জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—ভূটান /হনুমানের হা-হুতাশ /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—ভূটান
হনুমানের হা-হুতাশ

চিন্ময় দাশ

ভূটানের চারটি নদী, এক্কেবারে হাতের চারটি আঙ্গুলের মত । ভূটান হোল ভারতের এক পড়শি দেশ। আর, ভূটান আছে আমাদের বাংলার একেবারে মাথার ঠিক ওপরটাতে। ছোট্ট একটা স্বাধীন দেশ। পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা। 
হিমালয়ের কোলের দেশ। বরফ গলা জলের অজস্র ধারা বয়ে গিয়েছে সে দেশের উপর দিয়ে। সেসকল নদী-নালার মধ্যে চারটি বিখ্যাত—দ্রাংমে ছু (বাংলায় যার নাম— মানস), আমো ছু বা তোর্সা, ওং ছু বা রায়ডাক, পুনা শাং ছু বা সংকোশ। এই চারটিই ভুটানের বিখ্যাত নদী।
ভূটানের দক্ষিণ দিকটা উত্তরের মত ঠাণ্ডা নয়। কিছুটা গরম এই এলাকার আবহাওয়া। জঙ্গলের মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম মানস নদীর দুই তীরেই। অভাবী মানুষজনের বাস সেসব গ্রামে।
তখন গরম কাল। একজন ফেরিওয়ালা বেরিয়েছে টুপি নিয়ে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে টুপি বিক্রি করে লোকটা। এই গ্রাম সেই গ্রাম ঘুরে, অনেক বেলা হয়ে গেছে সেদিন। ঘোরাঘুরিতে কষ্টও হয়েছে খুব। লোকটা ভাবল, এবার একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। 
এগোতে লাগল লোকটা। গ্রাম ছাড়িয়ে বনের রাস্তা। কিছু দূর না যেতেই, নদীর পাশে এসে পড়ল রাস্তাটা। মানস নদী, কুল কুল করে বয়ে চলেছে। 
ফেরিওয়ালা ভাবল, একটা ডুব দিয়ে নিই। শরীরটা একটু জুড়াবে তাতে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। টুপি ভর্তি ঝুড়ি ছিল মাথায়। সেটা নামিয়ে নদীতে নেমে গেল। একটা ডুব দিয়ে, সত্যি সত্যি বেশ ঝরঝরে লাগল শরীরটা।
এবার ঝাঁকড়া দেখে একটা গাছের তলায় গিয়ে বসল ফেরিওয়ালা। ভাবল, একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। গেরস্তরাও যে যার মত বিশ্রাম করছে এখন। অহেতুক ঘোরাঘুরি করে লাভ হবে না কিছু।
গাছের তলায় বেশ ঠাণ্ডা ছায়া। ঘাসের উপরেই শুয়ে পড়ল লোকটা। টুপি ভর্তি ঝুড়িটা রইল মাথার পাশেই। একটু বাদেই ঘুম নেমে এলো চোখে। 
তখন ঠিক দুপ্পুর বেলা। চার দিক নিঝুম। জনপ্রাণীটিও দেখা যাচ্ছে না এলাকায়।
দেখা অবশ্যই যাচ্ছে না। তাই বলে, কেউ কোথাও নাই, তা কিন্তু নয়। যে গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছে টুপিওয়ালা, কেউ কেউ আছে সেই গাছের ওপরেই। লোকটা জানতই না তাদের কথা। এক দল হনুমান বসে ছিল গাছটায়। 
দূপুর বেলা। সারাদিন লাফালাফি করে, হনুমানগুলোও একটু জিরিয়ে নিচ্ছে তখন। লোকটা নদী থেকে স্নান করে এলো, দেখেছে হনুমানের দল। ঝুড়ি রেখে লোকটা শুয়ে পড়ল, তাও দেখেছে তারা। এখন লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে, সেটাও দেখল।
হনুমানের মাথা মানেই, বদমায়েসি বুদ্ধিতে ঠাসা। কিছু একটা সুযোগ পেলেই হোল, সেটা নিয়ে মেতে উঠবে। আজ হাতের কাছেই এমন সুযোগ এসে হাজির। ছাড়া যায় না কি?
লোকটা যেই না ঘুমিয়ে পড়েছে, দলের সর্দার হনুমানটা সুড় সুড় করে নীচে নেমে এলো। একটা টুপি তুলে নিল ঝুড়ি থেকে। ঘুমিয়ে পড়লেও, মাথায় একটা টুপি পরা আছে ফেরিওয়ালার। লোকটার দেখাদেখি, টুপি নিয়ে সর্দার হনুমানও নিজের মাথায় পরে ফেলল। 
যেমনটি এসেছিল, তেমনই চুপিসারে গাছে উঠে গেল হনুমান। দলের বাকিরা চেয়ে চেয়ে দেখছিল তাদের সর্দারের কাজ। এবার হোল কী, এক এক করে নেমে আসতে লাগল অন্য হনুমানগুলোও।
এক জন নামছে। ঝুড়ি থেকে একটা করে টুপি তুলে নিচ্ছে। টুপি মাথায় পরে, তর তর করে উঠে যাচ্ছে গাছের ডালে। সে এক দারুণ মজা পেয়ে গেছে হনুমানের দল। 
এইভাবে এক এক করে সব টুপিই শেষ হয়ে গেল এক সময়। ঝুড়ি শূণ্য। টুপি এখন গাছের ডালে ডালে হনুমানগুলোর শোভা পাচ্ছে। 
কিছুক্ষণ বাদে ঘুম ভাঙল ফেরিওয়ালার। ঝুড়ি তুলে রওনা দিতে যাবে, চক্ষু চড়কগাছ তার! ঝুড়ি বেমালুম খালি। একটা টুপিও নাই ঝুড়িতে। 
হায় হায় করে উঠল লোকটা। এতগুলো টুপি, গেল কোথায়? এতদিন ফেরি করে বেড়াচ্ছে। এমনটা তো কোনদিন হয়নি! অতগুলো টুপি। কম টাকার জিনিষ তো নয়? গরীব মানুষ সে। বড্ড ক্ষতি হয়ে গেল তার। 
কপাল চাপড়াতে লাগল লোকটা। কপাল চাপড়াচ্ছে, আর হায় হায় করছে।
এতক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে ছিল হনুমানগুলো। আর পারল না। লোকটাকে কপাল চপড়াতে দেখে, ভীষণ হাসি পেয়ে গেল তাদের। হাসি আর কতক্ষণ চেপে রাখা যায়? 
প্রথম হেসে ফেলল সর্দারটা। তার দেখাদেখি এক এক করে সকলে হাসতে শুরু করে দিল। খ্যাক খ্যাক করে একেবারে হাসির উতরোল উঠল গাছ জুড়ে। 
প্রথমে ভয়ানক চমকে গেল লোকটা। তারপর উপরে তাকিয়ে, তার তো চক্ষু ছানাবড়া। এক একটা হনুমানের মাথায় এক একটা টুপি। নানা রঙের, নানা সাইজের টুপি। গোটা গাছ জুড়ে টুপির মেলা বসে গেছে যেন। 
দুটো চোখ গোল গোল করে সেদিকে চেয়ে বসে রইল লোকটা। 
কতক্ষণ বাদে, একটা ভাবনা এল ফেরিওয়ালার মাথায়। টুপি না নিয়ে চলে গেলে, অনেক টাকার লোকসান হয়ে যাবে তার। তার চেয়ে বড় কথা, একদল হনুমান তাকে এভাবে ঠকিয়ে যাবে, এটা কিছুতেই মানতে রাজি নয় সে।
হনুমান বলো, বা বানর, এরা যে অন্যকে নকল করতে ওস্তাদ, লোকটা জানত। আজ দেখছেও, নিজের চোখে। তার নিজের মাথায় টুপি। তাই দেখে, টুপি পরে নিয়েছে হনুমানগুলোও। 
অমনি একটা ফন্দি এসে গেল মাথায়। কিছুক্ষণ গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে দেখল। চোখে পড়ল, সবগুলো হনুমানই তাকিয়ে আছে তার দিকে। লোকটা করল কী, মাথা থেকে টুপিটা খুলে, ছুঁড়ে ফেলে দিল সামনের দিকে। দিয়ে, আবার শুয়ে পড়ল মাটিতে। 
তবে কি না, এবার তো আর ঘুম নয়। ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। আর মিট্মিট করে দেখতে লাগল, এবার কী ঘটে?
কী আবার ঘটবে? চালাকি করে টুপি নিয়ে পালালেও, আদতে হনুমানগুলো তো বোকার বেহদ্দ। সে যেমনটা ভেবেছিল, ঘটল একেবারে ঠিক তেমনটাই। ঝুপ ঝুপ করে এক একটা টুপি এসে পড়তে লাগল গাছ থেকে। 
যেই টুপি পড়া শেষ হয়ে গেল, অমনি একেবারে ছিটকে উঠে পড়ল লোকটা। টপাটপ কুড়িয়ে তুলতে লাগল টুপিগুলো। দেখতে না দেখতে, ঝুড়ি ভরে গেল তার। আর এক মূহুর্তুও এখানে নয়। মাথায় ঝুড়ি চাপিয়ে হাঁটা লাগিয়ে দিল খুশি মনে। বড় লোকশানের হাত থেকে বাঁচা গেছে। 
টুপিওয়ালা চলে যাচ্ছে। গুণে গুণে সবগুলো টুপিই ফিরে পাওয়া গেছে। সেটা অবশ্যই আনন্দের কথা। কিন্তু টুপিওয়ালার মনে বেশি আনন্দ হনুমানগুলোকে বোকা বানাতে পেরেছে, এই ভেবে। খুব জব্দ হয়েছে হতভাগাগুলো।
টুপি ভর্তি ঝুড়ি মাথায়। ফেরিওয়ালা চলে যাচ্ছে। বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে চেয়ে বসে থাকল এক পাল হনুমান। সাড়াটি নেই কারও। চেয়ে আছে তো আছেই।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments