জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৫৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ব্রহ্মানন্দজী একসময় বলেছিলেন, “ বিজ্ঞানানন্দ হল ব্রহ্মজ্ঞানী।” ভাগবতে ব্রহ্মজ্ঞ বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে -- জ্ঞানী হয়েও তিনি স্বরূপ বিষয়ে সচেতন না হয়ে বালকবৎ আচরণ করেন, তীব্র মেধাসম্পন্ন হয়েও তিনি নির্বোধের ন্যায় আচরণে লিপ্ত হন কোনওরকম বিশেষ পরিকল্পনা ছাড়াই। যদিও শিক্ষিত, কিন্তু জনপ্রিয়তা এড়ানোর জন্য তিনি উন্মাদ হয়ে ওঠেন। বেদ কথিত সত্যানুসন্ধানে ব্যাপৃত থেকেও তিনি গবাদি পশুর ন্যায় যত্রতত্র বিচরণ করেন কোনওরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই। বিজ্ঞানানন্দজীর জীবনধারা বুঝতে গেলে বেদের এই বর্ণনা অনুসরণ করতে হবে, নতুবা প্রতিনিয়তই তাঁকে ভুল বোঝার সমূহ সম্ভাবনা।
 বিজ্ঞানানন্দজীর অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর অপূর্ব রসবোধ। যদিও তাঁকে খুব রাশভারী প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হত। কিন্তু বালকবৎ সারল্য, কৌতুকপূর্ণ মেজাজ, সরস মন্তব্য প্রভৃতি কারণে অন্যকে হাস্যমুখর করে তুলতেন। ধর্মীয় জীবনে রসবোধের একটি বিশেষ স্থান আছে। যদিও বহু ধর্মে একে বিশেষ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় না। বস্তুতপক্ষে আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির একটি প্রক্রিয়া এই রঙ্গরসিকতা। কেননা একজন প্রকৃত বৈদান্তিক বা ব্রহ্মজ্ঞানী জানেন জগৎ স্বপ্নবৎ, তিনি একে নিয়ে মজা করতেই পারেন। 
 একদিন সন্ধ্যায় উপস্থিত ভক্তবৃন্দের কাছে আকাশের তারা বিষয়ে বললেন -- “ওরা আমার বন্ধু। কী সুন্দর জ্বলজ্বল করছে।” সঙ্গে সঙ্গে এক ভক্ত তাঁকে গল্প বলতে বললেন। বিজ্ঞানানন্দজী ব্যঙ্গ করে বললেন, “আমি কি তোমার ঠাকুমা?” আরও বললেন, “হ্যাঁ, সবই রূপকথার আজগুবি গল্প। যদি জগতকে অসত্য অবাস্তব বলে ভাব তাহলে তুমি কত সুখী হবে। সমস্যার উদ্ভব তখনই হয় যখন জগতকে সত্য বলে ভাবা হয়।” এই প্রসঙ্গে তিনি গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিসের কথা বলেন যিনি জগতকে স্বপ্নবৎ মনে করতেন। একদিন কতিপয় তরুণ ছাত্র তাঁর পা দড়িতে বেঁধে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে রাস্তার উপর দিয়ে যেতে থাকে। তাঁর সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এইরকম অবস্থায় তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করে --“আপনি কি এখনও মনে করেন যে জগত স্বপ্নবৎ?” ডায়োজেনিস উত্তর দেন --“হ্যাঁ, জগত স্বপ্নবৎ -- কিন্তু খুব কষ্টকর স্বপ্ন।”

 ১৯৩৩ সালে কলম্বো যাওয়ার পথে বিজ্ঞানানন্দজী মাদ্রাজ মঠে কিছুদিন অবস্থান করেন। একদিন তিনি যখন তাঁর পরিধেয় কোট, সোয়েটার, শার্ট ও টি শার্ট খুলছিলেন তরুণ সন্ন্যাসীরা কৌতূহলী হয়ে দেখছিলেন। একজন মন্তব্য করেন, “মহারাজ, শ্রীরামকৃষ্ণ অহংকে পেঁয়াজের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যদি কেউ পেঁয়াজের খোসা একের পর এক ছাড়িয়ে যেতে থাকে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আপনিও তেমনই পোশাক খুলছেন।” স্মিত হেসে বিজ্ঞানানন্দজী বললেন, “শরীরের ভিতর পাঁচটি আবরণ রয়েছে , আমি এর উপর আরও সাত আটটি আবরণ চাপিয়েছি। নতুবা লোকে আমার আত্মা দেখে ফেলবে।” সকলে হেসে ওঠে তাঁর এই কথায়।
 একবার বিজ্ঞানানন্দজী তাঁর এক শিষ্যকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি কোনওদিন ভূত দেখেছ?” শিষ্যটি উত্তর করল, “না।“ তখন তিনি বললেন, “আমাদের দেহে পাঁচটি ভূত রয়েছে। ভয় পেও না। রাম নাম কর। সব ভূত ভেগে যাবে। রাম নাম হয় যেখানে সেখানে কোনও ভূত টিকে থাকতে পারে না। ভূত শব্দের অর্থ যেমন প্রেত ইত্যাদি, তেমন বস্তুও। সেগুলি হল -- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। এগুলি দিয়েই তৈরি হয়  মানব শরীর, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।”
 এলাহাবাদে বিজ্ঞানানন্দজী এক তরুণ সন্ন্যাসীকে বলেন, “এখানে তোমাকে আমি কৃষ্ণের বাঁশি শোনাবো।” দুপুরবেলা সেই সন্ন্যাসীকে বাইরে সঙ্গে করে নিয়ে এসে দেখালেন একটি স্টিম রোলার রাস্তা সমতলের কাজ করছে। আর মাঝে মাঝে চালক বাঁশি বাজাচ্ছে। এই বাঁশির আওয়াজ শোনামাত্রই তিনি বললেন, “ওই দেখ কৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছেন!” সঙ্গের সন্ন্যাসীটি হাসিতে ফেটে পড়লেন। বিজ্ঞানানন্দজী আমোদের হাসি হেসে বললেন, “তুমি হাসছ কেন? শ্রীকৃষ্ণ যেমন নিঃস্বার্থভাবে জগতের মঙ্গলে ব্যাপৃত থাকেন, এই স্টিম রোলারও তাই।”
 ব্রহ্মজ্ঞ বিজ্ঞানানন্দ অন্যের মন পড়ে নিতে পারতেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “সত্য কথা বলবে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলবে না। যদি ভালোবাসার মানুষ হয় তাঁকে অপ্রিয় সত্য বলবে।” কার কীসে মঙ্গল হবে জিজ্ঞাসিত হলে বলে দিতেন। কোনও কোনও সময় তাঁর কথা মধুর শোনাত, কখনও কর্কশ। কারুর মন রেখে কিছু বলা বা সৌজন্যের খাতিরে সম্মতিসূচক কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। একদিন একটি ফ্যাশনদুরস্ত মডেল গার্ল আশ্রমে এসে  বিশৃঙ্খলভাবে তাঁর সামনে বসে পড়ে,  তারপর প্রশ্ন করে, “আমাদের প্রতি আপনার উপদেশ কী?”  তিনি উত্তর দেন, “অনেক খাও, কথা বল ও ঝগড়া কর।” মেয়েটি খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে যায়। সম্ভবত সে যে কলহপ্রবণ ছিলেন তা বিজ্ঞানানন্দজী বুঝতে পেরেছিলেন। তীক্ষ্ণ উত্তর প্রদান করে বাকি জীবন যাতে সে আর কলহ না করে সেই বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেন।
 এলাহাবাদে ( প্রয়াগ ) নতুন কেন্দ্র স্থাপন করেন বিজ্ঞানানন্দজী স্বামীজীর নির্দেশ অনুসরণ করে। বেলুড়ে সন্ন্যাসী আশ্রমের নির্মাণ কাজ শেষ হলে স্বামীজী তাঁকে এই নির্দেশ দেন। এলাহাবাদ বা প্রয়াগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তীর্থস্থান। কেননা এই স্থানটি গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এই তিন নদীর সঙ্গমস্থল। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানানন্দজী এলাহাবাদের দিকে রওনা দেন। কয়েকটি তীর্থস্থান দর্শনের পর শেষমেশ সেখানে পৌঁছান। প্রথমে তিনি বন্ধু ডা. মহেন্দ্র ওদেদারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। এরপর যান ব্রহ্মবাদিন ক্লাবে। ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত ধ্যান, প্রার্থনা, শাস্ত্রের ক্লাস ইত্যাদি করতেন। ভক্তিমূলক গান ও অধ্যাত্ম প্রসঙ্গও করতেন। বিজ্ঞানানন্দজীকে তাঁদের মধ্যে পেয়ে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হন। 
 একটি দোতলা বাড়ির উপরের তলায় দুটি ঘর ভাড়া করেন ক্লাবের সদস্যরা। ছোট ঘরটির মাপ ১০ বাই ১০ ফিট। এটিতে ছিল মন্দির। বড় ঘরটি ১৮ বাই ১৮ ফিট। এই ঘরটি লাইব্রেরি ও সভাঘরের জন্য ব্যবহৃত হত। ঘরগুলির সামনে ছিল ছাদহীন বারান্দা। বাড়ির পার্শ্বভাগ থেকে খোলা সিঁড়ি নীচের তলা থেকে বারান্দা হয়ে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ছাদে ছিল ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটি শৌচাগার, যা প্রতিদিন এক জমাদার এসে পরিষ্কার করে যেত। জল ও বিদ্যুতের কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। বিজ্ঞানানন্দজী রাস্তা থেকে মিউনিসিপ্যালিটির সরবরাহ করা জল সংগ্রহ করে রাখতেন। রান্না করতেন ( ভাত ও একটি তরকারি ) নিজ হাতে দুটি কেরোসিন স্টোভে, বাসনপত্র নিজেই মেজে নিতেন, এছাড়া আনুষঙ্গিক সমস্ত গৃহকাজ নিজ হাতেই সম্পন্ন করতেন।  রাতের বেলা শুতে যেতেন লাইব্রেরি ঘরে। নিয়মিত ধ্যান, জপ, শাস্ত্রচর্চা, প্রাণায়াম এবং শরীরচর্চাও চলত।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments