জ্বলদর্চি

নিঃসন্তান দম্পতিদের আশা: মেদিনীপুর শহরের সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টার : চিকিৎসা বিজ্ঞানে আধুনিক গবেষণার সার্থক প্রয়োগ।


নিঃসন্তান দম্পতিদের আশা: মেদিনীপুর শহরের সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টার : চিকিৎসা বিজ্ঞানে আধুনিক গবেষণার সার্থক প্রয়োগ

শুভশ্রী রায়


বর্তমান পৃথিবীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি অনেক জটিল শারীরিক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। এরকমই একটি সমস্যা হল সন্তানহীনতা বা বন্ধ্যাত্ব। প্রতিটি দম্পতিই সন্তান কামনা করেন। পরের প্রজন্মের মুখ দেখার জন্য স্বামী-স্ত্রীর বাবা মাও উৎসুক থাকেন। কিন্তু অনেক দম্পতিরই সন্তান হয় না। তাদের জন্য নতুন দিশা খুলে দিয়েছে "টেস্ট টিউব বেবী" নামের অত্যাধুনিক পদ্ধতি। 
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলাতেও এই প্রযুক্তি পৌঁছে গিয়েছে। এই জেলার নিঃসন্তান দম্পতিরা মেদিনীপুর শহরের সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টারে এসে টেস্ট টিউব বেবীর মাধ্যমে সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছেন।
     এবার দেখা যাক, বন্ধ্যাত্ব বিষয়টি ঠিক কী। যদি কোনো দম্পতি এক বছর জন্ম নিয়ন্ত্রণবিহীন সহবাস করার পরেও স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার না ঘটে তাহলে ওই জুটি বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটির শিকার। এ দিকে সন্তান গর্ভে আসার জন্য স্বামী স্ত্রীর জনন তন্ত্রে কতকগুলো ব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকা প্রয়োজন। প্রথমেই বলা যায়, পুরুষের সুস্থ স্বাভাবিক শুক্রাণু ও নারীর সুস্থ ডিম্বাণু উৎপাদনের ক্ষমতা থাকা চাই। এছাড়া শুক্রনালী ও ডিম্বনালীর মধ্যে কোনো জটিলতা থাকলে চলবে না। নিষিক্ত ডিম্বাণু ঠিক মতো গর্ভাশয়ে স্থাপিত হওয়া দরকার। তারপর সেটি ঠিক মতো ভ্রুণের  আকার পাওয়া আবশ্যক। তাই সন্তান জন্ম দেওয়ার পেছনে পুরুষ ও নারী উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। পুরুষের ত্রুটির জন্য বন্ধ্যাত্ব আসতে পারে আবার নারীর ত্রুটির জন্যও।
    পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা কম হওয়া অথবা একদমই না থাকা সন্তানহীনতার কারণ হতে পারে। আবার শুক্রাণুর অস্বাভাবিক গঠন অথবা ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছনোর আগেই শুক্রাণুর মৃত্যু ঘটলে সন্তান আসে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল- ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফোটন সংক্রান্ত সমস্যা। এর পাশাপাশি, ঠিক মতো ডিম্বাণু উৎপন্ন না হওয়া, জরায়ুতে কোনো সমস্যা অথবা হরমোনের অসামঞ্জস্য মেয়েদের গর্ভে সন্তান না আসার কারণ হতে পারে।
   
        পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৩% বন্ধ্যাত্ব মহিলাদের ত্রুটির দরুণ এবং প্রায় ৩৩% বন্ধ্যাত্ব পুরুষের ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। অবশিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে পুরুষ বা নারী উভয়ের ত্রুটি বা কোনো অজানা কারণ সন্তানহীনতার জন্য দায়ী। অতএব বিজ্ঞান অনুযায়ী পুরুষ ও নারী যে কেউ বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী হতে পারেন। তা সত্বেও আমাদের সমাজ বেশীরভাগ সময় সন্তানহীনতার জন্য মেয়েদের দোষ দেয়। এর কারণ অজ্ঞতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। তবে উন্নততর গবেষণার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞান বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তির পথ খুলে দিয়েছে। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অভিজ্ঞ ইনফার্টিলিটি স্পেশালিষ্টের কাছে গেলে তাঁরাই চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে দেবেন।
         সন্তানের মুখ দেখার আশায় যখন কোন নিঃসন্তান দম্পতি মেদিনীপুর শহরের সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টারে আসেন, তখন প্রথমে তাঁদের বয়স, আগেকার চিকিৎসা সংক্রান্ত সব খুঁটিনাটি তথ্য জানার প্রয়োজন হয়। তার পরে জননাঙ্গে কোনো অপারেশন হয়েছে কিনা, নিয়মিত ঋতুস্রাব হয় কিনা ইত্যাদি জেনে এবং দরকার মতো একাধিক ক্লিনিক্যাল টেস্ট করিয়ে ধারণা করা হয় সমস্যাটি কোথায়। তার উপর ভিত্তি করে ডিম্বাণু ঠিক মত উৎপন্ন হচ্ছে কিনা তারও অনুসন্ধানের প্রয়োজন। নারীর ক্ষেত্রে কিছু হরমোনাল পরীক্ষা ও জরায়ুর কাঠামো ঠিক আছে কিনা তাও দেখা হয়। আর পুরুষের ক্ষেত্রে সিমেন অ্যানালাইসিস করা হয়।
       যেসব দম্পতি বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা সন্তান কামনা করেন এটা একদম সত্যি। তবে অনেক সময় দেখা যায়, তাঁরা টেস্ট টিউব বেবি-পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান আনতে ইচ্ছুক নন। তাঁদের ধারণা, অনেক চিকিৎসা করিয়ে ফল না পেলে তখন সন্তান লাভ করার শেষ উপায় হল টেস্ট টিউব বেবি। কিন্তু এই ধারণা পুরো ভুল। তার কারণ সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ'ল বাবা-মায়ের বয়স। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর ডিম্বাণু উৎপাদন কমতে থাকে, ডিম্বাণুর মান পড়ে যায় এবং জরায়ুর ধারণ ক্ষমতাও কমে যায়। অন্যদিকে বয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে সক্রিয় শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে, তার ঘনত্ব কমতে পারে এবং সংক্রমণের সমস্যাও চলে আসে। তাছাড়া পুরুষের রক্তে শর্করার পরিমাণ ইত্যাদিও প্রজননের ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে সন্তান না এলে সময় নষ্ট না করে টেস্ট টিউব বেবি নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
     অনেকেরই টেস্ট টিউব বেবি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। তাদের ধারণা টেস্ট টিউব বেবি মানে ফার্টিলাইজেশন থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশু সম্ভবত টেস্ট টিউবেই হয়। বিষয়টি মোটেই সেরকম নয়। টেস্ট টিউব বেবি বন্ধ্যাত্বের সমাধানে চিকিৎসার একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মধ্যেও একাধিক কৌশল রয়েছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে I.V.F. বা ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে স্ত্রীকে ঋতুস্রাবের সময় থেকে কিছু ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় যাতে তার ডিম্বাণুগুলো বড় ও পরিপক্ক হয়। তারপর আল্ট্রা সাউণ্ড সহ রক্ত পরীক্ষা করলে জানা যায় ডিম্বাণুগুলো বড়ো হচ্ছে কিনা। যখন  ডিম্বাণুগুলো বড় ও পরিপক্ক হয় তখন সেগুলোকে বাইরে নিয়ে এসে স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে ল্যাবেরেটরিতে ভ্রূণ সৃজন করা হয়। সেই ভ্রূণ স্ত্রীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। জরায়ুতে ভ্রূণ সংস্থাপন সম্পন্ন হওয়ার পরই তা ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপান্তরিত হওয়ার দিকে এগিয়ে যায়। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে এই প্রক্রিয়ায় সূচনার পর্বটুকু ছাড়া বাকি সময়টাতে শিশু একদম স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার মতই মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠে এবং সময় মতো সেখান থেকেই নবজাতকের জন্ম হয়। কোনো টেস্ট টিউবে এই শিশু বড় হয় না।
      স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করা নারীর সন্তান যেমন হয়, টেস্টটিউব বেবীও সেই রকম সুস্থ স্বাভাবিক মানবশিশু হয়ে জন্ম নেয় ও বড় হয়ে ওঠে। দু ক্ষেত্রেই গর্ভে সন্তান ধারণ করার একই রকম অপূর্ব অনুভূতি হয় মায়েদের। তাছাড়া টেস্ট টিউব বেবীকে পৃথিবীতে আনার পুরো পদ্ধতিতে প্রজননের জন্য স্বামী ও স্ত্রী ছাড়া আর কারুর ভূমিকা নেই। সুতরাং এই পদ্ধতির সাহায্যে অনেক অনেক সন্তানহীন দম্পতি বাবা-মা হওয়ার সুখ পাচ্ছেন। শুধু ল্যাবরেটরিতে নিষেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় এবং ল্যাবরেটরিতে অনেক টেস্ট টিউব থাকায় এই রকম নামকরণ। নিঃসন্তান দম্পতিরা সব দ্বিধা ঝেড়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাত ধরে এই প্রক্রিয়ার সহায়তা নিলে তাঁদের ভালো হ'বে। 
    সমাজসেবা ও বিজ্ঞান চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানহীন দম্পতিদের মুখে হাসি ফোটাতে মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগরে স্পন্দন হাসপাতালের বিপরীতে সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টার মানব কল্যাণে অক্লান্তভাবে নিয়োজিত। শত শত নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফুটিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এই সাফল্যের কারণ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধার ডা. কাঞ্চন কুমার ধাড়া ও ডা. সন্ধ্যা মণ্ডল আমাদের অবহিত করলেন। তাঁরা জানালেন যে সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টারের চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের পুরো টিমের নিষ্ঠা, নিরলস পরিশ্রম এবং সন্তান পেতে ইচ্ছুক দম্পতিদের পূর্ণ সহযোগিতায় এই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিনিয়ত এখানে কর্মযজ্ঞ চলছে।
  সিমবায়োসিসের এই সাফল্য ডাঃ কাঞ্চন কুমার ধাড়া ও ডাঃ সন্ধ্যা মণ্ডল-কে দেশ বিদেশের একাধিক সম্মান এনে দিয়েছে। তবে তাঁদের বক্তব্য, নিঃসন্তান দম্পতিদের মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দই হল চিকিৎসক হিসেবে তাঁদের সেরা পুরস্কার।

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments