জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—পাকিস্তান (এশিয়া)/চড়ুইপাখির চড়ুইভাতি /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—পাকিস্তান (এশিয়া)
চড়ুইপাখির চড়ুইভাতি

চিন্ময় দাশ

একটা চড়ুই পাখি আর একটা কাক। এক পাড়াতেই থাকে দুজনে। মোটামুটি ভাবসাবও আছে দুজনের মধ্যে। একদিন কাক বলল—চড়ুই ভায়া, বড্ড একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে জীবনটা। এসো না, একদিন চড়ুইভাতির আয়োজন করা যাক। 

শুনে, চড়ুই তো ভারি খুশি। সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। হাসি হাসি মুখ করে বলল—খুব ভালো কথা বলেছ গো। এখন ঠাণ্ডার দিন। দারুণ জমবে ব্যাপারটা।
চড়ুই চাল জোগাড় করে আনল। কাক আনল মুসুর ডাল। কাক বলল—যাই বলো ভাই, রান্নাবান্নার ধারে আমি নাই। ওটা তোমাকেই সামলাতে হবে। 
চড়ুই রাজি হয়ে, রান্নার কাজে লেগে গেল। খিচুড়ি ফুটে উঠতে শুরু করল খানিক বাদেই। অমনি একটা মিষ্টি গন্ধ! আহা, ভারি আনন্দ দুজনের।
কাকের যেন আর তর সয় না। সে বলল—তাহলে আর দেরি কেন? হাঁড়ি নামিয়ে ফেল। খাওয়া শুরু করে ফেলা যাক। 
চড়ূই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কাকের দিকে। তা দেখে কাক অবাক। বলল—অমন করে চেয়ে আছো কেন গো? রান্না কি শেষ হয়নি? 
--রান্না এখনও শেষ হয়নি, এটা বড় কথা নয়। কথা হল, হাত পা না ধুয়ে কেউ কোনদিন খেতে বসেছে? তেমনটা শুনেছ কোন দিন? 
কাকের মাথায় কিছুই ঢুকল না। সে তাকিয়ে রইল চড়ুইর দিকে। চড়ুই বলল—একে তো তোমার ঐ কালো কুৎসিত চেহারা। তাছাড়া, ঘাড় আর বুকের দিকে চেয়ে দেখেছ কোন দিন? যেন মুঠো মুঠো ছাই মাখিয়ে দিয়েছে কেউ। তার উপর সারাদিন তো নোংরা ঘেঁটে বেড়াও। আগে পুকুরে যাও। ঠোঁট জোড়া আর পা দুটো ধুয়ে এসো আগে। ততক্ষণে খিচুড়িও তৈরি হয়ে যাবে।
কাক বলল—পুকুরে যেতে বলছ?
চড়ুই বলল—হ্যাঁ, তাই বলছি। চড়ুইভাতি তো আর সব দিন হয় না আমাদের। খিচুড়িও না। একটা দিন খাবো, একটু সাফসুতরো হয়ে, সহবতের সাথে খাওয়াই তো ভালো। তাই না? 
--ঠিক কথাই বলেছ। যাই, পা-মুখটা ধুয়েই আসি। বলেই কাক চলল পুকুরে।
পুকুরকে বলল—পুকুরভাই, পুকুরভাই! আজ আমাদের চড়ুইভাতি। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ঠোঁট আর পা না ধুলে, খিচুড়ি দেবে না চড়ুই। এক আঁজলা জল দাও আমাকে।
পুকুর বলল—তুমি খাবে খিচুড়ি। আমি কেন জল দিতে যাবো? তাছাড়া যত পশু আর পাখির দল, সবাই আমার জল খায়। ঠোঁট আর পা ধোয়ার জল না কি এটা?
কাক অবাক হয়ে বলল—এতো সাধের চড়ুইভাতি আজ। ধুয়ে সাফ  হয়ে না গেলে, খেতে পাবো না যে! 
পুকুর বলল—তাহলে এক কাজ করো, বাছা। হরিণের কাছে যাও। একটা সিং নিয়ে এসো তার কাছ থেকে। শিং দিয়ে নিজেই মাটি খোঁড়। জল পেয়ে যাবে। তখন যতো পারে ধোয়াধুয়ি করো। আমার কিছু বলার থাকবে না। 

কাক হাজির হোল হরিণের ডেরায়—হরিণভাই, হরিণভাই! আজ আমাদের চড়ুইভাতি। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ঠোঁট আর পা না ধুলে, খিচুড়ি দেবে না চড়ুই। পুকুরকে কতো সাধাসাধি করলাম--এক আঁজলা জল দাও আমাকে। সে বলল—হরিণের কাছ থেকে একটা সিং চেয়ে আনো। তা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে, নিজেই জল জোগাড় করে নাও। একটা শিং দাও তুমি আমাকে।
হরিণ বলল—তোমার তো আর শিং নাই মাথায়। শিং ভাঙবার যন্ত্রণা তুমি বুঝবে কী করে? ঠিক আছে, দেব তোমাকে একটা শিং। তার আগে, তুমি আমাকে গরুর কাছ থেকে এক ভাঁড় দুধ এনে দাও। দুধ খেয়ে একটু তাগড়াই হই। তাতে কষ্টটা একটু কম হবে। 
গরুর কাছে গিয়ে হাজির হোল কাক—দিদি গো, দিদি! আজ আমাদের চড়ুইভাতি। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ঠোঁট আর পা না ধুলে, খিচুড়ি দেবে না চড়ুই। পুকুরকে কতো সাধাসাধি করলাম--এক আঁজলা জল দাও আমাকে। সে বলল—হরিণের কাছ থেকে একটা সিং চেয়ে আনো। তা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে, নিজেই জল জোগাড় করে নাও। হরিণকে বললাম-- একটা শিং দাও তুমি আমাকে। গর্ত খুঁড়ে জল বের করবো। হরিণ বলল, এক ভাঁড় দুধ এনে দাও। তবে আমি শিঙ দেব। তুমি দয়া করে এক ভাঁড় দুধ দাও আমাকে।
গরু বলল— দুধ না পেলে, তোমার খিচুড়ি খাওয়া হবে না দেখছি। তাই অবশ্যই দুধ দেব আমি তোমাকে। তবে, এক আঁটি ঘাস এনে দাও আমাকে। ঘাস পেটে পড়লে, তবে না ঘাস দেবো? 
খানিক দূরেই মাঠভর্তি ঘাস। কাক মাঠের কাছে গিয়ে হাজির—মাঠভাই, মাঠভাই! আজ আমাদের চড়ুইভাতি। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ঠোঁট আর পা না ধুলে, খিচুড়ি দেবে না চড়ুই। পুকুরকে কতো সাধাসাধি করলাম--এক আঁজলা জল দাও আমাকে। সে বলল—হরিণের কাছ থেকে একটা শিঙ চেয়ে আনো। তা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে, নিজেই জল জোগাড় করে নাও। হরিণকে বললাম-- একটা শিং দাও তুমি আমাকে। গর্ত খুঁড়ে জল বের করবো। হরিণ বলল, এক ভাঁড় দুধ এনে দাও। তবে আমি শিঙ দেব। গরুকে বললাম-- দয়া করে এক ভাঁড় দুধ দাও আমাকে। গরু বলল—এক আঁটি ঘাস এনে দাও। তখন আমি দুধ দেব তোমাকে। তা, তোমার তো মাঠভর্তি ঘাস। দয়া করে, তা থেকে একটি মাত্র আঁটি ঘাস দাও আমাকে।
মাঠ বলল—সব শুনলাম। ঘাস দেবও আমি তোমাকে। কিন্তু ঘাস কাটতে তো কাস্তে লাগে, বাছা। আগে একটা কাস্তে এনে দাও আমাকে।
এবার কাক তো পড়ল আকাশ থেকে— হায়, কপাল! এখন কাস্তে আমি পাবো কোথা থেকে? 
মাঠ বলল—কেন বাছা, এতে চিন্তার কী আছে? কামারের বাড়ি যাও। কাস্তে একটা পেয়ে যাবে ঠিক।
সেই তখন থেকে ঘুরে ঘুরে, কাক হয়রাণ। এবার পৌঁছলো কামারের বাড়ি। বলল—কামারভাই, কামারভাই! আজ আমাদের চড়ুইভাতি। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ঠোঁট আর পা না ধুলে, খিচুড়ি দেবে না চড়ুই। পুকুরকে কতো সাধাসাধি করলাম--এক আঁজলা জল দাও আমাকে। সে বলল—হরিণের কাছ থেকে একটা শিঙ চেয়ে আনো। তা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে, নিজেই জল জোগাড় করে নাও। হরিণকে বললাম-- একটা শিং দাও তুমি আমাকে। গর্ত খুঁড়ে জল বের করবো। হরিণ বলল, এক ভাঁড় দুধ এনে দাও। তবে আমি শিঙ দেব। গরুকে বললাম-- দয়া করে এক ভাঁড় দুধ দাও আমাকে। গরু বলল—এক আঁটি ঘাস এনে দাও। তখন আমি দুধ দেব তোমাকে। মাঠকে বললাম-- তোমার তো মাঠভর্তি ঘাস। দয়া করে, তা থেকে একটি মাত্র আঁটি ঘাস দাও আমাকে। মাঠ তোমার কাছে পাঠালো কাস্তের জন্য। তুমি দয়া করে একটা কাস্তে দাও আমাকে। 
কামার বলল—কাস্তে কি আমি তোমার জন্য তৈরি করে বসে আছি না কি? কাস্তে আমাকে বানাতে হবে।
কাক বলল—তাহলে তাই করো। একটা কাস্তে বানিয়েই দাও আমাকে।
কামার তো হেসেই অস্থির—তুমি বললে, আমাকে একটা কাস্তে বানিয়ে দাও। আর, অমনি আমি একটা কাস্তে বানিয়ে তোমার হাতে ধরিয়ে দিলাম? কাজটা অতো সহজ না কি?
কিছুই ঢুকলো না কাকের মাথায়। কামার বলল— শোন বাপু, কাস্তে বানানো একার কাজ নয়। দু’জন লোক লাগে। তুমি যদি আমার হাপর টেনে দাও, আমি কাস্তে বানিয়ে দিতে পারি।

এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাচল কাক। এই কামার মানুষটা বেশ ভালো। কোন চাহিদা নাই এর। আর কারও কাছে ছুটতে হচ্ছে না। কাক রাজি হয়ে গেল হাপর টানতে। 
রাজি না হয়ে উপায়টাই বা কী? এদিকে খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। ওদিকে ফাঁকতালে চড়ুইব্যাটা একাই খিচুড়ি সাবাড় করে দিল কিনা, সেই ভাবনাও আছে মাথায়।

হাপর টানছে বটে, মাথায় কেবল খিচুড়ি আর চড়ুইর ভাবনা। একটু বাদেই কামার খেঁকিয়ে উঠল—হচ্ছেটা কী এটা? জোরে জোরে টান দাও। আগুনের ফুলকিটুকুও তো উড়ছে না। 
তা শুনে, কাক দিয়েছে হ্যাঁচকা এক টান। অমনি একরাশ ফুলকি উঠে ছড়িয়ে পড়ল সামনে। তা দেখে ভয়াণক ঘাবড়ে গেল কাক। সে আঁতকে উঠে দিয়েছে এক লম্বা লাফ। তাতেই হাপরের দড়িতে ধাক্কা লেগে গেল। ধাক্কা লাগলে, যা হয়! পড়ে গেল ধপাস করে। আর পড়বি তো পড়, সোজা কামারশালের আগুনের ওপর। 

ডানায় আগুন লাগতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। ছটফট করতে করতে পুড়ে মারা গেল কাক বেচারা। খিচুড়ি খাওয়া তো অনেক দুরের কথা। জীবনে প্রথম বার ঠোঁট জোড়া আর পা দুটো ধুতে গিয়েছিল, সেটাও হয়ে উঠল না তার।

ওদিকে চড়ুইপাখি? তার কপাল ভালই বলতে হবে। কাকের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করে করে, চড়ুইভাতির পুরো খিচুড়িটা সেদিন একাই খেয়েছিল চড়ুই।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments