জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো/পর্ব ৬/সুকন্যা সাহা


আমি আমার মতো
পর্ব ৬
সুকন্যা সাহা 

ছোটঠাকুমা 

ছোটো থেকেই আমরা একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ। আমরা মানে আমি আর  আমার  বোন। সাহা  পরিবারের  সবেধন নীলমণি উত্তরাধিকার। বাবারা দুই ভাই  তিন বোন। বড়  পিসি বিবাহিত। দুই ছোটো  পিসি, ঠাকুমা  দাদু বাবা  মা   সকলকে  নিয়ে যৌথ পরিবার।আর  ছিলেন বাবার  পিসি আমাদের ছোটো ঠাকুমা। বাঙ্গালী  ঠাকুমা । যার  কথা   না লিখলে  আমাদের  ছোটোবেলাটাই  অসম্পূর্ণ  থেকে যাবে।সেই  ছোটো ঠাকুমার নাম কেন বাঙ্গালী  ঠাকুমা হল... সেটা আজও আমার কাছে  রহস্য। তবে  খুব ছোটোবেলায় পিসতুতো দাদারা ক্ষেপাত ছোট ঠাকুমাকে বাইন্যা  মরিচ   বলে। আর তেলে  বেগুনে   জ্বলে  উঠত সত্তরের থুত্থুরে বুড়ি। বাইন্যা  মরিচ তর বাপ; তর ঠাকুর্দা। আমারে  বাইন্যা মরিচ  কস ক্যান ? ক্ষুদে  বিচ্ছু পিসতুতো দাদারাও  কম  যেত  না ... তবে কি কমু ? বাঙালি ? বাঙ্গালি পুঁটি মাছের কাঙালি !  খুব   সম্ভবতঃ সেখান  থেকেই ইউনিভার্সাল বাঙালি নামের  উৎপত্তি। এমনকি বাড়ির  বড়রাও ভুলে  গিয়েছিল ছোট ঠাকুমার আসল নাম । এমনকি বাবা  পিসিরাও ওই বাঙ্গালী  নামেই ডাকত। এক  মা  খালি পিসিমা  বলে ডাকত। আর  মাকেও  ছোট  ঠাকুমা বউ   বলে  ডাকত আজীবন ।খুব   সম্ভবতঃ মা  অন্য পরিবারের মেয়ে  ছিল  তাই  ... স্বামীর সংসার   না করতে পেয়ে দাদার  ঘাড়ে উঠলে  যা  হয় ... ছোটোবেলা   থেকেই কাউকে সম্মান করতে দেখি নি ছোটো ঠাকুমাকে ... এজন্য  অবশ্য খুব  কিছু  দুঃখবোধও  ছিল  না ছোটো ঠাকুমার । দুই আদরের  নাতনিকে ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে ।বাড়ির  সবাই  হেলা ফেলা   করত  বলেই  কিনা জানি না আমার এই ছোটো ঠাকুমার  ওপর বিশেষ মায়া   ছিল। যে কোন  খাবার  জিনিস  কেউ  দিলে ছুটতে  ছুটতে  আগে   নিয়ে   আসতাম ছোটো ঠাকুমার   জন্য । অনেক  সময় রাগ   করে   বলতাম এত  বলদ  কেন  তুমি ? সবাই তোমারে খাটাইয়্যা  নেয় বিনিময়ে  সামান্য  মুখের   মিষ্টিটুকু  দেয়  না ... কি পাও  তুমি বেগার দিইয়্যা ... ফোকলা দাঁতে ঠোঁট  এঁটো  করা   অনাবিল হাসি হেসে বলত হুই উপরওয়ালা   জানে ! এতরকম তো মানুষ  দেখি এখন চারদিকে   এমন সহজ সরল মানুষ তো আর  দেখি  না ! মাঝে মাঝে   বলতাম, ও বুড়ি অসুখ বিসুখে  পড়লে তোমারে দ্যাখব কে ? কিছু  বলত না ; নীরবে হাসত  খালি... আকাশের দিকে হাত তুলে   বলত   আমার তো  কেউ  নাই আমার   ভগমান আছেন ...যার কেউ নাই তার   ভগমান আছেন ... আমিও  বলতাম  হুঁ দেখব তোমার   ভগমান  কেমন তোমায় দ্যাখেন ! বিশ্বাস   করবেন  কিনা জানিনা মাত্র   একদিনের   জ্বরে সটান  ওপরে চলে   গেলেন  ছোটোঠাকুমা । আমাদের ডাক্তার ডাকবারও সুযোগ  দেননি ।   মনে  হয়েছিল  ভগমান সত্যিই আছেন ... যার কেউ  নেই, সত্যিই তার কায়মনোবাক্যের প্রার্থনা শোনেন । জীবনের   শেষ দিন পর্যন্ত কখনও মুখের অনাবিল হাসি মুছে যেতে দেখিনি।আসলে  দুশ্চিন্তা টেনশান স্পর্শ করতেও পারত না এইসব মানুষগুলোকে ।  বড় সাধাসিধে   ছিলেন যে !ব্রাশ পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজতেন না।ছিল নিমডালের দাঁতন আর লাল দন্ত মাঞ্জন। বিলাসিতা   বলতে এইটুকু। স্নো ক্রিম পাউডারের ধার ধারতেন না ... সারা বছরে পুজোর সময়ে সবাই ভালোবেসে যে কাপড় দিত  তাতেই  চলে যেত সারাটা বছর। তাও সবগুলো  পড়া হত না ... আলমারির তাকে তাকে সেসব শাড়ি চাদর পড়েই থাকত।বিধবা বলে কালো ইঞ্চি পাড়ের সাদা থান  পড়তেন সারাজীবন।মাঝে মাঝে আমি জিজ্ঞেস করতাম, ও বাঙ্গালী তোমার এত শাড়ি কারে  দিয়া যাইবা? একমুখ  সরল  হাসি  হেসে বলত,তোরা  নিয়া নিস সব।আমার কোনো দুঃখ নাই। মাঝে মাঝে ভাবি এই যে শ্বশুরবাড়ির অগাধ অঢেল সম্পত্তি যার অনেকটাই  নিজের অর্জিত সব এককথায় ছেড়ে আসতে  পেরেছি  এও বোধহয়  উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ... প্রায় আশি বিরাশি  বছর বেঁচেছিলেন; অত বয়স পর্যন্ত চশমা লাগেনি,বেশিরভাগ দাঁত অক্ষত ছিল।আর কথায় কথায় অ্যালোপ্যাথি ওষুধ? নৈব নৈব চ ...পাড়াতেই একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার  ছিলেন  বারোমাস তার বিনেপয়সার ওষুধ  খেতেন।আর এই নিয়ে  কোনোদিন কোনো অভাব অভিযোগ  শুনিনি তার মুখে ... স্বল্পে সন্তুষ্ট এই মানুষটি আজকের এই ভোগবাদ আর অতি চাহিদার জগতে একজন আদর্শ স্বরূপ। অথচ আজীবন লোকে তার সরলতাকে বোকামির অভিধায় ভূষিত করে এল।খুব বকবক করতেন ছোটঠাকুমা।একা একাই। এজন্য বাড়িতে কেউ না থাকলেও সবাই ভাবত অনেক লোক আছে।ছিঁচকে চুরির হাত থেকে রক্ষা পেতাম এভাবে।তবু এত অ্যাডভাণ্টেজ থাকলেও তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে মানুষটাকে কথা শুনিয়ে আনন্দ পেতাম এই আমরাই।আজ তার মৃত্যুর পর অনুতাপ হয় ঠিকই; কথায়  বলে না মৃত্যু সব দোষ মুছে দিয়ে যায় ...
 (ক্রমশঃ)

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments