জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের রূপকথা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৪৯

জঙ্গলমহলের রূপকথা

সূর্যকান্ত মাহাতো


আমার কথাটি ফুরা'ল,
নটে গাছটি মুড়াল।
"কেন রে নটে মুড়ালি?"
"গরুতে কেন খায়?"
"কেন রে গরু খাস?"
"রাখাল কেন চরায় না?"
"কেন রে রাখাল চরাস না?"
"বৌ কেন ভাত দেয় না?"
"কেন রে বৌ ভাত দিস না?"
"কলাগাছ কেন পাত ফেলে না?"
"কেন রে কলাগাছ পাত ফেলিস না?"
"জল কেন হয় না?"
"কেন রে জল হ'স না?"
"ব্যাঙ কেন ডাকে না?"
"কেন রে ব্যাঙ ডাকিস না?"
"সাপে কেন খায়?"
"কেন রে সাপ খা'স?"
"খাবার ধন খাবনি? গুড়গুড়ুতে যাবনি?"

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তার "ঠাকুরমার ঝুলি" গ্রন্থের একেবারে শেষে "ফুরাল" শিরোনামে বাচ্চাদের দারুণ জনপ্রিয় এই  লেখাটি যোগ করেন। অর্থাৎ এই লেখাটি দিয়েই তিনি "রূপকথার" গল্প গুলোর পরিসমাপ্তি টেনেছেন। "ফুরাল" নামকরণটির মধ্য দিয়েই তিনি বলতে চেয়েছেন যে গল্প বলা তার শেষ হল। "ঠাকুরমার ঝুলি"তে আর কোন রূপকথার গল্প নেই। এই লেখাটি লেখার মধ্য দিয়েই সেটা তিনি প্রকাশ করেছেন।  আর ঠিক এই ভাবটুকু নিয়েই লেখাটির প্রথম দু লাইন 'প্রবাদে' পরিণত হয়েছে। কিংবা বলা যায় 'বাগধারা' রূপেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের কোনায় কোনায় এই লেখা পৌঁছে গেছে। বাচ্চাদের কাছে তো এই গল্প অত্যন্ত আদরের।

"আমার কথা ফুরাল/ নটে গাছটি মুড়াল" অনেকেই এই বাগধারার অর্থ করেছেন যে, 'নটে' শাক বাছতে বাছতে যে গল্প বা কাহিনী বলা হচ্ছিল তা এবার শেষ হয়েছে। এদিকে নটে শাক বাছাও শেষ হয়েছে। অর্থাৎ এখানে দুটোই শেষ হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, 'নটে গাছ থেকে পাতা তোলা' এবং 'গল্প বলা।'

জঙ্গলমহলে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয়ের "ফুরাল" শিরোনামে লেখাটি কিছুটা পরিবর্তিত রূপে প্রচলিত। বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো তার "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থের ৩৫১ পৃষ্ঠায় "রূপকথা" বিভাগে সেটার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন---

"আমার কহনী ফুরাল্য লট্যা গাছটি বুঢ়াল্য।
কেনে রে লট্যা গাছ বুঢ়ালি?--- গরুয় কেনে খায়।
কেনে রে গরু খা'স? বাগালে কেনে চরায় নাই?
কেনে রে বাগাল চরাস নাই? গুলিনে কেনে ভাত দেয় নাই
কেনে রে গুলিন ভাত দিস নাই?
ছাল্যা কেনে কাঁদে।
কেনে রে ছাল্যা কাঁদিস? পিঁপড়ায় কেনে কামড়ায়
কেনে রে পিঁপড়া কামড়াস? জল কেনে করে (পড়ে) নাই
কেনে রে জল করিস (পড়িস) নাই? বেঙ কেনে ডাকে নাই
কেনে রে বেঙ ডাকিস নাই? সাপে কেনে খায়
কেনে রে সাপ খাস?
আমার চাষ না বাস, আমার টুরি বেঙেই আশ।"

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয়ের উল্লিখিত 'নটে' গাছটি 'মুড়াল' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু জঙ্গলমহলে সেটা 'বুঢ়াল্য' বা বুড়ো হয়ে যাওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মিত্র মজুমদার মহাশয়ের "বউ" এখানে হয়েছে "গুলিন।" দক্ষিণারঞ্জন মহাশয়ের "বউ" রাখালকে ভাত দেয়নি, কারণ কলাগাছ সেই এঁঠো পাতা ফেলে পরিষ্কার করে না বলে। অন্যদিকে জঙ্গলমহলে প্রচলিত লেখাটিতে "গুলিন" বাগালকে ভাত দেয় না সে ভাত রাঁধতে পারেনি বলে। কারণ তার ছেলে কাঁদছিল। তাই সে ভাত রাঁধেনি। জঙ্গলমহলে এটা একটা অতি পরিচিত দৃশ্য। যে সব বাড়িতে ছোট ছোট শিশু থাকে সেই বাড়িতে ভাত রান্না অনেক দেরিতে হয়। কারণ শিশু যখন তখন নানা কারণে কেঁদে ওঠে। তার কান্না ভোলাতেই মায়ের অনেকটা সময় চলে যায়। শিশুর কেঁদে ওঠার মধ্যে অন্যতম একটা কারণ হল, পিঁপড়ের কামড়। এখানকার প্রায় সব বাচ্চাই মাটির ধুলোয় খেলে বেড়ায়। মা শিশুকে মাটিতে নামিয়ে দিয়েই ঘরের নানা কাজকর্ম করে। শিশু মাটিতেই হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। একাধিক লাল পিঁপড়েও মাটিতে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কামড়েই শিশুরা যখন তখন কেঁদে ওঠে। জঙ্গলমহলের একেবারে চেনা ছবি।

গল্পের একেবারে শেষ লাইনেও একটা পার্থক্য রয়েছে। জঙ্গলমহলে প্রচলিত লেখাটির শেষে সাপ কেন ব্যাঙকে খায় তার উত্তরে সাপ বলেছে, সে কোন চাষবাস করে না তাই ব্যাঙ তার খাদ্য। জঙ্গলমহলে প্রধান জীবিকা হল চাষবাস। সেকথাই এখানে বলা হয়েছে।

"আমার কথা ফুরাল/ নটে গাছটি মুড়াল বা বুঢ়াল্য", যাইহোক না কেন, এটা কিন্তু যে কোন গল্পের শেষে বলা হয় না। কেবলমাত্র 'রূপকথা' ধর্মী গল্পগুলোর শেষেই বলা হয়ে থাকে। জঙ্গলমহলের ঠাকুমারাও যখন নাতি-নাতনিদের 'বিধুমুখীর গল্প', 'সুখী ও দুখীর' গল্প, 'এক রাজার সাত ছেলে', 'এক রাজার সাত রাণী', 'এক রাজার সাত ছেলে ও এক মেয়ে', 'এক যে ছিল রাজা' ইত্যাদি সব রূপকথার গল্প গুলো বলে তার শেষে এই "নটে গাছটি বুঢ়াল্য" গল্পটি সুর করে বলেই বলে।

রাজা ও রানিদের গল্প শুনতে শুনতে, তাদের কল্পনার জগতে ঘুরতে ঘুরতে শিশুরা তাই ভাবতে থাকে কখন গল্প শেষ হবে। কারণ গল্পের শেষেই তো সুর করে "নটে গাছটি বুঢ়াল্য" বলা হয়ে থাকে। গল্প শোনার সময় শিশুরা যদিও চুপ থাকে কিন্তু "নটে গাছটি বুঢ়াল্য" বলার সময় তারা আবার চুপ থাকে না। গলা মিলিয়ে তারাও সুর দিয়ে উঠে। প্রতিদিন শুনতে শুনতে তাদেরও মুখস্ত হয়ে যায় কিনা।

এখন আর অনেকেই 'রূপকথা' শোনে না। ঠাকুমারাও আর নাতি-নাতনিদের সেভাবে রূপকথার গল্প শোনায় না। শিশুরা বড় হয়ে পড়ার বইয়ে কিংবা মোবাইলে কাটুন দেখেই সে 'রূপকথা'র জগতে প্রবেশ করে। কিন্তু তা অনেকটাই কৃত্রিম। গল্প বলা ও শোনার মধ্যে যে রস বোধ গড়ে উঠে তা অন্য কোনভাবেই আর হয় না।

আগে জঙ্গলমহলে বাচ্চারা অকারণে কোন বায়না করে কাঁদতে শুরু করলে রূপকথার নানা গল্প শুনিয়েই ভুলিয়ে রাখত। কখনো আবার দীর্ঘ পথ হাঁটার সময় শিশুদের পথশ্রম ভুলিয়ে রাখতেও রূপকথার গল্প শোনানো হত। রাত্রির খাবার বানাতে দেরি হলে বাচ্চা যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে তার জন্যও নানা রকমের রূপকথার গল্প শোনানো হত। এখন যে একেবারেই হয় না তা নয়। তবে বিরল বলা যেতে পারে।

জঙ্গলমহলে প্রচলিত রূপকথাগুলোর মধ্যে সেরকমই একটি রূপকথা হল--- এক রাজার সাত রানির গল্প। রাজার সাত জন রানি। তাদের কোন সন্তান হয়নি। রাজা দুঃখ প্রকাশ করলে এক সাধু তাকে একটি নির্দিষ্ট গাছের আম এনে রানিদের খাওয়াতে বলেন। রাজা প্রধান রানিকে আম এনে সাধুর কথা বলেন। সাত রানির মধ্যে ছোট রানি ছিলেন সব থেকে বেশি সুন্দরী ও রূপ যৌবনা। তাই অন্য রানিরা ছোট রানিকে খুব হিংসা করত। বড় রানিরা সকলেই সেই আম খেলেও ছোট রানিকে তারা ইচ্ছে করেই দেয়নি। ছোট রানি তখন ফেলে দেওয়া আমের আঁটি ও শিল-নড়া ধোয়া জল খান। পরে দেখা গেল ছোট রানিই গর্ভবতী হয়ে পড়েন। কিন্তু অন্য রানিরা হন না। রাজা ছোট রানির উপর খুবই সন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন। অন্য রানিরা তখন আরো বেশি করে ছোট রানির উপর হিংসা করতে লাগলেন। একবার রাজা রাজ্য ভ্রমণে বেরোবেন। তাই তার ফিরে আসার পূর্বেই যদি ছোট রানির ছেলে বা মেয়ে হয় তাহলে যেন একটি ঘন্টা বাজানো হয়। পুত্র হলে সোনার ঘন্টা এবং কন্যা হলে রুপার ঘন্টা যেন বাজানো হয়। রাজা সেই শব্দ শুনে বুঝতে পারবেন এবং বাড়ি ফিরে আসবেন। যথা সময়ে ছোট রানি সাতটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন। কন্যা সন্তান প্রসবের সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাই অন্য রানিরা সেই সুযোগে  দ্রুত ছেলেমেয়েদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে গোবর গাদায় ফেলে দেন। এবং তাদের জায়গায় কিছু খাড়ি খোঁচা ও ঝাঁটা রেখে দেন। তারপর রুপার ঘন্টাটি বাজিয়ে দেন। রাজা সেই ঘন্টার শব্দ শুনে ফিরে এসে দেখেন আঁতুড় ঘরে কেবল খাড়ি খোঁচা ও ঝাঁটা। তিনি তো ছোট রানির উপর প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন। রেগে গিয়ে ছোট রানিকে ঘড়াশালে নির্বাসিত করলেন।এবং ক্ষোভে দুঃখে রাজা ফের রাজ্য ভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে রানিরা ছেলেমেয়েগুলোকে গোবর গাদা থেকে সরিয়ে একটি কুমোরের গর্তে ফেলে দিলেন, যাতে শিয়াল ও কুকুরে খেয়ে ফেলে। কিন্তু কুমোর ও তার বউ ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে খুবই আনন্দিত হয়ে উঠলেন। তারাই তাদেরকে বড় করে তুলতে লাগলেন। একদিন ছেলে মেয়েগুলো 'কাঠের ঘোড়া' আর 'মাটির পুতুল' নিয়ে রাজার পুকুরে গেলেন। সেখানে রানিরা ছেলেমেয়েগুলোকে দেখেই চিনতে পারলেন। এবং খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তখন ছেলে মেয়েগুলোকে বাড়িতে ডেকে বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে মেরে ফেললেন। তারপর ছেলেমেয়েগুলোকে একটা গর্তে পুঁতে দিলেন। সেই গর্তে একটি গাছ হল। সেই গাছে খুবই সুগন্ধি আটটি ফুল ফুটল। ফুলের গন্ধে চারিদিক ম ম করতে লাগল। রাজা সেই খবর পেয়ে ফুল তোলার জন্য লোক পাঠালেন। 'পারুল বোন' ফুলটি তখন সুর করে বলে উঠলো---
 রাজামশাই ফুল খুঁজছে দিব কি নাই 
ভাইরে দিব কি নাই।
সাত ভাই তখন বলে উঠল,
দিঅনা দিঅনা ফুল পারুল বহিন সগগে ফেঁকো ডাল
এত এত ছেল্যা থাকতে মায়ের ঘড়াশাল।

ফুলেরা তখন হাতের নাগালের বাইরে উঠতে লাগল। কেউ সেই ফুল তুলতে পারল না। জতই হাত বাড়াচ্ছে ততই তারা উপরে উঠে যাচ্ছে। রানিরা, রাজা, রাজার  জট সাঙ্গপাঙ্গ কেউ সেই ফুলের নাগাল পেল না। তখন একটি ফুল বলে উঠল, "ছোট রানি যদি ঘোড়াশাল থেকে আসে তবেই ফুল তুলতে পারবে।" ছোট রানিকে দ্রুত সেখানে নিয়ে আসা হল। ছোট রানি আসতেই ফুলগুলো রানির কোলে ঝরে পড়ল। মায়ের কোলে পড়তেই ফুটফুটে সুন্দর ছেলেমেয়ে হয়ে উঠল ফুলগুলো। রাজা তো অবাক! তারপর সব ঘটনা শুনে অন্য রানিদেরকে রাজা রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন। ছোট রানীকে নিয়ে তারপর বেশ সুখেই রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।

তথ্যসূত্র: ঠাকুরমার ঝুলি/ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments