জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৫০ /রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫০

২০০৯ এ এর কথা বলতে শুরু করলেও আগের দুই বছরের ও তারও আগের  অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। সেগুলি না বললে আমার এই পথ চলার অনেক অভিজ্ঞতা না বলা থেকে যাবে। যেমন ২০০১ এ তৎকালীন জেলাশাসকের চিঠি পেয়েছিলাম ৯ অক্টোবর সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত সংখ্যালঘু কমিশনের মিটিঙে যোগ দেবার জন্য। এই মিটিঙে সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান কে এম ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন। ২০০৬ এ ২০০৭ এর জানুয়ারিতে খড়গপুর বইমেলায় একটি আলোচনায় যোগ দেবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। বিষয় ছিল ‘ডোমেস্টিক ভায়লেন্স অ্যাক্ট নারী নির্যাতন কমাতে সক্ষম হবে’। আমি ছাড়াও খড়গপুর আই,আই, টি র একজন অধ্যাপক ও লেখক নন্দদুলাল রায়চৌধুরী এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন।

    একদিকে সংসার, আর সেখান থেকে সময় বের করে লেখালেখি করা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তার মাঝখানে সাহিত্য ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনায় যোগ দেওয়াটা খুব চাপের ছিল। কারণ কিছু অনুষ্ঠান মেদিনীপুর শহরে বা তার আশেপাশে হলেও বেশ কিছু অনুষ্ঠান দূরদর্শন ও আকাশবাণী ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন সভাঘরে এবং কলকাতার আশেপাশের অঞ্চলে হত। এইসব অনুষ্ঠানে সব সময় যাওয়া সবসময় সম্ভব হতনা। আমার নিরাপত্যার কথা ভেবেই খান সাহেব যেতে দিতে চাইতেন না। তবে মেদিনীপুরেও বেশ ব্যস্ততা ছিল। বিভিন্ন সরকারি  স্কুলের প্রতিযোগিতায় বিচারকের ভুমিকা পালনের জন্য ডাক পেতাম। তাছাড়া তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের ডাকে বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতা শিবিরে যোগ দিতাম। মাঝে মাঝে জেলাশাসকের চিঠি আসত সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য।

      ২০০৬ এ ‘স্বাধীনতা দিবস উদযাপন সমিতি’র আমন্ত্রণ পেয়ে প্রথম মেদিনীপুর শহরের এল আই সি র চকে প্রকাশ্যে ‘বিপ্লবী সনাতন রায়’ স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলাম। এই বছরই অক্টোবরে(সম্ভবত ২৫/১০/০৬) আকাশবাণীর  মহিলামহলে প্রথম কথিকা পাঠ করি। এই ইচ্ছেটা আমার ভাবনার মধ্যে না থাকলেও সুযোগটা পেয়েগেছলাম। ২১/১২/০৭ এ আকাশবাণীর মহিলামহলে আরও একটি কথিকা পাঠ করি। ‘রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা কলেজ’এ ‘Problems of Uplift of Ladies and Try For Their progress’  বিষয়ে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। এভাবেই ক্রমশ লেখালেখি ছাড়াও বাইরের জগতে কাজের পরিধি বাড়তে  থাকে, সেইসঙ্গে পরিচিতিও। একটা সময় ভাবতাম যেদিন কলকাতা দূরদর্শনে ডাক পাব, সেদিন বুঝব আমি সত্যিই ভাল বলতে পারি।আমার কথায় যুক্তি আছে। আর যেদিন  আনন্দ পাবলিশারের কোনো পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হবে, সেদিন জানব আমি লিখতে পারি। দূরদর্শনে অনেক আগেই ডাক পেয়েছি। বাকি ছিল লেখা। সে আশাও পূর্ণ হল আনন্দমেলার ‘বেড়ানো’ বিভাগে(০৫/০৪/০৯) আমার ‘রবিনহুডের জঙ্গলে’ লেখাটি প্রকাশিত  হওয়াতে। দক্ষিনা হিসেবে তখন ৫০০/= টাকার চেক পেয়েছিলাম। 
    ইদানিং খুব একটা লেখা হচ্ছে না। ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খোঁজা শুরু করেছি। ছেলে বিয়ের বিষয়ে মোটেও আগ্রহী নয়। বাপি মা চায়, তাই সে বিয়ে করবে। আমাদের যাকে পছন্দ হবে, তাকেই ও বিয়ে করবে। মেয়ে দেখার ওর দরকার নেই। কিন্তু পাত্রী ও পাত্রীপক্ষ তো ছেলেকে দেখতে চাইবে? আনন্দবাজারে ‘পাত্রী চাই’ কলামে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। সকাল থেকে ফোন আসতে যে শুরু করল, তা আর থামার নাম নেই।কিছু ছবি ই-মেলে আসল।বাকি সব ডাকযোগে  আসতে লাগল। ছেলে নিজে পছন্দ করলে কথা ছিল না, আমাদের কোনো দায়  থাকত না। আমাদের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে যদি মানিয়ে নিতে না পারে? তাহলে সারা জীবনের জন্য ছেলের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। মনের মধ্যে  টানাপড়েন শুরু হল। এদিকে ওর বাপি কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে এক কথা বলে, তোমার ছেলের আর বিয়ে হবে না। বয়স তো কম হল না।   
    সেইসমই হাওড়া জেলার খলতপুরে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আল-আমিন  মিশন’ ও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় নুরুল ইসলাম সাহেবের নাম সারা রাজ্য জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। বহু দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রী, যারা শুধু সুযোগ ও অর্থের অভাবে শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল, তারা অনেকেই আল-আমিন মিশন থেকে পড়াশোনা ও কোচিং নিয়ে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে প্রয়োজনের তাগিদেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আল-আমিন মিশন এর শাখা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। অষ্টম শাখাটি ২২/০৬/০৭ এ মেদিনীপুরের ধর্মাতে  একটি ভাড়াবাড়িতে পথচলা শুরু করে। পরবর্তীকালে জনাব শেখ সেলিম ও শেখ আব্দুল মালেকের আর্থিক সহায়তায়  এলাহিগঞ্জে  স্কুল গড়ে তোলার মত পর্যাপ্ত জমি পাওয়ার পর ১৪/১১/১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই জমিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হিসেবে হাজির থাকায় নুরুল ইসলাম সাহেব আমাকেও বলেন, আপা, আপনিও কোদাল দিয়ে মাটিতে একবার চোট দিয়ে দিন। আজ সেখানে বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং বর্তমানে আল-আমিন মিশন এর শাখা ৭০ ছুঁয়ে গেছে। এইসব শাখা থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদেরই ২/১ জনের কাহিনী পরে জানাব।

    প্রায় এখন তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর থেকে আমন্ত্রণ পাচ্ছি। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বলার জন্য বিভিন্ন ব্লকে সচেতনতা শিবিরে যোগ দেবার জন্য। কোনদিন মেদিনীপুর তো কোনদিন খড়গপু। কোনদিন শালবনী তো কোনদিন দাঁতন। বিষয়ও ভিন্ন ভিন্ন। কোথাও ‘নারী ও শিশুকল্যাণ, আবার কোথাও ‘নারী ও শিশু সুরক্ষা’ কোথাও বাল্যবিবাহের কুফল বিষয়ে বার্তা দেওয়া।
  কলকাতায় কখনও নরেন্দ্রপুরে কখনও মেটিয়াবুরুজে, আবার কখনও বা মউলালি যুবকেন্দ্রে।  সম্প্রীতি এবং মুসলিম সমাজের পিছিয়ে থাকার কারণ ও  সমাধান খোঁজার বিষয়ে আলোচনায় সঙ্গে পেয়েছি, তৎকালীন বহু মন্ত্রী, বিধায়ক, আমলা, কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রশিল্পী, খেলোয়াড়, গায়ক-গায়িকা, শিক্ষাবিদ প্রমুখ বিশিষ্ট জনদের। অশোক ভট্টাচার্য, আব্দুসসাত্তার, রাজ্জাক মোল্লা, মনোজ মিত্র, সুবোধ সরকার, ওয়াসিম কাপুর, মাসুদুর রহমান,গোয়েন্দা প্রধান নজরুল ইসলাম, মিরাতুন নাহার, আজিজুল হক, আরও বহু ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে, এমন কী প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রর  মত শিক্ষাবিদের সঙ্গে মঞ্চ সেয়ার করার সৌভাগ্য হয়েছে।

    সময়ের সঙ্গে কতকিছুই বদলে যাচ্ছে। বদলে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক পটভূমির বার বার পরিবর্তন ঘটেছে। এবং  রাজনৈতিক হানাহানি খুব বেশি  মাত্রায় বেড়ে গেছে।  ঘটে গেছে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ২০৯২ সালে  নরসীমা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছিল করসেবকরা। শোনা গেছিল বিজেপির নেতা নেত্রীরাই দুর থেকে এদের পরিচালনা করেছিল। এর কারণে দেশ জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তাতে ২০০০ এর মত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।  ভারতের ইতিহাসে এটি একটি  কলঙ্কময় অধ্যায়। এরই রেস ধরে ২০০২ এ  গোধারা কাণ্ড ঘটে, চলন্ত ট্রেনে আগুন ধরে যাওয়ার বা  ধরিয়ে দেওয়ার ফলে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। এই দাঙ্গার  বীভৎসতা অবর্ণনীয়। এতে মহিলারা সব থেকে বেশি বীভৎসতার শিকার হয়েছিলেন। জানের আগেই তাঁদের মান খোয়াতে হয়েছিল। ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে পাথর ও কাঠের টুকরো ভরে দেওয়া হয়েছিল। এরও আগে  ১৯৯৩ এ ঘটে গেছে মুম্বাই দাঙ্গা। মুম্বাইয়ের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক বোমা বিস্ফোরণ হতে থাকে। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের দাউদ ইব্রাহি্ম ও তার সহযোগী ছোটা রাজন, ইয়াকুবকে এই বীভৎস কাণ্ড ঘটনোর জন্য দায়ি করে মামলা শুরু হয়। বিস্ফোরণে প্রচুর সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর জন্য প্রচুর উলুখাগড়ার( মুম্বাইয়ের বস্তিবাসি) প্রাণ গিয়েছিল। এই সমস্ত  খবর সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা। কোনো  কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পূর্বে এইধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না।

      ২০০৬ সালে বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানার জন্য জমি  অধিগ্রহণ শুরু করেছিল। তারপর প্রাচীর দেওয়ার কাজ শুরু হলে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  শিল্পের জন্য জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষকদের নিয়ে আন্দলনে নামেন। ধর্মতলায় অনশনে বসেন। শেষপর্যন্ত টাটা কারখানা তৈরি বন্ধ করে জিনিসপত্র গুটিয়ে নিয়ে চলে যান। পরে মোদির রাজ্য গুজরাটে কারখানা তৈরি করেন। আমাদের রাজ্যে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা  বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসেছে। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি  ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সব ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও কিন্তু আমার মনে হয়েছে প্রাসঙ্গিক। সবকিছু নিয়েই তো আমাদের জীবন।আত্ম কাহিনীর শুরুতেই তো জানিয়েছি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ(১৯৬৫) আমার শিশুমনে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল। তাই যে কোনও হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও যুদ্ধে মহিলাদের  বিশেষ ভূমিকা থাকে না, তবুও তারাই প্রতিপক্ষের সহজ শিকার হয়। তাই এই সব  কিছুই  আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। আমাদের ভালমন্দ থাকা নির্ভর করে সরকারের বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্তের ওপর।
   (ক্রমশ)

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments