জ্বলদর্চি

টুসু পরব: জঙ্গলমহলের জাতীয় উৎসব /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৫১

টুসু পরব: জঙ্গলমহলের জাতীয় উৎসব

সূর্যকান্ত মাহাতো


"টুসু উৎসব বা মকরের কাছে শারদ উৎসবের প্রাণচাঞ্চল্যও অনেকখানি ম্লান। এমনটাই মনে করেন "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত। তিনি এই উৎসবকে "জাতীয় উৎসব" বলেও উল্লেখ করেছেন। বঙ্কিমবাবুর কথা যে কতখানি সত্য সেটা সন্তোষ রাণার কথা থেকেই স্পষ্ট হওয়া যায়।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "কোন সন্তোষ রাণা? নকশাল বাড়ি গণ অভ্যুত্থানের কর্মী সেই সন্তোষ রাণা? ২০১৮ সালে যিনি 'আনন্দ পুরস্কার' পেয়েছিলেন!"

বললাম, "হ্যাঁ। উনি এই জঙ্গলমহলেরই ভূমিপুত্র। "রাজনীতির এক জীবন" গ্রন্থ লিখে ২০১৮ সালে 'আনন্দ পুরস্কার' লাভ করেন। জঙ্গলমহলে মকরের উন্মাদনা যে কতখানি সেই প্রসঙ্গে ঐ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, "কলকাতায় দুর্গাপূজায় যেমন ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু করে একাদশী দ্বাদশী পর্যন্ত লোকেরা সব কাজকর্ম ছেড়ে পূজা ও উৎসব নিয়ে মেতে থাকেন, তেমনি এই এলাকার (ধরমপুর) লোকজন মকরের সময় সাত দিন মকর স্নান, মাংস খাওয়া, পিঠে পুলি খাওয়া, নতুন কাপড় পরা, মেলা দেখতে যাওয়া এইসব নিয়ে মেতে থাকতেন। ( রাজনীতির এক জীবন/ সন্তোষ রাণা, পৃষ্ঠা ১৪, ১৫)
চিরকাল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বলতে দুর্গা পূজাকেই জানি। কিন্তু জঙ্গলমহলে শ্রেষ্ঠ উৎসব হল "মকর।" সুধীরকুমার করন মহাশয়ও এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেছেন, "সীমান্তবাঙলার শ্রেষ্ঠ উৎসব মকর পরব, সমতল বাংলার দুর্গোৎসবের মতো। (সীমান্তবাঙলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ,পৃষ্ঠা ২০১)

"তবে এই 'টুসু' পরবের উৎস কথা শুনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "তোষলা" ব্রতের কথা মনে পড়ে গেল। "টুসু ব্রত" ও "তোষলা" ব্রতের মধ্যে এমন অদ্ভুত মিল কীভাবে হল? তবে কি দুটো ব্রত আসলে একই?"

আমি বললাম, "অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "তোষলা ব্রত" বলতে ঠিক কী বলেছেন, তা আগে স্পষ্ট হওয়া দরকার। না হলে সেটা বিতর্কই তৈরি করবে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় শস্য বৃদ্ধির কামনায় অঘ্রানের সংক্রান্তি থেকে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত পালিত মেয়েলী এই ব্রতকে নাম দিয়েছেন "তোষলা" ব্রত। যা কোথাও কোথাও "তুঁষতুষলি" নামেও পরিচিত। পৌষ মাস জুড়ে প্রতি সকালে মেয়েরা এই ব্রত পালন করে থাকে। ব্রতের নিয়ম হল, সকালে স্নান করে গোবরের ছয় বুড়ি ছয় গন্ডা অর্থাৎ ১৪৪ টি গুলি পাকিয়ে বিছানো বেগুন পাতার উপর রাখতে হয়। প্রতিটি গুলিতে সিন্দুরের টিপ আর পাঁচগাছি দূর্বা ঘাস গুঁজে দিতে হয়। উপরে আলোচালের তুঁষ ও কুড়ো ছড়িয়ে দিতে হয়। সবশেষে সরষে, সিম ও মুলোর ফুল ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এটি সার মাটি দিয়ে জমিকে উর্বর করে তোলার একটা প্রতীকী ব্রত। তোষলার স্তুতিও করা হয়, ছড়া কেটে কেটে।

"তুঁষ তুঁষলী তুমি কে।
তোমার পূজা করে যে
ধনে ধানে বাড়ন্ত
সুখে থাকে আদি অন্ত।।
তোষলা লো তুঁষকুন্তি!
ধনে ধানে গাঁয়ে গুন্তি,
ঘরে ঘরে গাই বিউন্তি।।"
এরপর পৌষ সংক্রান্তির দিন সেই তোষলা ভাসানো হয়।"(বাংলার ব্রত/ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা ৩১-৩২)

শিক্ষক মশাই বললেন, "এ তো দারুন মিল! দুটোই অঘ্রানের সংক্রান্তি থেকে চলে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত। দুটো ব্রতেই শস্যের বৃদ্ধি কামনা করা হয়। দুটোরই নামকরণ 'তুঁষ' থেকে হয়েছে। পূজার উপকরণেও দারুন মিল। 'তুঁষ' ও 'গোবরের নাড়ু'। আবার পৌষ সংক্রান্তির দিন 'টুসু' ও 'তোষলা' দুটোই জলে ভাসিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।"

বললাম, "হ্যাঁ। দারুণ মিল। এ কারণেই বোধ হয় ডক্টর সুধীর কুমার করন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখিত "তোষলা" ব্রতকেই 'টুসু' উৎসব বলে একরকম মেনেই নিয়েছেন। উনি "সীমান্তবাঙলার লোকযান" গ্রন্থে বলেই দিয়েছেন, "বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত তোষলার ব্রতই মানভূম ধলভূম এবং ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের টুসু বা টুসলি। এ সম্পর্কে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে (পৃষ্ঠা ১৯১)।" তবে এখানেও তিনি একটা "কিন্তু" যোগ করেছেন।

শিক্ষক মশাই বললেন, "এখানে আবার কিন্তু কেন!"

বললাম, "তার কারণ 'তোষলা' ব্রতের সঙ্গে 'টুসু' ব্রতের নিজস্বতার এক বড় রকমের তফাত। "তোষলা" ব্রতকে 'টুসু' ব্রত রূপে একরকম মেনে নিলেও ঐ "কিন্তু" শব্দ প্রয়োগে একটা সংশয় রেখে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "কিন্তু বাংলাদেশের তোষলা ব্রত সীমান্ত বাংলার টুসু হয়ে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে"(পৃষ্ঠা- ১৯১)। পুজোর সাধারন রীতি রেওয়াজে কিছুটা মিল থাকলেও দুটো যে পুরোপুরি এক নয় সেই কথাটি উনি ঐ 'কিন্তু' শব্দে প্রকাশ করেছেন। এদিকে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতও "তোষলা" ব্রতকে 'টুসু' ব্রত বলার পক্ষে নয়। তিনি একে যুক্তিহীন বলেই মনে করেছেন।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "কেন? যুক্তিহীন কেন?"

বললাম, "কারণ, তিনি মনে করেন "আচার" হল যে কোন ব্রতের মৌলিক পরিচয়। সেখানে "ছড়া" এবং "প্রার্থনা" পরবর্তী সময়ে সংযোজিত হয়েছে। তাই ঝাড়খন্ড যদি বাংলার 'তোষলা' ব্রতকে গ্রহণ করে থাকত তাহলে ছড়াটিও গ্রহণ করত। টুসুর মধ্যে এই ব্রতের আদিতম রূপটি পাওয়া যায়, যা বাংলার তোষলা ব্রতের মধ্যে নেই। (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত,পৃষ্ঠা ১৯১)। বঙ্কিমবাবুর মতের পক্ষ নিয়ে বলা যায়, সত্যিই জঙ্গলমহলে পালিত 'টুসু' ব্রতে ছড়ার কোন স্থান নেই। বরং টুসু পরবের প্রাণ হিসেবে মনে করা তার সঙ্গীত বা গানগুলোকে। সেই টুসু গীত বা গানই হল এখানকার টুসু উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু বিষয়। ছড়ার পরিবর্তে গানই টুসুকে 'তোষলা' থেকে পৃথক করে তুলেছে। তাছাড়া 'তোষলা' ব্রত যেখানে সকালে অনুষ্ঠিত হয় 'টুসু' ব্রত সেখানে দিনের শেষে সন্ধ্যাবেলায় অনুষ্ঠিত হয়।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "এ সম্পর্কে ডঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কী মনে করেন?"

বললাম, "শুরুতেই "টুসু" উৎসবকে যে জঙ্গলমহলের জাতীয় উৎসব বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাকেই তিনি মান্যতা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'জাতীয় উৎসব বলিতে যাহা বুঝায় এবং পুরুলিয়ার টুসু উৎসবের মধ্যে আমরা আজও যাহা দেখিতে পাই তাহার কোনরূপ পূর্ব বাংলা কিংবা পশ্চিমবাংলার কোথাও দেখা যায় না।'"

"তিনিও এমন কথা বলেছেন!"

"শুধু এ কথাই নয়। পূর্ববঙ্গের তোষলা উৎসব যে 'টুসু' উৎসব নয়, সে কথাও একরকম বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'শস্য উৎসব বলিতে যাহা বুঝায় পুরুলিয়া ব্যতীত পূর্ব ও পশ্চিমবাংলায় আর কোথাও নাই।' এ কথা বলার কারন কি! কারণ এ অঞ্চলের টুসু পরবের সঙ্গে অন্য কোন পরবের তুলনা টানাই অনুচিত।"

জঙ্গলমহলে 'টুসু' উৎসব যার দ্বারা নিজেকে স্বতন্ত্র করতে পেরেছে সেটা হল তার সঙ্গীত বা গানগুলো। সেকথা আশুতোষ ভট্টাচার্যও মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "বাংলাদেশের টুসুর ন্যায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও অনুরূপ উৎসব প্রচলিত আছে। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লী, পেপাসু এবং পাঞ্জাবের কোন কোন জেলায় 'টেসু' নামক একপ্রকার লোকসংগীত শুনিতে পাওয়া যায়। ইহার সহিত টুসুগানের কোন সম্পর্ক নাই" (বাংলার লোকসাহিত্য, তৃতীয় খন্ড, গীত ও নৃত্য/ আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ৯০)। সুতরাং বাংলার "তোষলা" ব্রত যে জঙ্গলমহলের "টুসু" ব্রত নয়, এর থেকে বড় প্রমাণ আর কী থাকতে পারে।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "আপনি আগে বলেছেন যে, টুসু ব্রত হল একমাত্র কুমারী মেয়েদের ব্রত। কিন্তু আশুতোষ ভট্টাচার্য তো ঐ গ্রন্থে পরিষ্কার ভাবেই বলেছেন, 'এই ব্রত কুমারী সধবা বিধবা সকলেই করিতে পারে।'"(বাংলার লোকসাহিত্য,   তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৭)

"হ্যাঁ। উনি সঠিক তথ্য সংগ্ৰহ করেননি  বলেই এমন ভুলটা করেছেন। এই বিষয়ে আমার পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর কথা খুব মনে পড়ে। উনি বলেছেন, "দীর্ঘদিন কোন সাংস্কৃত পরিমন্ডলে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ না করে, বৈজ্ঞানিক শিক্ষণের প্রথাগত ও পদ্ধতি না জেনে সাংবাদিকসুলভ মনোভাব নিয়ে কোনো কিছু লেখার লোভ এরা(বাবু পন্ডিতেরা) সামলাতে পারেন না, অথচ গবেষক বলে চিহ্নিত হন"(ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা- ১৫৭)। আসল সত্য হল, টুসু ব্রত কেবল কুমারী মেয়েরাই পালন করে থাকে। কিন্তু 'গানে' কুমারী, সধবা, বিধবা সহ নারী পুরুষ সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে। সেখানে কোন বিধি নিষেধ নেই।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "এবার পরিষ্কার হওয়া গেল। তার মানে "টুসু গান" এই উৎসবের আসল শক্তি বলা যেতে পারে।"

বললাম, "একদমই তাই। গানের শক্তি যে কত বড় তার একটা উদাহরণ দিই। আপনি "টুসু সত্যাগ্রহ" এর নাম শুনেছেন?"

শিক্ষক মশাই প্ৰচণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে বললেন, "টুসু সত্যাগ্রহ!"

চলবে...

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments