত রাখতে হবে।আধুনিকতার মূল বিষয় হলো হিরো। 
সেই মনোভাব থেকে এই সমস্ত মানুষেরা যা কাজ করে,  তাদের মধ্যে একটাই উদ্দেশ্য থাকে- নিজেদের পরিপুষ্ট করা। শুধু নিজের নয়, তার আত্মীয়স্বজন, পরিবার, চেনা পরিচিত, সবাইকে পুষ্ট করে তোলে। তারা শাসন ক্ষমতায় থেকে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তার মধ্যে সাধারণ মানুষের উন্নতি থেকে, নিজের  উন্নতি বেশি প্রাধান্য পায়। তাই তো বর্তমান শাসকের অন্যান্য কার্যকলাপের মধ্যে, এবং এই নিয়োগ দুর্নীতিতে তার প্রতিফলন দেখতে পাই। সরকারের মাধ্যমে কিভাবে মানুষের মুক্তি হবে, তার কথা এরা ভাবে না। এরা ভাবে কি করে নিজেরা বিকশিত হবো। সেই কারণে বর্তমান সরকার বিভিন্ন ধরনের অসাম্য ও অ-স্বাধীনতা সৃষ্টি করছে। 

কিন্তু এরা জানে না নিজেকে প্রকাশ করতে হলে আগে আপনাকে সমৃদ্ধ করা দরকার। তা না হলে সেই প্রকাশের কতটুকু মূল্য থাকবে। আর এই আত্মসমৃদ্ধির জন্য চাই, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে ব্যাপক ঘনিষ্ঠ আত্নীয়তা। তা করতে হলে সময়ে সময়ে নিজের অনেক মনোবাসনাকে অগ্রাহ্য অবহেলা অবদমিত করতে হয়। এরা মনে রাখে না আমি মানুষ, তাই মানুষ সংক্রান্ত কোনো কিছুই আমার অনাত্মীয় হতে পারে না। যখন কোনো কিছু বিবেক বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়, এগুলি বিকাশের সহায়ক হয়। যখন ব্যক্তি তার প্রাবল্যকে কিংবা তার অনুগতরা, ব্যক্তির সেই প্রাবল্যকে বারবার সামনে এনে অন্য মানুষদের নিজের আয়ত্তে আনতে চায়- তখন সাধারণ মানুষের বিকাশ শুধু ব্যাহত হয় না, নিজেদেরও বিকৃত এবং ভয়ংকর করে তোলে। যার সমাজের পক্ষে, দেশের পক্ষে, সাধারণ মানুষের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতাবৃত্তিকে মানুষের ক্ষতি করার অভিমুখ থেকে মুক্ত করার জন্য চাই- প্রকৃত শিক্ষা, নীতি-নিয়ম। যা দেশের নেতৃত্বের মধ্যে আজকাল বড়ই অভাব। এগুলোর অভাবে শাসক তখন অপরকে শুধু নিজের উপভোগের বস্তু হিসাবে দেখে। যার প্রমাণ আজকের দিনে আমরা বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীর সঙ্গে কামিনী কাঞ্চনের যোগ দেখতে পাই।
এই সব নেতা মন্ত্রীরা কথায় কথায় ভোটে জেতার দোহাই দেয়। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়। দার্শনিক নিটশের ভাষায়- "গণতন্ত্রে সকলেই তুল্যমূল্য, সেখানে সংখ্যার প্রাধান্যে যারা নিতান্ত নিকৃষ্ট, তারা প্রতিভাসম্পন্ন গুণীজনকে বিনাশ করে গুনহীন গড়পড়তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে"।

কিন্তু গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে গড়পড়তা সাধারণ মানুষের যা করা দরকার, তা স্বীকার করে নেওয়ার সামর্থ্য অধিকাংশ মানুষের নেই। তাদের কাছে সত্যের চাইতে নিরাপত্তা অনেক বেশি কাম্য, নিরন্তর জিজ্ঞাসার চাইতে সুনিশ্চিত উত্তরে তারা অনেক বেশি আগ্রহী।
প্রথম মানুষকে শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর হিংস্র জন্তু জানোয়ারের মুখোমুখি হয়ে প্রমাণ দিতে হয়েছিল, এ সবের বিরুদ্ধে তার টিকে থাকার ক্ষমতা আছে। সাধারণ আজকের গড়পড়তা মানুষ থেকে তারা ছিল স্বতন্ত্র।  শূন্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা যাদের, তাদের বলা হয় নিটশে বর্ণিত 'অতিমানব'।  যে অতিমানব মহাভারত বর্ণিত কৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, অর্জুন রুপি সাধারণ জনগণকে বোঝাবে, এই অপশাসন দুর্বৃত্তায়ন দূর করতে যুদ্ধ রুপ ধর্ম হতে তোমার বিমুখ হওয়া উচিত নয়। 

পরিশেষে বলি- জনগণ যদি গণদেবতা হয়, দেবতা কিন্তু কংসের একশত দোষ ক্ষমা করেছিল, এর বেশি নয়।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments