জ্বলদর্চি

আনন্দ নিকেতন /সালেহা খাতুন

আনন্দ নিকেতন

সালেহা খাতুন


মনস্বিতা,ইকরা,দানিশ তুতো ভাইবোন।
অতিমারীকালে বাড়িতে অনলাইন ক্লাসে হাঁফিয়ে ওঠে প্রবল বিদ্রোহ করে মায়েদের বাধ্য করেছিল মামার বাড়ি চলে আসতে।

মনস্বিতা একান্নবর্তী পরিবারেই থাকে। ঠাকুমা ঠাকুরদা পিসিমা সবাই বেশ আদরেই রাখে। কিন্তু সে আদরে ভাগ বসায় অনলাইন ক্লাস। সকাল আটটা চল্লিশ থেকে বারোটা চল্লিশ চলে যায় অনলাইন ক্লাসে। মায়ের সঙ্গেই ক্লাসে বসে; কেননা ওর এখনো ছবছর বয়সই হয়নি। এক্সাসাইজ থেকে শুরু করে এক্টিভিটি টাস্ক সারতে সারতেই দিন শেষ।

তাই ঠাকুরদাকে মনস্বিতা বলেছে –
“আমি মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য ‘উৎসুক’ হয়ে পড়েছি। আমার বাড়িতে ‘অদ্ভুত’ লাগছে।”
‘উৎসুক’, ‘অদ্ভুত’ শব্দ দুটি মনস্বিতা নতুন নতুন শিখেছে। তাই বাক্যে প্রয়োগ করে দিয়েছে।
বাচ্চাটা কোথায় অসুস্থ হয়ে পড়বে! সামনে ঈদ হলেও তাঁরা মামার বাড়ি যাওয়ায় ছাড়পত্র দিয়ে দেন। মনস্বিতার এম. এ. পাশ মা বেঁচে যায়। বলে “মেয়েকে পড়াতে গিয়ে যা পরিশ্রম এবং পড়াশোনা করছি মনে হয় নিজের ছোটোবেলায় এতো পড়াশোনা করিনি”।
মামার বাড়ি এসেও সেই অনলাইন ক্লাস করতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা পুরোপুরি আনন্দের। এই আনন্দ নিকেতনে মাকে পুরোটা পাওয়া যাচ্ছে। সংসারের কাজে, সবার জন্য রান্না করতে ব্যস্ত থাকতো মা; এটাই তো মজা। পড়ার সময় বাদে মায়ের সঙ্গে সব দিদাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াও, ছাদে ওঠো,রাস্তায় হইচই করো; এমন মজা বাড়িতে কোথায়! সেখানে সব শৃঙ্খলে বাঁধা। মা তো ওখানে অতোটা স্বাধীন নয় ।
মনস্বিতা মামার বাড়িতে এসে মাকে বারবার বলেছে-
“আমার বাড়িতে একদম ভালো লাগে না। ওখানে সবকিছু পচা। এখানে সব ভালো। আমি বাড়ি যাব না। থাকবো। রোজি মাসি যতদিন থাকবে আমিও থাকবো।”
রোজির ছেলে দানিশেরও অনলাইন ক্লাস চলছে। ওকেও মামার বাড়িতে মায়ের সঙ্গে অনলাইন ক্লাস করতে হচ্ছে। বাড়িতে ক্লাস শেষ করে এক বছরের ছোটো বোনকে ওকে কোলে করে ধরে রাখতে হয় তবে তো মা স্নানটান সব করতে পারে। করোনা কালে মাকে বাড়িতে সাহায্য করার কেউ নেই। বাবা ব্যস্ত থাকে ব্যবসার কাজে।

কিন্তু মামার বাড়িতে এসে পড়ার পর শুধুই ছুটি। বোনকে ধরতে হ্য় না। রুমি মাসিই সব দেখাশোনা করে। ছোট্ট দানিশ ছুটে বেড়ায় গোরু বাছুরের পেছনে। ভীষণ আনন্দ। কলকাতার বেহালায় সে আনন্দ কোথায়? দানিশও মাকে বলে দিয়েছে, “ তুমি বোনকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমি এখন আরো অনেক দিন মামার বাড়িতে থাকবো।”
রোজি প্রমাদ গোনে ফিরে গিয়ে অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশোনা তথা ছোট্ট মেয়েটাকে সামলাবো কী করে? বছর ছয়েকের দানিশের মন জয় করতে রোজিকে আরো কয়েকটা দিন থেকেই যেতে হয়।
তুতো ভাইবোনদের মধ্যে শুধু খুনসুটি নয় ঝগড়াও লাগছে কখনও কখনও। যেমন ইকরার সঙ্গে মনস্বিতার দ্বন্দ্ব বেঁধেছে পড়ে থাকা একটি মাত্র কাঁঠালি কলার ভাগ নিয়ে। দুজনেই তো ছোটো। অর্ধেক করে ভাগ কেউ নেবে না। বাধ্য হয়ে ওদের দিদা রাস্তায় নামেন সবজিওয়ালার কাছ থেকে কাঁঠালি কলা কেনার উদ্দেশ্যে।কিন্তু তার কাছেও সব শেষ। আঁচলে টাকা বেঁধে ঘরে ফিরে আসেন। হাসতে হাসতে টপ করে নিজে খেয়ে নিয়ে বলেন “ যাও তোমাদের কাউকে খেতে হবে না, আমিই খেয়ে নিই।” দ্বন্দ্ব মিটলো।

মনস্বিতার মাকে আগে ফিরে যেতে হবে। শ্বশুর বাড়ির ছাড়পত্রের সঙ্গে বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসার দিনও ঘোষিত ছিল। “ঈদের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে।” তার সঙ্গে আরো একটা কথা জোড়া ছিল। যেটা আয়রনির মতো শোনায়—“ বাড়ির মেয়েকে অনুষ্ঠানে আমরা বাড়িতেই চাই।” কিন্তু মনস্বিতা বেঁকে বসেছে, একই কথা – “ রোজি মাসি যতদিন থাকবে আমরাও ততদিন থাকবো। ও আগে যাক তারপর আমরা যাব।”
মনস্বিতারা একটা টোটো ধরে বাড়ি চলে যেতে পারবে কিন্তু রোজিকে বেহালায় যেতে হলে এখন লঞ্চে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ট্রেন চলছে না। রাস্তাঘাটে বারবার যানবাহন বদলাতে হবে। সে কথা মনস্বিতাকে কে বোঝায়!

অবশেষে রোজি উপায় বাতলে দিল। আমার ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে খোকন দাদাদের দোতলায় লুকিয়ে থাকবো তখন তুই মনস্বিতাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়িস।”
রোজি আরও বলে “ আমি ঈদটা এখানেই কাটাবো। দানিশেরও একটু রেস্ট দরকার। বাচ্চাটা আমার কলকাতায় থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে।”
আসলে মামার বাড়িটা শুধু বাচ্চাদেরই মুক্তির জায়গা নয়। বাচ্চাদের মায়েদেরও প্রাণভরে অক্সিজেন নেওয়ার আনন্দ নিকেতন। বাবা মায়ের সাধ্য আছে বলে বাচ্চাগুলো বাড়িতে বসে অনলাইনে শিক্ষালাভ করেছে ঠিকই।কিন্তু মামার বাড়িতে এসে আনন্দের সঙ্গে যে কটা দিন পড়তে পারল ,তাতে তাদের প্রাণশক্তি ধারণাশক্তি,চিন্তাশক্তি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই শক্তিশালী হয়ে উঠলো।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments