জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো /পর্ব ৫ /সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো 
পর্ব ৫
সুকন্যা সাহা 


আজ বিশ্বকর্মা পুজো। এই যে এক মাসব্যাপী পুজো পাব্বন তিথি তেওহার তার পেত্থম পুজো। এর আগে অবিশ্যি শুরু হয়ে গেছে গনেশ পুজো। সব্বার শুরুতে সিদ্ধিদাতা গনেশের পুজো। মা দুগগা যে তেমনটিই বর চেয়েছিলেন মহাদেবের কাছে!

    প্রত্যেক বছর বিশ্বকর্মা পুজোর তারিখ সেই একই। ১৭ ই সেপ্টেম্বর। ওটির নড়ন চড়ন হওয়ার যো নেইকো মোটে। বিশ্বের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার জন্মদিনের ডেটের ব্যাপারে একদম পাংচুয়াল। এবারে উপরি পাওনা পয়লা আশ্বিন। নীল আকাশ, শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ জানান দেয় পুজো ঠিক দোরগোড়ায় । নীল আকাশে পত পত করে উড়বে ঘুড়ি, তবে না বিশ্বকম্মা !বিশ্বকর্মা পুজো আসলেই বড় মনে পড়ে ছেলে বেলার কথা।মানে আমারা যখন কচিকাঁচা আর কি! আমাদের  ছোটোবেলায়  যখন পাড়ার  মোড়ে মোড়ে রিক্সা স্ট্যান্ডে এ্ত বিশ্বকর্মা পুজোর ধূম পড়েনি... ইস্কুল ছুটি পাওয়া যেত ; আমার দাদুর ছিল লোহা লক্করের কারখানা, উল্টোডাঙ্গায়। লোহার বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরী হত সেই কারখানায়। আমার দাদু পুজোর বাজার  করার ব্যাপারে ছিলেন সিদ্ধহস্ত । পুজোর  আগের দুদিন থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চলত বাজার।যেন কোনো জিনিস কম  না পড়ে। আগের দিন থেকেই ঠাকুরমার পিতলের বাসন কোসন বার করার ধূম পড়ে যেত ।প্রাগৈতিহাসিক কালের একটা মেহগনি কাঠের আলমারি ছিল (এখনও আছে)।তার মধ্যেই রাখা থাকত বাসনপত্র।দাদুর  কারখানায়  গণেশ কাকু নামে  একজন   কাজ  করতেন । অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক । সেই  গণেশ কাকুই ছিলেন পুজোর all in all.ঠাকুর আনা, ফর্দ মিলিয়ে বাজার করা, পুরোহিত যোগাড় করা সব কাজেই  সিদ্ধহস্ত। নরেশ,পরেশ নামে আরও দু তিন জন  কর্মচারী  থাকলেও আসল সেনাপতি গনেশ কাকু। পুজোর আগের  দিন লেদ মেশিন, লোহা লক্কড় সব সরিয়ে  খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করা হত। কারখানার এক পাশে ছিল একটা লোহা কাঠের চৌকি, দাদুদের বিশ্রাম করার জন্য; সেই চৌকি পরিষ্কার করে ফর্সা চাদর পাতা হত।খাটের একদিকে রাখা হত টেবিল ফ্যান। মালিকের নাতনিরা আসবে বলে কথা!  সকাল থেকেই বেশ একটা সাজো সাজো রব। নতুন সূতীর ফ্রক পড়ে (আমাদের ছোটোবেলায় মেয়েদের জামা বলতে ফ্রকের চলই ছিল বেশী )আমরাও একদম রেডি। দাদু ঠাকুরমার হাত ধরে রওনা দিতাম কারখানার উদ্দেশ্যে ... বয়েসে ছোটো হলেও হাত লাগাতাম ঠাকুরমার সঙ্গে সঙ্গে পুজোর যোগাড়ের কাজে। চন্দন বাটা ,নৈবেদ্য সাজানো ঘটপাতা, ফল কাটা হাজারো কাজ ... ...যথা সময়ে ঠাকুর মশাই আসতেন । শংখ বাজিয়ে উলুধবনির  মধ্যে দিয়ে সাড়ম্বরে শেষ হত পুজোপর্ব । পুজোর শেষে আশে পাশের কারখানা ও বাড়িগুলোতে প্রসাদ বিতরণ ...সেদিন দুপুরে খেতাম সবিতাদি, কবিতাদিদের বাড়ি...কালী দিদা ছিল,দাদুর কিরকম দূর সম্পর্কের বোন ... তারা কারখানার কাছেই  থাকত ... অপূর্ব রান্নার হাত ছিল কালীদিদা আর তার দুই মেয়ে সবিতা ও কবিতাদির। কালী দিদার ছেলের উল্টোডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে চা পাউরুটি ঘুগনির দোকান ছিল। আর সবিতাদিরা সেই দোকানে ঘুগনি,আলুরদম  রান্না করে পাঠাত। অপূর্ব স্বাদ  ছিল সেই ঘুগনি আলুরদমের, বাস লরির ড্রাইভারদের মধ্যে হু হু করে বিক্রি হত সেই ঘুগনি আলুর দম।বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আমাদের দুপুরে ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ থাকত ওদের বাড়ি। আলু দিয়ে লাল লাল কাতলা মাছের রসা! আহা যেন অমৃত!এত তো খাই এদিক ওদিক এখন, সেই স্বাদ আর পাই না ... খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলের দিকে ঘুড়ি ওড়ানো হত।

 ঝকঝকে আকাশে পেটকাটি ,চাঁদিয়াল নানা রঙ বেরঙয়ের  ঘুড়ির মেলা ... কখনো উড়ছে পতপত তো কখনও ভোঁকাট্টা! বক্সে তখন  বাজছে  এয় মেরে হাম সফর  ... ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তকের গান ... আজকাল দেখি বিশ্বকর্মা  পুজো  দেখলে অনেকে নাক সিঁটকোয়... বলে ওসব ছোটোলোকেদের পুজো, রিক্সাওয়ালা  ড্রাইভারদের পুজো ; মদ মাংস খেয়ে বক্স বাজিয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকার অবসর ... অবশ্য তার মধ্যেও ভালো লাগে যখন দেখি রিক্সাওয়ালা বা অটোওয়ালার বউরা নিষ্ঠা ভরে পুজোর যোগাড়  করছে বা বছরভর রিক্সাটানা লোকগুলো ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে ভক্তিভরে আয়োজন  করছে পুজোর ...আমার বাপু এই পুজোটা ভালোই লাগে ... এতখানি  বড় হয়ে গেলেও বক্সে বাজতে থাকা সেই ফেলে আসা পুরোনো নব্বইয়ের দশকের হিন্দি গান এখনও বেশ নস্টালজিক করে  তোলে ... মনে  মনে   বলি  হেই  বিশ্বকর্মা ঠাকুর, আসছে বছর আবার এসো !  আসলে রিক্সাওয়ালা আর কারখানা কালচার থেকে   বোধহয়  স্ট্যান্ডার্ড  আর আপগ্রেডেড হয় নি! যতই হোক জন্মসূত্রে পাওয়া তো !
(ক্রমশঃ)

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments