জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—কোরিয়া (এশিয়া)/তিনটি সাধারণ উপহার /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—কোরিয়া (এশিয়া)
তিনটি সাধারণ উপহার

চিন্ময় দাশ

এক গ্রামে থাকে এক গরীব চাষি। তিনটি জোয়ান ছেলে চাষির। জীবনে অভাব ছাড়া, তেমন কিছুই ছিল না মানুষটার। 
মারা যাওয়ার আগে, তিন ছেলেকে ডেকে বলল—তোমরা ভালোই জানো, জমিজমা, টাকাকড়ি বা সম্পত্তি বলতে, কিছুই নাই আমার তোমাদের দিয়ে যাওয়ার মতো। তবে সামান্য দুটো-একটা জিনিষ আছে বাড়িতে। সেটাই কেবল দিয়ে যাচ্ছি। 
বড় ছেলেকে পাথরের একটা জাঁতা দিল বাবা। মেজো ছেলেকে দিল একটা লাউ। ছোটকে দিল একটা ঢোলক।
বাবা বলল—আমি ভালোই জানি, নেহাতই মামুলি জিনিষ এগুলো। কিন্তু দুনিয়ায় এমন অনেক জিনিষই আছে, এমনিতে যার তেমন কোন মূল্যই নাই। কিন্তু যদি মগজ খাটিয়ে ব্যবহার করতে পারো, মূল্যবান কিছুও পেয়ে যেতে পারো। বলা যায় না, জীবনটাই হয়তো বদলে যেতে পারে তাতে। 
ছেলেগুলো কী উত্তর দেবে এ কথার? চুপ করে রইলো। বাবা বলল—এ গাঁয়ে পড়ে থেকে আমার কিছু হয়নি। তোমাদেরও হবে না। বেরিয়ে পড়ো ঘর ছেড়ে। সারা দুনিয়া পড়ে আছে সামনে। নিজের ভাগ্য নিজেরা খুঁজে নাও। 
ছেলেদের পরামর্শ আর জিনিষগুলো ধরিয়ে দিয়ে, বাবা মারা গেল। 
একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল তিন ছেলে। বাবার দেওয়া জিনিষগুলো হেলাফেলা করেনি কেউ। যত্ন করেই সাথে নিয়েছে তিন জনেই। গ্রাম ছাড়িয়ে একটা চার মাথার মোড়। তিন রাস্তায় যাবে তিন ভাই। বড় বলল—এক মায়ের পেটের ভাই আমরা। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকিওনি কোন দিন। আজ এই প্রথম নিজের নিজের রাস্তায় রওণা দিচ্ছি। একটা কাজ করা যাক।
অন্য দুজনে বলল—বলো, কী কাজ?
বড় বলল—ঠিক এক বছর পরে, এই পাহাড়তলিতে, তিন মাথার মোড়ে এসে মিলিত হব আমরা। ভুলে না যাই যেন। 
তিন জনেই রাজি হোল, বছর ঘুরলে, এইখানে এসে হাজির হবে তিন জনে। একে অপরকে বিদায় জানিয়ে, তিন রাস্তায় চলে গেল তিন জন। 
বড় ভাই ধরেছে বামের রাস্তা। বাবার থেকে সে পেয়েছে জাঁতাটা। কত দূর যাওয়ার পর, খাড়াই শুরু হোল। খানিক বাদে শরীর যেন আর চলে না। পা টনটন করছে। দেখতে দেখতে সূর্যও ঢলে পড়ল পশ্চিমে। পাহাড়ি পথে অন্ধকার নেমে আসে হুড়মুড় করে। কাছাকাছি কোন মানুষের বসবাস নাই। জন্তু জানোয়ার থাকতে পারে জঙ্গলে। রাতের মত একটা আশ্রয় তো চাই।
বড়সড় একটা গাছ দেখে, তাতে চড়ে বসল ছেলেটা। ডালের খাঁজে জাঁতা রেখে, তাতেই মাথা দিয়ে গা এলিয়ে দিল। সাথে সাথেই ঘুম এসে গেল চোখে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, হিসাব নাই। কীসের যেন আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল। 
নীচে তখনপাঁচ-ছ’জন চোর এসে বসেছে কাজ সেরে। টাকাকড়ি ভাগ করছিল তারা। সর্দার ভাগে গোলমাল করছে। তাই নিয়ে বিবাদ শুরু হয়েছে তাদের। একজন বলছে তোমার ভাগে এতো বেশি কেন? অন্যজন বলছে—আমি কি কম খেটেছি নাকি? আমার ভাগে এই মাত্র? মাত্র এক হাজার ওন (কোরিয়ার উত্তর এলাকার টাকা)? হচ্ছেটা কী এটা? 
কথায় কথায় বেশ গোলমালই বেধে গেল একটা। তা দেখে, ছেলেটার মাথায় একটা ফন্দি খেলে গেলো চিড়িক করে। গায়ে যত জোর ছিল, জাঁতার হাতল ধরে ঘোরাতে লাগল। পাথরে পাথরে ঘষা লেগেছে। একটা গম্ভীর ঘরঘর আওয়াজ! চমকে গেল চোরগুলো। এদিক ওদিক দেখল চোখ রগড়ে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তাহলে শব্দটা কিসের? 
বেশ বোঝা গেল, ঘাবড়ে গিয়েছে লোকগুলো। ছেলেটা করল কী, জাঁতার উপরের চাকিটা তুলে নিয়ে, দুম করে ফেলে দিল লোকগুলোর ওপর। আর যায় কোথায়? কী পড়ল, কোথা থেকে পড়ল—দেখাশোনার তর সইল না তাদের। পড়ি কি মরি করে যে যদিকে পারল, দৌড় লাগালো। পিছন দিকে তাকাবার সাহসও হোল না কারও।
যদি ফিরে আসে লোকগুলো? তখন প্রাণে মেরে ফেলবে। ছেলেটাও নীচে নামল না। গাছেই বসে রইল ঘাপটি মেরে।
খানিক বাদে আলো ফুটে উঠল। ছেলেটা গাছের উপর থেকে দেখে নিল, কেউ আসছে না কোন দিক থেকে। ধীরে সুস্থে নীচে নেমে, তার চোখ জোড়া তো ছানাবড়া!
এত টাকাকড়ি, সোনাদানা- এখন সব তার? ভাবতেই পারছে না সে। চটপট সব গুছিয়ে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে গেল নীচে। 
অনেক জমিজমা কিনল। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, শুকর কত কিছু। এক জোড়া ঘোড়া কিনল তেজিয়ান। পেল্লাই বাড়ি বানিয়ে বাস করতে লাগল থিতু হয়ে। 
মাসখানিকও গেল না। গাঁয়ের মোড়ল এসে ধরে পড়ল খুব করে। মোড়লের মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল চাষির বড় ছেলের। বউ নিয়ে বেশ সুখে গুছিয়ে সংসার করতে লাগল ছেলেটা।
        ……            ……            ……
   মেজো ছেলেটা চলেছে সামনের রাস্তা ধরে। কতদূর চলতে চলতে দিন শেষ হয়ে গেল। একটা চ্যাটালো পাথর দেখে, তাতেই শরীর এলিয়ে দিল ছেলেটা। 
তারপর রাত নামল ঘন অন্ধকার নিয়ে। অন্ধকার বলে অন্ধকার! ছোট্ট একটা তারাও নাই আজ আকাশে। ঘুম এসে গেল ছেলেটার চোখে। 
খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। ঘুম ছুটে গেল খিদের চোটে। উঠে বসেছে। এবার ঠাওর হোল, পুরাণো একটা কবরখানা এটা। কবরে ঢাকনা দেওয়া পাথরে বসে আছে সে। বেশ ভয় করতে লাগল। কিন্তু এখনএই রাত্তিরে আর করবারও কিছু নাই।
ভাবতে না ভাবতেই, ঘটে গেল ভয়ের ঘটনাটা। কিসের একটা শব্দ ভেসে আসছে। কান পেতে বোঝা গেল, এদিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা। টুক করে পাথর থেকে গড়িয়ে, নীচে নেমে পড়ল ছেলেটা। আড়ালে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। 
শব্দটা কাছাকাছি হতে, বোঝা গেল, মেয়েদের গলার আওয়াজ। কারা যেন কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে এদিকে। ছেলেটা ভেবে পেল না, এত রাতে এই কবরখানায় কী কাজ মেয়েদের? ভয়ডর বলেও কি কিছু নাই?
যে কবরটার পাশে লুকিয়ে আছে মেজো, ঠিক সেটাতেই এসে হাজির হয়েছে এক দল পরী। জ্যোৎস্না রাতে বেড়াতে বেরিয়েছে পরীরা। যেখানে এতক্ষণ মেজো বসেছিল, কবরটার সেই ঢাকনা-পাথরে এসে বসল সবাই। 
মেজোর তো বুক ঢিপঢিপ। ধরা পড়ে গেলে সর্বনাশ। কিন্তু এখন আর কিচ্ছুটি করবার নাই। নড়াচড়া করতে গেলেই বিপদ। তাতেই ধরা পড়ে যাবে। দম আটকে, মড়ার মতটি হয়ে পড়ে রইল চুপ করে।  
কতক্ষণ ধরে চলল পরীদের হাসি গল্প। ফষ্টিনষ্টি। এ ওর গায়ে ঢলে পড়া। হাসি মস্করা কৌতুকে মেতে আছে সবাই। আর, কী মিষ্টি গলা পরীদের! হঠাত এক পরী বলল—হায়রে, আমার একটা পালক ঝরে গেল।
সবাই বলল—কী আর করা যাবে? খসেই যখন গেছে। থাক পড়ে। 
একজন বলল—কেউ যদি ফুল দিতে আসে এই কবরে, তার চোখে পড়বে পালকটা। 
আর একজন পরী বলল—কেউ তো আর জানে না, পরীর ডানার পালকের কী গুণ! মরা মানুষকে ছোঁয়ালে, সেও বেঁচে ওঠে।
অন্য একজন বলল—এ দেশের রাজার মেয়ের তো কঠিন অসুখ। বাঁচার কোন আশাই নাই। এই পালক যদি ছোঁয়াতে পারত কেউ, বেঁচে যেত মেয়েটা।
অন্যেরা বলে উঠল—রাজা থাকুক তার মেয়েকে নিয়ে। আমাদের তানিয়ে চিন্তা কীসের!
ছেলেটার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাবার দেওয়া লাউটা ছিল হাতে। সেটা তুলে জোরসে এক আছাড় পাথরটার ওপর। আর যায় কোথায়? হুড়মুড় করে উঠে পড়ল পরির দল। ডানা মেলে, পালাতে লাগল কবরখানা ছেড়ে। 
এক ঝাঁক পরী আকাশে ডানা মেলে ফিরে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে চেয়ে রইল মেজো। চোখের পলকটিও পড়ে না তার।
ভোরের আবছা আলো। নীল আকাশে ধবধবে সাদা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে পরীরা। চোখ কি আর ফেরানো যায়? 
কিছুই আর দেখা গেল না এক সময়। তিড়িং করে ছোট্ট একটা লাফ। চাতালের মতো পাথরের স্ল্যাবটার ওপর উঠে এল মেজো। সত্যি সত্যিই একটা পালক পড়ে আছে পাথরের ওপর। কী ভালোই যে লাগল ছেলেটার। পালকটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কবরখানা ছেড়ে।
অনেক দূরের পথ রাজার বাড়ি। রাজার সদর দেউড়িতে এসে হাজির হোল যখন, দূপুর গড়িয়ে বিকেল হয় হয়। দরবার ভেঙে গেছে। রাজামশাই ভেতর মহলে। দু’দিন ধরে কত পথ হাঁটা। খাওয়া দাওয়া হয়নি ভালো করে। পোষাক উলুঝুলু। দেউড়ির পাহারাদার কিছুতেই তাকে ঢুকতে দেবে না। 
মেজো বলল—রাজামশাইকে খবর দাও। রাজকুমারীর প্রাণ বাঁচাতে এসেছি আমি। 
পাহারাদার তো হেসে আকুল। কতো বড়ো বড়ো কোবরেজ-বদ্যি এসে ঘোল খেয়ে গেল। আর কোথাকার কে তুমি এলে, রাজকুমারীকে সারিয়ে তুলবে। কেটে পড়ো ভালোয় ভালোয়। শূলে চড়তে হবে না হলে!
মেজো তো দমে যাওয়ার পাত্র নয়। কেটে পড়বে বলে, এতটা পথ পেরিয়ে আসেনি এখানে। সে রোয়াব দেখিয়ে বলল—ভালোয় ভালোয় খবর দাও রাজামশাইকে। নইলে, শূলে চড়তে হবে তোমাকেই।
একটু ঘাবড়েই গেল লোকটা। খবর দিতে চলল ভিতরে। রাজামশাই এলেন হন্তদন্ত হয়ে। ভিতরে নিয়ে যাওয়া হোল মেজোকে। 
মূল্যবান পালঙ্কে শুয়ে আছে রাজার মেয়ে। তবে একেবারে কঙ্কালসার চেহারা। বিছানার সাথে মিশে গিয়েছে যেন। মেয়েটা বেঁচে আছে কি নেই, তা-ই বোঝা যায় না—এমন অবস্থা।  
রাজামশাই এখন ডুবন্ত মানুষ। খড়কুটো পেলেও, আঁকড়ে ধরে। কাতর গলায় জানতে চাইল—মেয়েটাকে ফিরে পাবো আমি? 
মেজো বলল—আমাকে একটু একা দেখতে দিতে হবে। ঘরটা খালি চাই। 
ঘর খালি হোল। কপাট ভেজিয়ে, পালক বের করল ছেলেটা। তিন বার রাজকুমারীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত বুলিয়ে দিল পালক। পরীর ডানার পালক। ভোজবাজির মত কাজ হোল তাতে। চেতনা ফিরে এলো মেয়ের শরীরে। হাতে পায়ে মুখে সারা শরীরে লালিত্য ফিরে এল দেখতে দেখতে। এক সময় আড়মোড়া ভেঙে, পালঙ্কে উঠে বসল মেয়েটি। 
সামনে অচেনা এক যুবক। একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মেজোছেলে দরজা খুলে দিল ঘরের। মুখে হাসি। রাজাকে বলল- ভেতরে যান। মেয়ে তার বাবাকে খুঁজছে!
বলে কী মানুষটা? পড়ি কি মরি করে ভেতরে এল রাজা। বাড়িশুদ্ধ লোক ভেতরে ঢুকে পড়ল হুড়মুড় করে। তখন আর কোন আগল নাই। রাজকুমারী সেরে উঠেছে, বিশ্বাসই হচ্ছে না কারও। 
সেদিন সন্ধ্যেতেই দরবার ডাকা হয়েছে। জরুরী সভা। রাজা বলল—তুমি কীসের বদ্যি, আমি জানি না। কাজটা করেছ একেবারে যাদুকরের মত। আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা। তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ মেয়েটাকে। বলো, কী চাও? মুখ ফুটে যা চাইবে, তাই দেব তোমাকে। কথার নড়চড় হয় না আমার। 
--কিছু পাওয়ার লোভে তো আসিনি আমি। মেজো বলল—সারা রাজ্যের লোকে বলাবলি করছে, রাজার মেয়েটাকে বুঝি আর বাঁচানো গেল না। সে খবর শুনেই তো এলাম। কিছুই চাই না আমার। 
সভা শুদ্ধ লোক অবাক। কী বোকা রে বাবা? এমন হাঁদা হয়ও কেউ। চাইলে, এখনই অর্ধেক রাজ্যই দিয়ে দেবে রাজামশাই। আর, বলে কি না, কিছু চাই না!
এমন উত্তরে রাজাও অবাক। রাজা কিছু বলতে গেল। বুড়ো মন্ত্রী ছিল পাশে বসে। রাজার কানে কানে কিছু বলল বুড়ো। মুখ জোড়া হাসি ফুটে উঠল রাজার। আনন্দে মাথা নাড়তে লাগল। 
ধুমধাম করে রাজার মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল মেজোছেলের। ছিল বলতে গেলে পথের ভিখারী। এখন রাজার জামাই হয়ে বসেছে ছেলেটা। রাজা মারা গেলে, নিজেই তো সে রাজা হয়ে বসবে।
        ……              ……                 ……
ছোট ছেলেটা ছিল যেমন হাবাগোবা, তেমনি সাদাসিধে। কোন নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে চলা শুরু করেনি সে। কোন গন্তব্যও নাই তার। সামনের দিকে মুখ করে নিজের মনে হেঁটে চলেছে। 
কখন যে একটা বনের ভিতর ঢুকে পড়েছে খেয়ালই নাই ছেলেটার। গভীর বন। বাঘ ভালুকের ভয় তো আছেই। কিন্তু সেদিকে খেয়ালই নাই তার। বনের ঘন সবুজ রঙেই মন ভরে গেছে ছেলেটার। 
বাবা একটা ঢোলক দিয়েছে তাকে। সেটা বাজিয়ে নিজের মনে গান গাইতে গাইতে চলেছে সে। চলতে চলতে বন পাতলা হতে শুরু করেছে। হঠাৎই তার চোখ গেল সামনের দিকে। ঝাঁকড়া একটা পিপুল গাছ (স্থানীয় নাম বো গাছ, বা বোধিবৃক্ষ। যে গাছের তলায় বুদ্ধদেব বোধি বা মোক্ষ লাভ করেছিলেন।)। তার তলায় বড়সড় চেহারার একটা বাঘ। সামনের দুটো পা আকাশে তুলে, ঢোলকের তালে তালে নেচে চলেছে বাঘটা। 
আস্ত একটা জ্যান্ত বাঘ সামনে দেখে, ভয়ে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিছুই মনে হোল না ছোটর। তার ঢোলকের তালে বাঘ নাচছে—এই দৃশ্য দেখে ভারি ভালো লেগে গেল তার। 
মনের আনন্দে বাজনা বাজাতে লাগল সে। বাজনা বাজানো চলছে, চলছে পথ চলাও। বাজাতে বাজাতে ছেলেটা চলেছে। নাচতে নাচতে বাঘও চলেছে ছেলের পিছন পিছন। 
চলতে চলতে কখন যে বন পেরিয়ে গ্রামে এসে ঢুকে পড়েছে দুজনে, খেয়াল নাই ছেলেটার। গাঁয়ের লোকেদের তো চোখ ছানাবড়া। বানর নাচানো দেখেছে তারা। দেখছে ভালুক নাচানোও। কিন্তু ঢোলক বাজিয়ে বাঘ নাচানো? দেখা তো দূরের কথা। শোনেনিও কেউ কখনও। 
গ্রামের লোকেরা ধরে নিয়েছে, খেলা দেখাতে বেরিয়েছে ছেলেটা। তারাও এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরিয়ে, খেলা দেখাবার ব্যবস্থা করছে। সবাই পয়সাকড়ি দিতে লাগল। বেশ ভালোই উপার্জন হতে লাগল তাতে।
এভাবে গ্রাম থেকে শহর। শহর থেকে রাজধানি। চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল বাঘ নাচানোর খবর। ছোট ছেলেটার কাছে একদিন রাজার পেয়াদা এসে হাজির—চলো হে। রাজামশাই খেলা দেখতে চেয়েছেন। 
মেরাপ বাঁধা হয়েছে রাজবাড়ির মাঠে। কাতারে কাতারে লোক জড়ো হয়েছে মাঠটাতে। তিল ধারণের ঠাঁইটুকুও নাই যেন। 
সেদিন জীবনের সেরা বাজনাটা বাজালো ছোট ছেলেটা। গাইলোও বেশ গলা ছেড়ে। বাঘ পুরো সঙ্গত করে গেল সেদিন। বাঘের নাচটা নিজের চোখে দেখেও, যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না রাজার। 
নাচ শেষ হলে, রাজা বলল—কী দাম চাও, বলো। বাঘটা আমার চাই। মুখ ফুটে যা দাম চাইবে, তাই দেব তোমাকে। 
ছেলেটা রাজি নয়। এমনিতে সে একটু বোকাসোকা মানুষ। তবে, আজ একটু চালাকি এলো তার মাথায়। রাজাকে বলল—এ নাচ আমার বংশের রেওয়াজ। বাপ-ঠাকুর্দারাও করে গিয়েছে। আমি কী করে ছেড়ে দিই? 
এদিকে রাজাও নাছোড়বান্দা। যে করেই হোক, এ বাঘ তার চাই। রাজা বলল—ঠিক আছে। একটা কাজ করো তাহলে। বাঘ থাকবে আমার ঘোড়াশালে। চাইলে তোমাকেও ঘর দেব থাকবার। রাজবাড়িতেই। বাঘের দেখভাল আর নাচানোর কাজ করবে তুমিই। এমন গুণী ছেলে! গ্রামে গ্রামে পথে পথে ঘুরে বেড়াও, দেখতে ভালো লাগে না। ওসব আর করতে হবে না তোমাকে। তাছাড়া,  মাস গেলে, মাইনেকড়িও পাবে তুমি। এবার নিশ্চয় অরাজি হবে না। 
ছেলেটা এবার ভারি খুশি। বেশ একটা হিল্লে হয়ে গেল নিজের। কিন্তু এবার বাঘটার জন্য ভারি মায়া হোল তার। বনের প্রাণী। বলতে কী, বনের রাজা সে। রাজবাড়ির ঘুপচি গোয়ালে, দম আটকে আসবে তার। বেঁচে থাকাই দায় হবে বাঘটার। 
ছেলেটা বলল—আমার কোন আপত্তি নাই। আপত্তি হোল বাঘটাকে নিয়ে । বনের প্রাণী। ঘুপচি ঘরে বাঁচবেই না বেচারা। 
রাজা মাথা নেড়ে বলল—সেটা তুমি ঠিক বলেছ হে। অনুভব আছে তোমার। ঠিক আছে, অন্য ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তোমাকে। বনের দিক করে, পাঁচখানা গ্রাম জায়গীর দিলাম তোমাকে। বাঘ নিয়ে সেখানেই থাকবে তুমি। সকাল হলে, রাজবাড়িতে চলে আসবে। খাওয়া-দাওয়া মাইনে-কড়ি-- সব পেয়ে যাবে দরবার থেকে। এবার রাজী তো? 
মাথা ঝুঁকিয়ে, লম্বা একটা পেন্নাম ঠুকে দিল ছেলেটা। আর কী অবাক কাণ্ড! বাঘটা কী বুঝল, বাঘই জানে। ছেলেটার দেখাদেখি, সামনের দুটো থাবা জড়ো করে মাথায় ঠেকিয়ে দিল। 
বিশাল এক কলরোল উঠল মাঠ জুড়ে। রাজামশাইর আনন্দ যেন উপচে উপচে পড়ছে তখন। 
        ……            ……             ……
দেখতে দেখতে বছর পার হয়ে গেল। তিন মাথা পথের মোড়ে, তিন ভাই ফিরে এসেছে দেখা করবে বলে। তেমনটাই কথা ছিল তাদের। 
এক বছর বাদে, দেখা হয়েছে তিন জনের। তিন জনেই ভারি খুশি। কে কেমন আছে এখন, বলতে লাগল। কী করে অবস্থা ফিরেছে তাদের, কোথায় আছে এখন তারা-- সেই সব সাতকাহন করে শোনাতে লাগল ভাইরা।
হয়েছে কী, এক বুড়ি সেখানে বসে ঘাস ছিঁড়ছিল। ঘরে এক পাল খরগোশ আছে বুড়িটার। প্রতিদিন ঝুড়ি ভরতি ঘাস তুলতেই হয় তাকে। সেদিনও ঘাস ছিঁড়ছে। আর তিন ভাইয়ের কথাবার্তা শুনছে সব।
 সেই বুড়ির মুখ থেকেই তিন ভাইয়ের কাহিনী জানা গিয়েছিল। নইলে, কী করেই বা আর জানা যেত তিনজনের কথা। বাবার দেওয়া অতি সাধারণ তিনটে উপহার পেয়েছিল ছেলেগুলো। অতি নগণ্য জিনিষই। তা থেকেই কপাল ফিরে গিয়েছিল তাদের। সাধারণ জিনিষই যে কখন একেবারে অসাধারণ হয়ে ওঠে, আগে থেকে অনুমানও করা যায় না। 
পুরো ঘটনাটা জানা গিয়েছিল, ঘাসকাটা বুড়ির মুখ থেকে শুনেই।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments