জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প – ইউরোপ (শ্লোভাকিয়া)অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় অনেক বড় /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোক গল্প – ইউরোপ (শ্লোভাকিয়া)
অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় অনেক বড়

চিন্ময় দাশ


এক ধনী লোকের দুই ছেলে। বড়ছেলেটি   যেমন বদমেজাজী, তেমনি লোভী। স্বভাবেও ভারি অসৎ ছেলেটা। অন্যের জিনিষ হাতিয়ে নেওয়া ছাড়া, মাথায় আর কিছু ভাবনা নাই তার। ছোট ছেলেটি কিন্তু একেবারেই বিপরীত চরিত্রের। যেমন সাধাসিধে, তেমনি দয়ালু। অন্যকে ঠকিয়ে বা চুরি করে নেওয়া তার স্বভাবে নাই। সেজন্য বড়ভাইটা তাকে বোকার বেহদ্দ বলে টিটকিরি দেয়।
দেখতে দেখতে ছেলে দুটো বড় হোল। তাদের বাবাও মারা গেল একদিন। মরবার আগে বলে গেল—যা কিছু ধন-সম্পত্তি রইল, দুই ছেলেই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবে। সমান সমান ভাগ হবে দুজনের। 
যত্তোসব বেয়াক্কেলে ব্যাপার! বড় ছেলেটা বলল—সব সম্পত্তি তো দুদিনেই উড়িয়ে দেবে এই হতভাগা। দুনিয়ার যেখানে যত ভিখিরি আছে, সব এসে হাজির হবে। আর মুঠো মুঠো টাকা বিলাতে থাকবে বোকাটা। চোখের পলক না ফেলতে, লোপাট হয়ে যাবে বাবার সব সম্পত্তি। এটা হতে দেওয়া যাবে না। কোন মতেই না।
নিজেই ঠিক করে নিল বড়ছেলেটা-- ওকে আমি একটা ঘোড়া আর তিনটে সোনার মোহর দেব কেবল। তার বেশি একটা কানাকড়িও পাবে না আমার কাছ থেকে। দিয়ে বলব, বেরিয়ে যা এখান থেকে। ব্যাস। আর যদি না শোনে, বা বেগড়বাঁই করে কিছু, তাহলে, কিছুই পাবে না আমার কাছ থেকে। খালি হাতেই বেরিয়ে যেতে হবে ওকে। 
ছোট ভাইকে ডেকে বলল—শোনরে, গাধা! বাবার সম্পত্তির কানাকড়ি পাওয়ারও হকদার নোস তুই। তবুও, মায়ের পেটের ভাই বলে কথা। তোকে আমি ঠকাবও না, বঞ্চিতও করব না। এই নে তিনটা সোনার মোহর। আর এই ঘোড়াটা। নিয়ে চলে যা এখান থেকে। কোনদিন আর এমুখো হবি না, এই বলে দিলাম। 
ছোট বলল—দাদা, তুমি কিন্তু অন্যায় করছো আমার সাথে। 
--যদি করেই থাকি, হয়েছেটা কী তাতে? ন্যায়ের চেয়ে অন্যায় অনেক বড়। যেমন তোর চেয়ে আমি বড়! ঠিক সেরকমটি, বুঝলি? বড় ভাই বলল—কথা বাড়িয়ে কাজ নাই। যা দিলাম, তাই নিয়ে সরে পড় এখান থেকে। নইলে, এগুলোও দেব না। 
একটা কথাও আর বলল না ছোট। একটা ঘোড়া দিয়েছে বড়, সেটার পিঠে চেপে, চলে গেল সেখান থেকে।
সেই যে গিয়েছিল, সত্যি সত্যি কোনদিন আর এমুখো হয়নি সে। একদিন হঠাৎ রাস্তায় দুজনের দেখা। 
ছোট বলল—ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, দাদা। 
বড় চিৎকার করে উঠল—খবরদার বলছি, ঈশ্বরের আশীর্বাদ আমাকে দিতে আসবি না। এই দুনিয়ায় ঈশ্বরের চেয়ে শয়তান অনেকই বড়। 
--তুমি ভুল করছ, দাদা। ভালো যেমন মন্দের চেয়ে বড়, তেমনই শয়তানের চেয়ে ঈশ্বরও অনেক বড়।
--এ ব্যাপারে তুই নিশ্চিৎ?
--অবশ্যই। নিশ্চিৎ হয়েই এ কথা বলছি আমি। 
শুনে, ভারি মজা লাগল বড়র। বলল—তাহলে একবার পরীক্ষা হয়ে যাক। ঈশ্বর বড়, না শয়তান বড়। ন্যায় বড়, না অন্যায় বড়। হয়ে যাক একটা ফয়শালা। তবে, বাজি ধরতে হবে কিন্তু। এক মোহর বাজি। এ পথ দিয়ে যে লোক প্রথমে আসবে, তাকেই বিষয়টা বলা হবে। সে যা রায় দেবে, সেটাই চুড়ান্ত বলে মেনে নেব আমরা। তুই এতে রাজি?    
ছোটর মনে কোন দ্বিধা নাই। সে অসঙ্কোচে জানিয়ে দিল—হ্যাঁ, আমি রাজি।
বেশি সময় গেল না। প্রথম যে লোকটা এল সে পথ দিয়ে, সে এক সন্ন্যাসী। আসলে হয়েছে কী, লোকটা কিন্তু আদপেই সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসী কিছু নয়। সে হোল শয়তান। সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে এসে হাজির হয়েছে। 
আলোচনার বিষয়টা বলা হোল তাকে। একটু মুচকি হাসল সন্ন্যাসী। জবাবে বলল—এ নিয়ে আলোচনার তো কিছু নাই। যা দিনকাল, এ দুনিয়ায় ঈশ্বরের চেয়ে শয়তান অনেক বড়। তেমনি, ন্যায়ের চেয়ে বড় অন্যায়। 
মুখে কিছু বলল না ছোট। জোব্বার পকেট থেকে একটা মোহর বের করে, দাদার হাতে ধরিয়ে দিল। 
বড়ভাই ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল—কীরে, এবার তো বুঝলি, আদতে কে বড়!
 ছোট আগের মতোই দৃঢ় গলায় বলল—না, দাদা। নতুন করে কিছু বোঝার নাই আমার। আমি খুব ভালো করেই জানি, শয়তান কখনোই ন্য, ঈশ্বরই বড়। অন্যায়ের চেয়ে বড় হোল ন্যায়।  
--তোর কেবল ঈশ্বর আর ঈশ্বর! বড় বিরক্ত হয়ে বলল—ঠিক আছে, আর একবার পরীক্ষা করবি?
--অবশ্যই করব। আমার আপত্তি নাই। 
লোভে চোখ চকচক করছে বড়র। যদি আরও একটা মোহর জুটে যায় কপালে। বলল—বাজিটা কিন্তু থাকবে।
ছোটর গলা কাঁপল না। বলল—থাকুক তোমার বাজি। আমি ভয় পাই না।
বড় বেশ খুশি—ঠিক আছে তাহলে। দেখা যাক, এবার যে আসবে, তাকেই বলব ফয়সালা করে দিতে।
এবার এল এক বুড়োমানুষ। দেখলে, চাষী বলেই মালুম হয়। আসলে কিন্তু সেই শয়তান। এবার এসেছে বুড়ো চাষীর ভেক ধরে।
সব শুনেটুনে একটু হাসল সে। বলল—এসব আজগুবি ভাবনা আসে কেন তোমাদের মাথায়? বয়স তো কম হোল না। দেখলামও কত কিছু। বেশ ভালো করেই বুঝেছি, তোমাদের ঐ ঈশ্বর-টিশ্বর কেউ নয়। শয়তানই বড় সবার চেয়ে। 
এবারও মুখে কোন কথা নাই ছোটর। একটা মোহর বের করে দাদাকে ধরিয়ে দিল। বড় বলল—এবার অন্তত মানবি, শয়তানই বড়। 
ছোট বলল—কখনোই না। তা হতে পারে না কোনদিন। 
বড় বলল—কথায় বলে না, বার বার তিন বার। আর একবার বাজি ধরবি না কি?
--তুমি চাইলে ধরতেই পারো। কিছুতেই আপত্তি নাই আমার। 
আবার বাজি ধরা হোল। আবার সেই শয়তান হাজির ছদ্মবেশে। এবার এসেছে গোয়ালা সেজে। কাঁধে একটা বাঁক। দুদিকে ফেনা ওঠা দুধে ভরা দুটি কলসি ঝুলিয়ে। এবারেও শয়তান আর অন্যায়ের পক্ষেই রায় হোল। ছোটর পকেট থেকে তিন নম্বর মোহরটা চলে গেল বড়র হাতে।
বড় হাসতে হাসতে বলল—বাকি রইল কেবল তোর ঘোড়াটা। হবে না কি শেষবার? 
ছোট বলল—বলেছি তো, আমার কোন আপত্তি নাই। তুমি চাইলে, ধরতেই পারো বাজি। 
এবার দূর দেশী বণিক সেজে এসেছে শয়তান। আবার একই রায় তার। বলল—দুনিয়ার দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। কত কিছুই দেখি। কত কিছুই শুনি। তা থেকেই বুঝেছি, অন্যায়ই বড় সবার চেয়ে।
শেষ সম্বল ছিল ঘোড়াটা। এবার সেটাও হারালো ছোট। কিন্তু বিশ্বাস থেকে নড়ল না একটুকুও। উলটে বলল—হারাবার আর কিছুই নাই আমার। তবুও আমি বিশ্বাস করি, অন্যায়ের চেয়ে ন্যায়ই বড়। আবার বাজি ধরতে চাও যদি, আমার এই চোখ দুটোও বাজি রাখতে রাজি আছি। হেরে গেলে, এ দুটো উপড়ে নেবে তুমি।
ভয়ানক রেগে গেল বড় ছেলেটা। গরগর করতে করতে বলল—আর বিচারক দরকার নাই। এবার আমিই বিচারক। আমার রায়ই শেষ কথা। বলেই, ছোটভাইকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। উপড়েই নিল তার চোখ দুটো। 
--এবার তোর ঈশ্বরকে ডেকে বল, যদি পারে, তোকে রক্ষা করতে। আমি শয়তানেই বিশ্বাস করি।
ছোট বলল—আমি প্রার্থনা করি, এই কথার জন্য ঈশ্বর যেন তোমাকে ক্ষমা করে দেন।
--আমি গ্রাহ্যই করি না তোর ঐ ঈশ্বর আর তার ক্ষমা করাকে। তার ক্ষমা করা বা না করায়, কিছুই যায় আসে না আমার। আমি ক্ষমতাবান। আমি ধনী লোক। নিজেকে কী করে রক্ষা করতে হয়, ভালোই জানি আমি।
তাচ্ছিল্যের গলায় বলে চলল—তুই তো এখন একটা অন্ধ ভিখিরি। চলে যাওয়ার আগে শেষ বারের মত বল, কিছু দরকার আছে কি না।
ছোট বলল—সত্যিই যদি উপকার করতে চাও, একটা কাজ করে দিয়ে যাও আমার। সামান্য দূরে একটা ঝর্ণা আছে। সেখানে কোন একটা গাছের তলায় পৌঁছে দাও আমাকে। ঝর্ণার জলে ক্ষতটা ধুয়ে, গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নেব খানিক। 
--এটুকু আমি করে দিচ্ছি। বলে, হাত ধরে ছোট ভাইকে একটা গাছের তলায় এনে পৌঁছে দিল সে। যাবার বেলায় বলল—এবার তোর ঈশ্বর তোকে রক্ষা করুক। হাঁদা কোথাকার!
দুটো চোখই তো গিয়েছে জন্মের মতো। কোন রকমে পথ হাতড়ে হাতড়ে ঝর্ণাটার কাছে পৌঁছালো ছোট ছেলেটা। চোখের ক্ষত ধুয়ে, আবার ফিরে এলো গাছের তলায়। মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগল। ঘুমিয়েও পড়ল এক সময়। 
যখন ঘুম ভাঙল, প্রায় মাঝরাত। ঝর্ণাটার দিক থেকে কাদের যেন কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে। কী মিষ্টি গলা। পাখির কলতানের চেয়েও সুরেলা। বনের মর্মরের চেয়েও মধুর। এ তো কোনমতে মানুষের গলা হতে পারে না।
আসলে, একদল পরী এসেছে তখন ঝর্ণায় স্নান করতে। পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে এসেছে তারা। স্নান তো নয় তাদের, জলকেলি! 
ছেলেটাও সেটাই অনুমান করেছে। সে তো চোখে দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। তবে, এটা বুঝেছে, মানুষের গলা এতো মধুর হতে পারে না কিছুতেই। নিশ্চয় এরা পরীর দল।
একজন বলে উঠল—আমরা এখানে স্নান করে গেলাম, কেউ যদি কোন মানুষ মালুম করতে পারত, কী উপকারটাই না হোত তার।
অন্যজন বলল—ঠিকই বলেছিস। কেউ এসে এই জলে স্নান করলে, সব রকমের রোগ মুক্ত হয়ে যেত তার। 
আর একজন বলে উঠল—এদেশের রাজার মেয়ের কুষ্ঠ হয়েছে। আমাদের স্নান করা এই জল ছোঁয়ালে, সব রোগ সেরে যেত রাজকুমারীরও।
চোখ নাই, তাই দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটা। কিন্তু সব কথাই কানে যাচ্ছে তার। শুনছে, কিন্তু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। এও কি সম্ভব? এত দয়া হবে ঈশ্বরের? 
এক সময় স্নান সারা হোল পরীদের। জল ছেড়ে চলে গেল তারা। 
ছেলেটার তো তর সইছে না। জলের কাছে পৌঁছেই, এক আঁজলা জল তুলে ছিটিয়ে দিল চোখে-মুখে। 
অমনি একেবারে ভোজবাজির মত ব্যাপার। তার ক্ষত কোথায় উধাও। কোন অন্ধকার নাই সামনে। জ্যোৎস্না ভেজা এই বন, এই ঝর্ণা, দূরের ঐ পাহাড়, এমনকি দূর আকাশের রূপোর থালার মতো চাঁদটিকেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে।
হাঁটু গেড়ে বসে, বিড়বিড় করতে লাগল-- হা ঈশ্বর, কী লীলা তোমার! দৃষ্টি নয়, নতুন করে জীবন ফিরিয়ে দিলে আমাকে! কী মহান তুমি! তোমাকে অভিবাদন।
সকালের অপেক্ষা করে রইল ছেলেটা। আলো ফুটলে, জলে নেমে ভালো করে একটা ডুব দিয়ে নিল প্রথমে। জল ছেড়ে উঠে, গাছের পাতা বুনে বুনে, বড়সড় পাত্র বানালো একটা। ঝর্ণার পবিত্র জল ভরে নিল পাত্রটায়। সোজা রাজবাড়ির দিকে পথ চলা শুরু হোল তার।
রাজবাড়িতে পৌঁছালো ছোট। সেখানে নতুন বিপত্তি। দেউড়ির সেপাই তার মতো উলিঝুলি পোষাক পরা একটা ছেলেকে কিছুতে ভেতরে যেতে দেবে না। ছোট বলল—রাজামশাইকে খবর দাও। রাজকুমারীর জন্য ঔষধ এনেছি আমি।
সেকথা শুনে, সেপাই তো হেসে বাঁচে না। কতক্ষণে হাসি সামলে বলল—হাতি ঘোড়া গেল তল। মশা বলে—কত আর জল! কে তুমি, বাপু? প্রথমে রাজবৈদ্য হার মেনেছেন। তার পর দূর দূর কত দেশ থেকে নামকরা সব বৈদ্য আর কবরেজরা এসে ঘোল খেয়ে গেলো। আর  তুমি এসেছ রোগ সারাবে বলে? মজা করবার আর জায়গা পাওনি? রাজকুমারীকে নিয়ে মজা! রাজার কানে গেলে, শুলে চড়তে হবে তোমাকে, সে খবর রাখো?
ছেলেটার মাথা গেল গরম হয়ে। সে চেঁচিয়ে বলল—তা বাপু, তুমি কি এ কথাটা জানো, রাজার কানে সংবাদটা না গেলে, তোমাকেই শূলে চড়তে হবে? আমি যাচ্ছি। তুমি তৈরি থেকো সেজন্য।
এ কথায় একটু ঘাবড়েই গেল সেপাইটা। কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে? তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে সাথে নিয়ে, সোজা দরবারে পৌঁছে দিয়ে এল। 
প্রথমে রাজারও বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোথাকার কে না কে? এ সারাবে মেয়ের চোখ! মন্ত্রী বলল—দেখাই যাক না একবার। ক্ষতি তো কিছু হবে না।
ডুবন্ত লোকে খড়কূটোকেও আঁকড়ে ধরে। যদি বাঁচা যায়, এই আশায়। রাজামশাই ছেলেটাকে ভেতরে নিয়ে গেল। রানি দৌড়ে এল সংবাদ পেয়ে। 
রানি আগ বাড়িয়ে বলল—তুমি যা চাও, তাই দেওয়া হবে। শুধু আমাদের মেয়েটাকে সারিয়ে তোল তুমি। যত সময় লাগে লাগুক। যত দিন যায়, যাক। কেবল সারিয়ে দাও মেয়েটাকে। 
ছোট ছেলেটা তো জেনে গিয়েছে, কী যাদু এই জলের! কিন্তু সে গুমোর দেখাল না কোন। চাইল না কিছুই। অন্যের থেকে কিছু নেওয়া তার স্বভাবেই নাই। শান্ত গলায় বলল—সময় নয়, দিন নয়, রানিমা। আপনাদের চোখের সামনে, এখনই সেরে উঠবেন রাজকুমারী। 
সত্যিই হোল তাই। পাতার পাত্র থেকে এক আঁজলা করে জল তুলে রাজকুমারীর গায়ে মাথায় ছিটাতে লাগল ছেলেটা। রাজকুমারিও সেরে উঠতে লাগল একটু একটু করে। একেবারে ভোজবাজির মত ঘটনা। বিছানা ছেড়ে  নেমে এলো রাজার মেয়ে। কোনদিন শরীরে কোন রোগ ছিল, কে বলবে এখন? 
আনন্দের বন্যা বয়ে গেল রাজবাড়িতে। রাজা বলল—বলো, কী চাই তোমার। মুখ ফুটে যা চাইবে, তাই দেওয়া হবে তোমাকে। 
ছেলেটা কিন্তু নির্বিকার। কোন উচ্ছ্বাস নাই চোখে মুখে, কথাবার্তায়। সে বলল—নিজের জন্য কিছু চাইব বলে রাজবাড়িতে আসিনি আমি। এক দুষ্টের হাতে চোখ খোয়া গিয়েছিল আমার। এই পবিত্র জলে চোখ ফিরে পেয়েছি। তখন ভাবলাম, রাজবাড়িতে যাই। যদি রাজকুমারীর রোগ সারিয়ে দিতে পারি। কিচ্ছুটি চাই না এজন্য। রানিমার মুখে হাসি ফুটেছে। দুর্ভাবনা দূর হয়েছে রাজামশাইর মাথা থেকে—এর চেয়ে বড় পাওয়া, আর কী থাকতে পারে?
রাজামশাই ভারি খুশি এ কথা শুনে। এমন ছেলেও আছে দেশে। রানিমা খুশি—আহা কোন মতে পাওয়া যেত যদি ছেলেটাকে। মন্ত্রী রাজার কানে কানে বলল—ছেড়ে দেবেন না ছেলেটাকে। এই ছেলেই আপনার ভবিষ্যৎ। 
গোটা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে জানান দেওয়া হোল, রাজকুমারি সেরে উঠেছে। এক হপ্তা বাদে তার বিয়ে। রাজ্যশুদ্দু প্রজারা সাত দিন ধরে ভোজ খাবে রাজবাড়িতে।
ঢেঁড়ার ঘোষণা বড় ছেলেটারও কানে গিয়েছে। ছেলেটা যে তারই ছোট ভাই সেটা যখন বুঝলো, মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় তার। এটা কী করে হয়? নিজের হাতে দুটো চোখই উপড়ে নিয়েছি তার। চোখ ফিরে পেলো কী করে বোকাটা?
অনেক ভেবে ভেবে, তার মন বলল, বেকুবটাকে শেষ রেখে এসেছিলাম একটা ঝর্ণার ধারে, একটা ফার গাছের নীচে। নিশ্চয় সেখানেই কিছু ঘটেছে। নইলে দুচোখ অন্ধ কোন মানুষের পক্ষে, সেখান থেকে ফিরে আসা, বা রাজকুমারিকে সারিয়ে তোলা, কিছুতেই সম্ভব নয়। 
রইল পড়ে রাজবাড়ির নেমন্তন্ন। ঘোড়ার পিঠে বসে, দৌড় লাগাল ঝর্ণাটার দিকে। পৌঁছলো যখন বিকেল হয়ে গেছে। ফারগাছটার তলায় বসে পড়ল। যেমন বসিয়ে দিয়ে গেছল নিজের ভাইকে। ছুরি এনেছিল সাথে। নিজের হাতে উপড়ে ফেলল নিজেরই চোখ দুটোকে। তার পর রাত নামলে, পরীরা এসেছে স্নান করতে। সেদিন তাদের আলোচনা, রাজকুমারি সেরে উঠল কী করে? 
একজন বলল- সেদিন আমরা বলাবলি করেছিলাম এখানে। নিশ্চয় কেউ শুনেছিল আড়াল থেকে। সে-ই ঝর্ণার জল নিয়ে গিয়েছে, সারিয়ে তুলেছে রাজার মেয়েকে। 
একজন বলল—চল তো দেখি, আজও কেউ এসে লুকিয়ে আছে কি না।
যেমন কথা, তেমন কাজ। দল বেঁধে জল ছেড়ে উঠে এলো পরীর দল। খানিক বাদেই বড় ছেলেটাকে চোখে পড়ে গেল তাদের। অমনি সবাই মিলে জাপ্টে ধরে ফেলল তাকে। 
--তবেরে, হতভাগা। লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের কথা শোনা হচ্ছে? তার পর জল চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ফন্দী। সব ফন্দী ঘুচিয়ে দেব এক্ষুণি।
একজন বলল—জল চুরি করবার মতলবে এসেছিস। চল, জলেই নিয়ে যাচ্ছি তোকে। কেউ বাঁচাতে পারবে না তোকে।
ছেলেটা কিছু বলতে গেল পরীদের। কিন্তু কে শোনে কার কথা। টানতে টানতে জলেই নিয়ে গেল সবাই মিলে। জলে ফেলে, চুবিয়ে চুবিয়ে মেরেই ফেলল বড় ছেলেটাকে।
একটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি-- সেদিন কিন্তু শয়তান আসেনি ছেলেটাকে বাঁচাতে। কে কার চেয়ে কতো বড়, তার বিচারও হোল না। কেবল বেঘোরে মরতে হল বেচারাকে। 
আর, ছোট ছেলে? তার কথা বলবার আর আছেটা কী? রাজকুমারির সাথে বিয়ে হয়েছে সে ছেলের। রাজ্যশুদ্ধ লোক ভুরিভোজ খেয়েছে সাত দিন ধরে। আলাদা করে বিশাল এক প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছে রাজা। রাজকুমারি বউ নিয়ে ভালোই আছে ছেলেটা।
কিছুটা গল্প আছে তারপরও। এভাবে মাস ছয়েক না যেতে, পোকা নড়ে উঠল মন্ত্রীর মাথায়। আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে, বসে বসে দিন কাটাবে রাজার জামাই, তা কী করে হয়?
একদিন রাজাকে ডেকে, চুপিচুপি বলল—অনেক দিন তো রাজত্ব করলেন। আর কেন? ছেড়েছুড়ে দিন এবার। 
রাজার মাথায় কিছুই ঢুকল না। বলে কী মন্ত্রী! যেই চোখ কুঁচকে তাকিয়েছে, মন্ত্রী বলল— বরাত জোরে এমন ছেলে পেয়েছেন হঠাৎ করে। এবার তার হাতে রাজ্যের ভার ছেড়ে দিন। 
ব্যাপারটা এবার ঢুকল মাথায়। রাজা গম্ভীর। বললেন—বলছো?
--হ্যাঁ, বলছি। নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে কাজকর্ম শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারা যাবে। এর চেয়ে ভালো কথা আর কী আছে।
সত্যি, এর চেয়ে ভালো কথা আর কিছু হয় না। রাজার ভারি মনে ধরেছে। শুনে, রানিমা তো আহ্লাদে গলে জল একেবারে। আদর করে রাজার মাথায় বিলি কেটে দিলেন একটু।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments