জ্বলদর্চি

বিগ--শোর স্টেটপার্ক // ক্যালিফোর্নিয়া (ভ্রমণ কাহিনী) /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

বিগ--শোর স্টেটপার্ক // ক্যালিফোর্নিয়া  (ভ্রমণ কাহিনী) 

চিত্রা ভট্টাচার্য্য  
 
একঝাঁক অচেনা পাহাড়ি পাখিদের সুরেলা কণ্ঠের অবিরাম কোলাহলে খুব ভোর বেলায়  ঘুম ভেঙে  গেলো।কাঁচের দরজা ঠেলে ঘরের বাইরে এসেছি, জানলার ঠিক নীচে ডেকের এক কোণে কাঠের পাটাতনের ওপর গাঢ় নীল রঙের পাখির বাচ্চা টি বোধহয় দিন সাতেকের হবে ,জড়োসড়ো হয়ে ভয়ে বিধ্বস্ত ঘাড় টি গুজে বসে আছে। মনেহয় বেচারা স্বনির্ভর হয়ে আকাশে ডানা মেলে উড়তে গিয়ে নীচে পড়ে যাওয়াতেই যত বিপত্তি। দিশেহারা পক্ষী শাবক আর তাকে ঘিরেই অন্যান্য পাখিদের এত দুশিন্তা এত কলরব চলছে। ব্লুজয়ের বাচ্চা টিকে হাতের তালুতে যত্নে তুলে নিয়ে সামনের বড়ো চেরী গাছের ডালে বসিয়ে দিতেই ,চোখের নিমেষে ম্যাজিকের মত ভ্যানিশ হয়ে নাগালের বাইরে উড়ে গিয়ে বসলো অন্য এক গাছের ডালে। অবাক হয়ে ভাবি ছোট্ট পাখি হলে কি হবে ওর ডানায় কতো জোর!নির্বোধের মত কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।                                                                                                                                           মাথার ওপরের খোলা আকাশে মেঘলা মেদুর বিষণ্ণতা কোথাও নেই। ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছি    দিন চারেক হলো। এখানে জানুয়ারীর এই মাঝামাঝিতে প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে থোকা থোকা রৌদ্র মেঘের লুকোচুরি তে অজস্র পেঁজা তুলোর মত মেঘেরা ভেসে চলেছে ছুটির নিমন্ত্রণে। দূরের স্থির নিশ্চল ধ্যান মগ্ন পাহাড়ের গায়ে গত দিনের বৃষ্টি তে ভেজা গাছ গুলো সবুজে সবুজ। কাঠের বিরাট  লম্বা ডেক টি র রেলিঙের ধারে সাজানো টব গুলোতে নানা রঙের শীতের বাহারী ফুল লাল হলদে বেগুনী পপি ফুটেছে। প্রজাপতি আলোয় মেতে রঙিন পাখা মেলে কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায় সেই সাথে ছোট্ট এক রত্তি হ্যামিংবার্ড গুলোর চঞ্চল পাখায় হিল্লোল তুলে ফুলের গাছে চলেছে টহলদাড়ি। সমস্ত পাহাড়ি এলাকা জুড়েসৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত নির্মল পরিবেশের। বিশাল রেড উডের ঝাঁকড়া মাথার ওপরে নভ চরে দের বাসা তাদেরই আকাশে ওড়া উড়ির খবর পাই --পাখার ঝট পটানির আওয়াজ ভাসে বাতাসে। এত  সুন্দর সকালটিতে ঘরের ভিতরে অসম্ভব।
 মুহূর্তে প্ল্যান ঠিক করে, ব্রতীন দারুণ উৎসাহে বলে আজকের দিন টা চলো বিগ-শোর স্টেট পার্কে বেড়াতে যাই।       
                                                                                    চটপট ব্রেড ওমলেটে ব্রেকফাস্ট সেরে , তৈরী হয়ে বেরোতে আধঘন্টা সময় লাগলো।ক্যালিফোর্নিয়ার লসগাটোস কাউন্টির এ বাড়িটায় ওরা নতুন এসেছে এখনো চারিদিকের পরিবেশের সাথে তেমন পরিচয় হয়নি। মূল শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের উপত্যকায় বেশ অনেকটা উঁচুতে সিডার ইউক্যালিপ্টাস বার্চের এমন কি তেজপাতার ঘন ছায়ায় ঘেরা বনের মধ্য দিয়ে হাইওয়ের দিকে চলেছি। বন পেরোলে কোথাও দুদিকেই পাহাড়ের খাদ ,খুব সাবধানে ঢাল বেয়ে ঢালাই রাস্তায় সুবারুর চাকা গড়িয়ে চলেছে। আমি প্রচন্ড উত্তেজিত,বিদেশের রাস্তায় পথে বেড়াতে বেরিয়ে যা দেখি তাতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই। বার্চের ডালে পাতার ফাঁকে নীলখয়েরী তে মেশানো ম্যাগপাইয়ের সংসার।  নানা রঙের পাখির বাচ্চা গুলোর উল্লসিত  কিচির মিচির আর কোলাহলের  শব্দ বেশ দূর থেকেই কানে এলো। দুই দিকের গাছেদের ভীড় কাটিয়ে কাউন্টির রাস্তা শেষ হয়ে গেলে ,হাইওয়ের ওপর ড্রাইভ নিয়ে যাবো সানফ্রান্সিস্কো বে এরিয়ার থেকে মাত্র ১৪০ মাইল দূরত্বে। এই বিগ সী শোরে পৌঁছতে ,রাস্তায় বিশেষ  ভীড় না থাকলে গুগুল নেটে দেখাচ্ছে প্রায় সোয়া দুইঘন্টার মত লাগবে। গতবার সানহোসের  ক্যাম্বেল কাউন্টিতে যখন ছিলাম ওদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হ্যারি সাহেব এবং প্রতিবেশী ক্যামির কাছে এই বিগশোর সী বীচের অনেক গল্প শুনেছিলাম। ক্যামি ওর বয় ফ্রেন্ড রুবেল কে নিয়ে পাঁচ বছর আগের প্রথম মধুচন্দ্রিমা রাতের রোমান্সে ভরা স্মৃতির গল্প গড়গড়িয়ে এক বিকেলের কফির নিমন্ত্রনে আমায় শুনিয়েছিল।আর গল্প বাজ আমি মহা আগ্রহে শুনে ছিলাম।                                                                                                                       বিগশোরের উপত্যকায় সেপ্টেমবারের এক মনোরম চাঁদনী রাতের আবহাওয়ায় পাহাড়ের কোলে হোটেল সানসাইনের রিসোর্টে অর্কিডের বাগানে বসে সারারাত জেগে শুধু আকাশ ভরা এতো অগণিত উজ্জ্বল নক্ষত্র রাজি দেখে ওদের মনে হয়েছিল পৃথিবীর আকাশে যত তারা আছে সব যেন সেদিন বিগ-শোরের সমুদ্র তটের এই পাহাড় ছুঁয়ে নেমে এসেছিল -- ওদের জীবনের  একসাথে চলার নতুন রাত টি কে স্বাগত জানাতে। ওরা রাত ভর সমুদ্রের ধার ধরে হেঁটে ছিল সাগর তটের সীমানায়। সেদিন ঝকঝকে বড়ো গোল চাঁদের সাথে অসংখ্য তারা ও নেমে এসে ঢেউয়ের জলে আছড়ে পড়ছে। সে অতুলনীয় দৃশ্যে আত্মহারা হয়ে দুই জনে পাগল প্রায় হয়ে ছুটে ছিল বালুকাময় প্রান্তরে। মাইল খানেক রাস্তা এক আলোর পিছনে ধাওয়া করে তবু ও সে আলোর নাগাল পায়নি। শ্রান্ত পায়ে রাত গভীরে পাথরে হেলান দিয়ে বসে থেকে বুঝেছিলো এতক্ষণ শুধুই আলো ভেবে আলেয়ার পিছনে ছুটেছে ।  আসলে এসব সাগর সৈকতে এক রকম ফসফরাস আছে যা মাঝে মাঝেই আলোর মত জ্বলে ওঠে। উন্মত্ত সাগরের ঢেউয়ের এলোপাথালি পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ার রণমত্ত হুঙ্কার শুনে ওরা এক আনন্দ ময় রাতপার হয়ে ভোরের সূর্য ওঠা দেখেছিল।   ওর বদ্ধমুল ধারণা অত তারায় ভরা আকাশ দেখে জীবনের পথ চলা শুরু করে ছিলো বলে ওরা আজো এতো সুখী কাপেল।                              ক্যামি বলে, বিগ-শোর ক্যালিফোর্নিয়ার এতো চমৎকার সুন্দর এক জায়গা যে সপ্তাহ শেষের দুটো ছুটির দিন অন্তত এখানে কাটালে প্রাকৃতিক সান্নিধ্যে মন আনন্দিত হবেই।                                                                                                                          মেনরোডের ধারে বাসস্টপে ইয়াম দাঁড়িয়ে আছে পরভীন কে নিয়ে। ওদের আজ অফ ডে । ভীষণ হুল্লোড়ে ,আমোদ প্রিয় দুজনেই খুব বেড়াতে ভালোবাসে। গাড়িতে উঠেই পরভীন গল্প শুরু করে দিলো। ওরা দুজনেই ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে সোসিওলজি নিয়ে গবেষণায় রত।  কথার ফুলঝুরি সারাক্ষণ  হৈ চৈ করে চলতে ওদের জুড়ি নেই। ইয়ম বলে হাইওয়ের উত্তর দিক ধরে গেলে Monterey Bay এবং দক্ষিণ প্রান্ত ধরে এগোলে  Hearst Cassel পড়বে। ব্রতীন বলে বহুবার এসেছি এ পথে আমাদের উত্তর দিক ধরেই চলতে হবে। নাগরিক জীবন কে পিছনে ফেলে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে মাথার ওপর নীল আকাশে মেঘেদের সাদা ভেলায় ভেসে বেড়ানোর অপার্থিব সৌন্দর্যময় রৌদ্রজ্জ্বল সকালে কালো পীচ বাঁধানো সড়ক পথের মাঝখান দিয়ে চলেছি , দুই পাশে পাহাড়ের গায়ে পাইনের সবুজ নয় অদ্ভুত হলুদ বরণ পাতার গাছের সারি দেখেছিলাম অনেকটা ছোট আকারের মেপেল পাতার মত। জানিনা এই গাছের নাম কি ? ভাবছি এখানের গাছ গুলোর হয়তো পাতার রঙ হলুদ বা এরা শীতের মরশুমে এমন রং নিয়েছে। সবুজ ঢালাও মাঠ, বাচ্চাদের খেলার পার্ক ও সাজানো রয়েছে।পথের পাশে কোথাও লেকের জলে আকাশের ছায়া পরেছে।সূর্যের আলোয় ঝিলমিলিয়ে জল রাশি দুই পারে  বয়ে যায়। হাইওয়ের সীমা শেষ হলে,পথ বাঁক নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছে।   

              অনেক দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি খাড়া রুক্ষ তামাটে ঝামা পাথরে ভরা পর্বতমালা তার বিশাল দেহটি নিয়ে অর্দ্ধ নিমজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাগরের বুকে। বিগশোর সমুদ্র তটে এখন মধ্যদুপুর। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেড়াতে আসার দর্শনার্থীর লম্বা ভীড় ,গাড়ির পার্কিং করে ধীরে ধীরে পা ফেলে সমুদ্র তটে সোজা দৃঢ়ভাবে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তামাটে বর্ণ রুক্ষ কর্কশ পাহাড়ের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালাম।গাড়ি থেকে নেমেই  রক্তিম পাহাড় ক্ষয়ে ছড়িয়ে থাকা গেরুয়া মাটির পথে ইয়ম পরভীন দুজনে বাচ্চাদের মত প্রায় দৌড় লাগালো। গিরি খাত আর সমুদ্রের সাথে দূরের আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য বৃক্ষ রাজি। প্রশান্ত মহাসাগরের শ্যাওলা সবুজ জলের উন্মত্ত ঢেউয়ের আঘাতে পাহাড়ের পাথুরে শরীর লবনাক্ত সাদা ফেনা জড়িয়ে ক্রমাগত সিক্ত হয়ে চলেছে। অপরূপ সে দৃশ্য। মনে হলো,অলক্ষ্যে থেকে এক দক্ষ শিল্পী তার সূক্ষ্ম রং তুলির টানে আকাশের ক্যানভাসে প্রতিনিয়ত ছবি এঁকে চলেছেন।                                                                                                                 
              বিগ-শোর এই সী বীচ টি  সেন্ট্রাল ক্যালিফোর্নিয়ার কার্মেল এবং সান সিমিওনের যেখানে সান্তা লুসিয়া পর্বত মালার সঙ্গম স্থল টি আছে, সেখানে ভারী দৃষ্টি নন্দন এবং  মনোরম। সেই কেন্দ্র বিন্দু থেকে হঠাৎ যেন উৎসারিত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগর আছড়ে পড়ছে মধ্য উপকূল রেখার একটি রুক্ষ ও বহুদূর প্রসারিত পাহাড়ের পা ছুঁয়ে। এই দর্শনীয় বীচ টি  সারা পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য ৩৫ টি পর্যটন কেন্দ্রের  মধ্যে অন্যতম সেরা। সাগর উপকূলে এসে পরভীন সাইন বোর্ড দেখিয়ে বলে এই বিগশোর ষ্টেট পার্ক টির খেয়াল করে দেখো একটি সক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। স্প্যানিশ ভাষা থেকে এসেছে বিগ শোর নামটি। এই পার্কটির  নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই।  এই অঞ্চলের শুরুর দিকে স্প্যানিশরা মন্টেরে সী বীচের দক্ষিণে বিস্তৃত এবং অপেক্ষাকৃত অনাবিষ্কৃত উপকূলীয় অঞ্চল টিকে উল্লেখ করেছে এল পাস্ গ্রান্ডে দেলসুর্যার বলে  যার অর্থ দক্ষিণের বড়ো দেশ। একে সংক্ষেপে এল সুর গ্র্যান্ডে বলা হতো। সমুদ্র উপকূলের প্রবাহিত বড়ো দুটি নদীর নাম দেওয়া হয়েছিল এল রিও গ্র্যান্ডে দেল সুর এবং এল রিও চিকুইটো দেল সুর। এই স্প্যানিশ শব্দ গুলো মিস্টার হ্যারি গল্পের ছলে অনেকবার বলেছিলেন। সেদিন ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম বলে আজ ও বেশ মনে আছে।                                                                                                               ব্রতীন বলে, লক্ষ্য করে দেখো ,মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের অনুন্নত উপকূল রেখার দীর্ঘতম ও সর্বাধিক প্রসারিত এই অঞ্চল টি কী  সুন্দর,দৃষ্টি নন্দন! উঁচু উঁচু তামাটে রক্তিম পাহাড় দৃঢ় বদ্ধ হয়ে প্রসারিত আদি অন্তহীন জলরাশি থেকে যেন হঠাৎ আবির্ভুত হয়েছে দৃঢ়চেতা উন্নত শির। নির্বাক নিঃস্বর্গর সাথে অশান্ত সমুদ্রের উচ্ছলতা তাই বিশেষ আকর্ষণের দাবী রাখে। পাহাড় যেন হঠাৎ জেগে উঠে মাথা তুলে সটান দাঁড়িয়েছে সফেন অতল নীল জলের প্রবাহের বুকে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এক মনোরম স্থান হয়ে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের পর্যটন বিভাগের একটি উজ্জ্বল জাতীয় সম্পদ হয়ে আছে।
 এখানে রেডউডের বনে হাইকিং করা যায় ,সুদূর প্রসারিত সমুদ্র সৈকত এবং সাগর জলে কলেজ পড়ুয়াদের ঢেউয়ের বুকে রাফটিং চলছে খুশী তে।অন্যান্য বিনোদন মূলক কত সুযোগ সুবিধা থাকায় এই বিগশোর স্টেট পার্ক টি প্রায় এক মিলিয়ন লোকের একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে।  ইয়ম বলে পরের বার এখানে ওরা অবশ্যই আসবে ক্যামপিং করতে। হাইকিং করে আরেকটি প্রান্তে পৌঁছে পাহাড়ের ধারে কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গায় টেন্টে রাত কাটাবে।                                                                                                -  ব্রতীনদের গ্রূপে জোরদার আলোচনা চলছে, ইয়ম মধ্যমণি হয়ে হাত নেড়ে ওর সুদীর্ঘ্য বক্তব্য রাখছে।আমি এস.বি. এগিয়ে চলেছি সমুদ্র তীরের উপকূলবর্তী পাথুরে পথ ধরে। শুনেছি এই ,স্থান গুলোর অহরহ বেশ প্রাকৃতিক রূপের পরিবর্তন ঘটে এবং ভ্রমণার্থিদের কাছে এই পরিবর্তন দারুণ  কৌতূহলের। নির্জন পাহাড়ি খাদ থেকে নীলের সাথে বেগুনী রঙের মিশ্রনে এক ধরণের বালি সমুদ্র সৈকতে ছড়িয়ে আছে। এই ধরণের বালি পেসিফিকের অন্যান্য সী বীচে দেখিনি। ব্রতীন রা ওদের আলোচনা শেষে দেখি এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরভীন হৈ হৈ করে গলা উঁচিয়ে বলা শুরু করলে, ইয়ন ধমক লাগায় এখানে "কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না আস্তে কথা বল''। পারভীন নিজেকে সামলে  লজ্জিত ও সংযত হয়ে গলার স্বর নামিয়ে ,চিন্তিত মুখে বলে দেখার মত ছয়টি বিশেষ সী বীচ আছে সবক'টি বীচ এই কয়েক ঘন্টায় দেখা সম্ভব নয়।এই বীচ গুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব ও অনেকটা  আমরা আর কোন বীচে যাবো?আপাতত এসেছি পেফিফার বীচে। সামনের সাইনবোর্ড টি তে দেখি বড়ো করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা  Pfeiffer Beach C,A 93020 USA।                                                                                                                                       বিগশোরের কাছে প্রশান্ত মহাসাগরের  যে অন্তহীন সৈকত ভূমি গুলো দেখার  প্ল্যান করেছি  --তারমধ্যে অন্যতম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত এই পেফিফার বীচটি।  ওরে বাবা এখানে কী ঠান্ডা  হাওয়ার জোর যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আর তেমনি দাপুটে সমুদ্র ! ভাঙা রুক্ষ পাথরের চট্টানে রোষে ঝাঁপিয়ে পরছে ! উঃ কি বিশাল প্রসারিত এর তট সীমানা। কিছুটা এগিয়ে এসে দেখি এখানে একটি অত্যাশ্চর্য্য কাস্তের ফলার মত অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতি মত দেখতে স্থান টি  বেশ শান্ত মনোরম। সী বীচে বালির প্রসারণ উঁচুপাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত। এই বীচ টি তে Pfeiffer ,key hole arch আছে  এবং  key hole এর মাধ্যমে সূর্য্যের চকচকে রশ্মি গুলো কে ধরে রাখা হয়। শীতকালের এখান থেকে ভোর বেলায় যেমন সূর্যোদয় উপভোগ করা যায় তেমনি এক অভাবনীয় মনোরম সুন্দর সানসেট ও দেখতে পাবার আশায় দর্শনার্থীরা বেলা শেষের অপেক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা নীরবে বসে সময় কাটায়।আমরা সানসেটের অপেক্ষায় বসে না থেকে রওনা দিলাম স্যান্ডডলার বীচে-- আরেকটি জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতে। এখানে ও ঠিক যেন কৃষ্ণা তৃতীয়ার একফালি চাঁদের মত বীচ টিকে দেখতে লাগছে। ক্যাম্ব্রিয়ার বুকোলিক গ্রাম এবং বিগশোর ভিজিটর সেন্টারের মধ্যবর্তী স্থানে স্যান্ডডলার বীচ টি যেন এক নিঃসঙ্গ দ্বীপের মত একাকী দাঁড়িয়ে প্রহর গুনে চলেছে। সাগর সৈকতে যেখানেই বেড়াতে গিয়েছি ,দেখেছি সী বার্ড আর পেলিক্যান দের নিপুন তৎপরতায় মাছ শিকারের দৃশ্য,এখানেও সেই দৃশ্যের বিরাম নেই ,যদিও এই দৃশ্য গুলো  আমার কাছে  মোটেই এক ঘেয়ে বিরক্তি কর লাগেনা। উত্তাল ঢেউয়ের দোলায় আন্দোলিত সাগর কে খুব কাছের থেকে দেখতে এক পাথরের ওপর সামান্য জলে পা ডুবিয়ে বসেছি ! ওরে বাবা যেন কারেন্ট খেলাম! সে তো বরফ জলে পা ডোবানো। বেশীক্ষণ পা ডুবিয়ে রাখা অসম্ভব। রূপালী স্যামন মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকটা ঠিক আমাদের দেশের বাঁশপাতা  মাছের মত দেখতে।চার দিকে মাছের গন্ধ। কিছু দূরে পাথরের ওপর বসে কয়েক জন মাছ শিকারে উৎসাহী সাহেব কে দেখলাম মাথায় বড়ো এক টুপি পড়ে জলের ধারে বিছানো পাথরের ওপর  ছিপ ফেলে বসে আছে। আরেক জন ছিপ সমেত কত বড়ো এক মাছ ধরেছে । আমায় দেখে হেসে কুটিপাটি যেন কতদিনের চেনা আমি। ব্রতীন বলে এই বীচটি মাছ ধরার অন্যতম বিখ্যাত জায়গা। বালু তট ধরে এগোলে দুই পাহাড়ের মাঝে যে পথ বেঁকে গিয়েছে ওখানেই ফিশারম্যান দের বস্তি ,আড্ডা আছে।                                                                                                               নির্বাক নিঃস্বর্গর সাথে অশান্ত সমুদ্রের উচ্ছলতা আমার  মন কেড়ে নিয়েছে। বেশ কিছুটা সময় ধরে মশগুল হয়ে এখানেই বসে ছিলাম কোনো খেয়াল ছিলোনা। হঠাৎ  দেখি আমার সঙ্গীরা কেউ কোথাও নেই। দলবল সমেত সব উধাও। আমি এই  অচেনা সাগর কিনারে একাকী পাহাড় তলে বসে আছি। পরিচিত মুখ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এমন কি তাদের টিকিটি ও কোথাও নেই। চুপ করে বসে রইলাম, আমার  অবস্থা টা ঠিক সকাল বেলার ওই উড়তে না পারা ডানা ভাঙা পাখিটার মত। জড়োসড়ো হয়ে ,অজানা আশঙ্কায় ভয়ে কাঁপছি। আমার থেকে কিছুটা দূরে অল্প বয়সী কয়েক টি ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন যাত্রা নিয়ে আলাপচর্চায় রত। আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে ডাকলে ও ওরা শুনতে পাবেনা। তবু গলায় যত জোর আছে তাই দিয়েই চেঁচাই হ্যালো,হাই। কিন্তু ভয়ার্ত গলায় কাঁপা আওয়াজ যে টুকু বেরোয়, পাহাড়ের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে সে আমার কাছেই ফিরে আসে।প্রচন্ড হাওয়ায় আর অজানা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। এমনি করে প্রায় ২০ মিনিট নিঃশব্দে বসে সময় গুনছি এক একটা মিনিট যেন এক একটা ঘন্টা। এখানের লোকজনের অন্যের ব্যাপারে কোনোই কৌতূহল নেই। কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় নেই। সুতরাং চুপ করে বসে ,আজগুবি দুশ্চিন্তায় চোখ ফেটে জল বেরোলেও ঠান্ডা মাথায় অপেক্ষা করতে হবে।  যখন ধৈর্য্য তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তখন দেখছি দূরে কয়েকটি কালো বিন্দুর মত মাথা পাথরের আড়াল থেকে সাবধানে  বালির স্তুপ  ডিঙিয়ে  এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এলে  সব আক্কেলজ্ঞান হীন আসামী দের কে দেখে মনেবেশ শান্তি পেলাম। কিন্তু  রাগে জ্বলন্ত কাঠের মত  জ্বলছি , দেখি এরা সবাই সমান উত্তেজিত। ইয়ন, পরভীনের মুখ চোখ লাল হয়ে গিয়েছে,ব্রতীন এস,বির ও একই অবস্থা , কথা বলতে চাইলেও বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। একটু ধাতস্থ হয়ে নিজেরাই বলে ,-- সী বীচে সমুদ্রের ধার বরাবর হেঁটে মাত্র হাফ কিমি মত এগিয়েছে তখনই বেশ ভীড় দেখে এগিয়ে যায়।ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে  দেখে প্রায় ১৬ ফুটের মত লম্বা চার  ফুটের মত চওড়া একটি চকচকে রূপালী বিরাট বড়ো great white shark , অন্তত  ১৫০০কেজি ওজন হবে কি তার অনেক বেশী ,তার সরু চাবুকের মত লেজের অংশ ও ধারালো বিরাট ডানা ,ঝাপ্টানো ,তেমন ই হিংস্র চোয়াল ,ছুঁচোলো মুখ,.নিস্তেজ ,আহত হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে কেমন করে অতো বড়ো দেহ টা  নিয়ে দুই পাথরের খাঁজে আটকে গিয়েছে। সমুদ্র বিজ্ঞানী,রেসকিউ টিমের সদস্য রা সী বীচের চলার পথটি ঘিরে আছে। তারই উদ্ধার কাজ দেখতে গিয়ে চুম্বকের মত সেখানে ওরা ও আটকে গিয়েছিল। কেমন তৎপরতার সাথে অতো বড়ো প্রাণী সার্ক টিকে উদ্ধার করে আবার জলে ফিরিয়ে দেওয়ার সে গল্প শুনতে গিয়ে আমি রাগ করতে ও ভুলে গেলাম। বরং সে দৃশ্য আমার দেখা হলো না বলে মন খারাপ লাগছিল।  এ বারে রাগ অভিমান ভুলে গাড়ির পার্কিং এর দিকে এগিয়ে চলেছি। সুবারু স্টার্ট নিলে, এস,বি বলে  এই সার্কদের প্রায় ২২৫ টি প্রজাতি দেখা যায়। এই হাঙ্গর বা সার্ক টি বৃহত্তর ল্যামনিফ্রম ( lamniform ) প্রজাতির।এরা সমস্ত প্রধান মহাসাগরের উপকূলবর্তী জলের মধ্যে বা ডেল্টার মধ্যেই ঘুরে বেড়াতে গিয়ে এখানে প্রবল স্রোতে ভেসে পাথরের মাঝে আটকে গেছে। প্রাপ্ত বয়স্ক সার্ক ২০থেকে ২৫ ফুটের মত লম্বা হয় এবং এর ,ওজন প্রায় ২,২৬৪ কে.জি মানে ৫০০০ পাউন্ড হয়। এরা ১৫বছর বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। প্রায়  ৩০বছর পর্যন্ত বাঁচে। এই গ্রেট হোয়াইট সার্ক গুলো হচ্ছে  পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম শিকারী মাছ  ,জলের ওপর ও নীচে দু জায়গাতেই এই একমাত্র প্রজাতির সার্ক গুলো এক কথায় সুদক্ষ শিকারী। এদের প্রিয় খাদ্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী জীব শিল ও সামুদ্রিক পাখি এবং মাছ। এরা মানুষ শিকার করে না তবে কোনো কারণে ভুল বশত এদের আঘাতে মানুষের মৃত্যু হয়।  সামুদ্রিক এই প্রাণী গুলো সম্বন্ধে এস,বি র  বিস্তর অভিজ্ঞতা। আমরা মুগ্ধ শ্রোতা।    
                                                                                        আমরা বিগ শোরের আন্দ্রুমোলেরা নামে সুন্দর নির্জন এক বীচে এসে পৌঁছলাম। বেলা শেষের পথে আকাশে তখন মেঘেরা দল বেঁধে ঘর ছাড়া বৈরাগীদের মত উদাসীন চালে উড়ে চলেছে নিরুদ্দেশে। শীতের হাড় হীম করা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এই বীচটি  অন্য আর একটি দর্শণীয় প্যাসিফিক উপকূল বরাবর বৃহত্তম স্টেট পার্কের অংশ। এখানে থেকে ১৬ কিমি হাইকিং ট্রেইলের মাধ্যমে পাহাড়ের পথে  যাওয়া  যায় তবে মাঝে মাঝে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝোরা নদী। এই নদী গুলো পার হওয়ার জন্য ফুট ব্রীজ গুলো শুধু গ্রীষ্মে খোলা থাকে। আমরা সেদিকে না গিয়ে আবার মন্তেরে বে উপকূলে ফিরে এসেছি। নিসর্গ শোভার তুলনা নেই ,এই সব দেশ গুলো প্রকৃতির সৌন্দর্য কে পরম যত্নে সংরক্ষণ করে। সাদা মিহি বালিতে চকচকে অভ্র ছড়িয়ে আছে ,মাঝে খয়েরী ঝামা পাথরের বড়ো বড়ো চাই গুলো  হঠাৎ জেগে উঠেছে।  নীলচে সাগরের জল আকাশের রঙ নীল ,সারাদিন ধরে সী বীচে সমুদ্র পাখিরা সাদা পাখা মেলে চক্রাকারে উড়ে বেড়ায়।  পাগল করা ঠান্ডা হাওয়া বইছে ,মুহূর্তে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। জনমানব হীন সাগরের তীরে প্রশান্ত মহাসাগরের উদ্দাম ঢেউ গুলো পাথুরে শিলার ওপরে বারবার আছড়ে পড়ছে। অপরূপা জলের রানী রুপালি সার্ক কে আমি দেখিনি। ওদের কাছে গল্প শুনে  মন খারাপ লাগার অন্তনেই। বেলা শেষে চায়না রেস্তোরাঁয় এসেছি। চিকেনের কষা ভেজিটেবল এগ ফ্রায়েডরাইস চিঙড়ির মালাইকারী ,মাহিমাহি মাছ  দিয়ে  লাঞ্চ পর্ব মিটিয়ে সাগর পাড়ে বসে দিন শেষের গোধূলির কমলা রাঙা আলোয় ডুবে সূর্যাস্ত দেখলাম। ধীরে ধীরে  রাতের আঁধার নামলে ঘরে ফেরার পালা। গা ছমছম করা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা বুনো পথের ইশারা তে চলেছি। ইয়নের সাথে পরভীন ও আজ রাতে আমাদের সাথেই থেকে যাবে। পাহাড়ের পাকদন্ডীর পথে গা বেয়ে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে উঁচুতে উঠে এখন লস গাটোসের বাড়ি ফিরছি। দূর থেকে দেখছি ঘুটঘুটে অন্ধকারে স্থির নিশ্চল ধ্যান মগ্ন পাহাড় সবুজ ঘন জঙ্গল কে  নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি । চারদিক ঘিরে টুনি বাল্বের কৃত্রিম ,আলোর ছটায় অন্ধকারে আলো গুলো জ্বলছে যেন সারি সারি দীপ মালার মত।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments