জ্বলদর্চি

দিনুদার ফ্ল্যাশব্যাক /গৌতম বাড়ই

দিনুদার ফ্ল্যাশব্যাক

গৌতম বাড়ই 


দিনুদার সাথে আমার একটি অন্তসলিলা ফল্গুধারার মতন সম্পর্ক আছে। সেই চোরাস্রোতের টানে সপ্তাহান্তে দুজনে দুজনের কাছে বসি গল্প করি বারবার। একেই বলে বোধহয় বন্ধুত্ব। দিনুদার এই নতুন ব্যাবসাটি আমার মনঃপুত হয়েছে। আমায় সেই যে প্যাকেজ বন্দী করে পাঠালেন কোচবিহার তারপর আমি আর কোথাও যাইনি তার ভ্রমণ সংস্থার হয়ে, তবে সম্পর্ক কিন্তু তার সাথে আমার গভীর। স্বার্থের বাইরে । আমার বাজার করতে বেলা বয়ে যায়, দিনুদা আর আমি গল্প করি সেই চা-দোকানে বসে। আসলে এই চায়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের বঙ্গজীবন। উত্তরবঙ্গের চা-বাগিচা, তরাই ডুয়ার্স পাহাড়ের ধাপে- ধাপে চা-বাগানের সেই চিরকালীন চিরসবুজ অমলিন দৃশ্য সর্বদা মনের সঙ্গেই থাকে। চা শুধু চিন নয়, চা মানে বাঙালিও। সাগিনা মাহাতোকে তো মনে পড়বেই আপামর সাহিত্য পিপাসু বাঙালির। আমি দিনুদাকে জিগ্গেস করি -  তা দাদা, নতুন এই ব্যাবসা চলছে কেমন? 

দিনুদা বললেন-- গড়পড়তা গুরু। বেশিরভাগ ধাড়িবাজ লোকজন। প্রথমেই এসে অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়। ব্যোমকেশ বক্সীর ছোটে ব্যাটা সব। সে রাস্তায় অনেক খরচ করবে, ভ্রমণ সংস্থার অফিসে এলেই এটা এত কেন? ওটায় টাকা কেন দেব? ইত্যাদি। ব্যাবসা মানেই যেন লোক ঠকানোর কারবার। এতই যখন জানিস তো আমার অফিসে আসা কেন? আমি যে লোকজন পুঁজি লাগিয়ে তোমাদের সার্ভিস দেব তাতে দুটো পয়সা রোজগার করব না! মিথ্যে বলব না, মহাদেবের কৃপায় ভাইয়া দুটো কর্মচারীর মাসিক বেতন আর সামান্য লাভ, এই ভাবে চলে গেলেই হল। 

আমি অবাক হয়ে দিনুদাকে বলি--- আপনি আবার কবে থেকে মহাদেব মানে শিবভক্ত হলেন? 

দিনুদা গালে হাত দিলেন আর একটু গম্ভীর হয়ে বললেন-- তাই তো! তবে কী আমি হনুমান ভক্ত ছিলাম?  না, ঐ সব মনুষ্যতর জীবের তো কখনও ভক্ত ছিলাম না। তবে কিশোর বয়সে আমি আমার এক কাকার কল্যাণে নৃসিংহদেবের  ভক্ত হয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য। সে অনেক গল্প, একটু বলি। হিরণ্যকশিপুর হত্যাটা বেশ ফাটাফাটি লেগেছিল কাকার মুখে। অমিতাভের বিড়ি ফোঁকা 'দিওয়ার'  সবে দেখেছি, এক মামুলি বন্দর শ্রমিকের চরিত্রে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন দেখে হিরো হয়ে উঠছি। তো নে দশাবতারের চতুর্থ অবতারের ফ্যান হয়ে যাওয়া। কোথা দিয়ে এক নৃসিংহদেবের ক্যালেন্ডার যোগাড় করে সকাল-সন্ধ্যা ধূপকাঠি দেখাতাম। অ্যানুয়ালের রেজাল্ট বেরুতেই মাই ড্যাড এক বিচ্ছিরি হৃদয়বিদারক কান্ড ঘটালেন, সারা জীবন ইয়াদ থাকবে। আমার কানঢাকা বচ্চন স্টাইল চুল মায়ের সেলাইয়ের কাঁচি দিয়ে ঘ্যাচঘ্যাচ চালিয়ে দিলেন। আর নৃসিংহদেবের ক্যালেন্ডার মুড়িয়ে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন-" ছেলেকে বলো, ঐ স্থানে সরস্বতীর ফটো ঝোলাতে। তোমার হিরো ছেলে অঙ্কে ২১ পেয়েছে।বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস সবেতেই ফেল। বাংলায় কোন রকমে উতরে গিয়েছে। মানে ডাঁহা ফেল। ক্লাস নাইন আবার। হাড়ে দুব্বো গজাবে। ধূপকাঠি দেখাতে হলে দেবী সরস্বতীকে দেখাক।"

আমি দিনুদার ফ্ল্যাশব্যাকে তন্ময় হয়ে গল্প শুনছিলাম। হুঁ আর হ্যাঁ করছিলাম। তারপর দিনুদা---

দিনুদা আমার আগ্রহে আরও উৎসাহী হয়ে পড়লেন, নিজের জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে। বলতে শুরু করলেন--তিনবার মাধ্যমিকে, তার মানেই ম্যাট্রিকে হ্যাটট্রিক করলাম, অবশ্যই ফেল করে। বাবার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। মা লুকিয়ে চুরিয়ে খেতে দেয়। একদিন বুকে সাহস যুগিয়ে সরাসরি বাপের মুখোমুখি, শক্তি সিনেমার সেই দিলীপকুমার আর অমিতাভ বচ্চনের মতন। বাবাকে বললাম-- টা-টা ড্যাড আজ থেকে তোমার রোজগারের পয়সায় দাঁতে কিছু কাটব না। এই পড়াশোনার লাইন আমার জন্যে নয়। আমি রোজগারের ধান্দায় ভারত চষতে বেরুলাম। বাবা তিড়িং করে তক্তপোষ থেকে লাফিয়ে উঠে আমার মুখোমুখি হলেন--- ও বড্ডো লায়ক হয়েছ? চতুর্থ বারের জন্য মাধ্যমিক দেবার জন্য তৈরী হও। আমাদের বংশে আন্ডার মেট্রিক কোন পুরুষ মানুষ নেই। 

আরও দু- চারটে কটুকথা আমাকে হজম করতে হলো। সেদিন রাতেই বাড়ি থেকে ফুটে গেলাম। সোজা চলে গেলাম মধ্যপ্রদেশের ( তখন ছত্তিশগড় হয়নি) রায়পুরে।
সেখানে মায়ের দিক থেকে আমাদের হরিশমামু ছিলেন, জানতাম। খুঁজে পেয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। দিন পনেরো হয়নি বোধহয় , পুলিশ এসে আমায় পাকড়াও করে ফের চালান করে দিল হাওড়ার বাড়িতে। হরিশমামু চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। বাড়ি ফিরে এসে মায়ের হাউহাউ কান্না, আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-- " আমার মাথায় হাত রেখে বল আর কোনদিনও বাড়ি থেকে পালাবি না। যদি কথা না রাখিস, আমার মরামুখ দেখবি এসে।" ব্যাস্ সেই যে গেঁথে গেলাম আজ চল্লিশ বছর হল তার থেকে বেরোতে পারলাম না। তবে মা কিন্তু কথা রাখেনি, আজ থেকে বছর সাতেক আগে টা-টা করে নক্ষত্রলোকে পাড়ি দিয়েছেন। অবশ্য মা একটি বিরাট কাজ করে গিয়েছিলেন ঐ পড়াশোনা আর পরীক্ষার ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি। সেইদিক থেকে মুক্তপাখি। নিজের টুকিটাকি স্বাধীন ব্যাবসা। এইভাবে ভালই আছি গো দাদাবাবু। আপনি হলেন গিয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু, আজ মনের কথা খানিকটা বলেই ফেললাম। 

আমি বলি- " দিনুদা বেশ লাগছে কিন্তু আমার শুনতে। তবে এটা " দিনুদার ফ্ল্যাশব্যাক" শিরোনামে জ্বলদর্চিতে যাবে। 

দিনুদা বললেন-- " তবে তাই হোক ভায়া। আবার তাহলে হবে।"

গল্পকথার শেষ নয়, শুরু বলা যেতে পারে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments