জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৫১/রোশেনারা খান


যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব – ৫১

২০১১ সালের পর থেকে আমার জীবনটা  যেমন  ঘটনাবহুল হয়ে উঠল,  তেমন অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে এসে জীবনটা এমন দিকে বাঁক নিতে থাকল, যে  তার জন্য কোনভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমার খুশি, আমার হাসি ক্রমশ নিভে আসতে লাগল। আগেই বলেছি আল-আমিন মিশনের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসালাম সাহেবের সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে ভাইপো সোহেলকে আমি আর ওর বাবা খলতপুরে নিয়ে যাই। সেদিন ত্রিপুরা থেকে আরা একটি ছাত্র এসেছিল তার দিদি-জামাইবাবু ও বাবার সঙ্গে। ওই ছেলেটি ও সোহেল পরিক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়। সোহেলের ক্লাস মেদিনীপুরে হবে। আমার খুড়তুতোভাই এফ আর খানের বিয়ের সময় ওর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শ্বশুরমশায় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে ত্রিপুরাতে থাকতেন, ওখানেই ওনার চাকরি জীবন কেটেছে। একমাত্র মেয়ে মৌসুমিকে কলকাতায় নিয়ে এসে বিয়ে দিয়েছিলেন। এখন শান্তিনিকেতনে বাড়ি করে বসবাস করেন। ডেন্টিস্ট ছেলে ত্রিপুরাতেই থেকে গেছে। কথা বলে জানলাম এই  পরিবারটি ওঁদের চেনেন। এঁদের কাছেই জানলাম এফ আর খানের শ্যালকের নাম আশিস খান। পরে মৌসুমির কাছে নামটি যাচাই করে নিয়েছিলাম।
আমার ছেলে বকুল

    সংসার জীবন যেমন কাটার কথা, তেমনই কাটছে। চাপ বাড়ছে ধিরে ধিরে। ঘরেবাইরে দুই জায়গাতেই। শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ির যেকোনো সমস্যায় খান সাহেব যান না, আমাকেই যেতে হয়। তারই মাঝে লেখাও চলছে। ইংল্যান্ড যাওয়ার পূর্বে বিনোদ ‘শব্দের মিছিল’ এর জন্য একটা লেখার কথা বলে রেখেছিল। ওদের ইংল্যান্ডের পরিবহণ ব্যবস্থার ওপর একটা প্রবন্ধ দিলাম। ভাইপো সোহেলের কিছু জিনিস কেনার জন্য বড়বাজার যেতে হবে।  আগামিকাল ওর বাবা আসবে ওকে এলাহিগঞ্জে (আল-আমিন অ্যাকাডেমিতে) পৌঁছে দিতে। আমাকেও যেতে হবে সঙ্গে।  পরদিন সকালে নীল(ছোট কাকার সেজছেলে) এল দেখা করতে। ওরা এপাড়াতেই আমার পিসতুতো দিদি পরিদিদের বাড়িতে উঠেছে। অনেক গল্প হল, কথা হল। আমার সঙ্গে ছবি তুলল। আমাকে বলল, দিদি তোমার বয়স বাড়েনি। আগের বার যেমন দেখে গেছলাম, তেমনই আছ। এই নিয়ে খুব হাসাহাসি হল। নীল আর খোকন( রেজাউর রহমান খান ও এফ আর খান) মঙ্গলাপোতা  যাবে বাপ- ঠাকুরদার ভিটে দেখতে যাবে।
এলাহি গঞ্জে "আল আমিন একাডেমি"

    বেশ কয়েকদিন হল সোহেলকে আল-আমিন অ্যাকাডেমিতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। ভাবলাম আজ একবার দেখা করে এলে কেমন হয়? বিকেলে বাসে করে ওর হস্টেলে গেলাম। আমার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলল না, শুধু প্রশ্নের উত্তর টুকু দিল। আমার ফোন থেকে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলাম। আমকে দেখে ওর আরও মনখারাপ হল। কেন যে এত ছোট বয়সে হসটেলে দিল,জানিনা। আমার সন্তান হলে কিছুতেই পাঠাতাম না।

    রোজ ভাবছি নতুন লেখায় হাত দেব, বিষয় ঠিক করাই আছে। অথচ লেখায় মন বসছে না। যারা লেখেন, তারা নিয়মিত নিয়ম করে লিখতে বসেন। আমি লিখি রান্নাঘর আর লেখার টেবিল  একবার কলম হাতে, একবার খুন্তি হাতে দৌড়াদৌড়ি করে। আসলে রান্না করতে করতে কিছু মনে পড়লে খুন্তি রেখে দৌড়ে গিয়ে লিখে আসি। কিছুদিন হল সেটা পারছিনা। খান সাহেব মাঝেমাঝে বলেন, লেখালিখি কি ছেড়েই দিলে? আমি  কিছু বলতে পারছি না, এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে কম লিখি বলে লেখা ভাল হয়, পাঠক  আমার লেখা পড়েন, মতামত জানিয়ে থাকেন। সেই ‘কম’ লেখাটাও হয়ে উঠছে না।
খুড়তুতোভাই নীল আর আমরা দুজন।

      এখন ২০১১ সালের এপ্রিল মাস চলছে, কয়েকদিন আগে জারাসোনার জন্মদিন গেল। আজ এক প্রতিবেশী  ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ করে  গেলেন। আমার ছেলের যে কবে বিয়ে দিয়ে উঠতে পারব, জানিনা। পছন্দ মত মেয়ে, পরিবার, কিছুই পাচ্ছিনা। দেখা যাক, কবে ওর বিয়ের ফুল ফোটে।
    চারিদিকের পরিস্থিতি কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। বিশ্বাস করার মত মানুষ পাচ্ছিনা। গ্রামের মানুষের মনে যে সরলতা, অতিথিপরায়ণতা, পরস্পরের  সদ্ভাব দেখা যেত, তেমনটা আর দেখা যায় না। এক সময়ের সহজ সরল মানুষগুলো হয়ে উঠছে রাজনৈতিক খেলার ‘বোড়ে’। যে রাজনৈতিক হানাহানি চলছে, তাতে প্রথম আঘাতটা এদের ওপরেই আসছে। এদের জীবনে রাজনৈতিক দলাদলি এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে এরা সব কিছুর মধ্যে রাজনীতি খোজে। সকাল  থেকেই পাড়ার চা-দোকেনে শুরু হয় আলোচনা। যে কারণে সারা গ্রাম বাংলা জুড়েই চলছে হানাহানি। এখন গ্রামে যেতে ভয় করে।
      আজ(২৮ ফেব্রুয়ারি) আমাদের পাড়ায় একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গাছে। আজহারুদ্দিন খানের ছোটবৌমা(সুমনের স্ত্রী) ও নাতনি বাইক এক্সিডেন্টে  মারা গেছে। বাইকে বাকুড়া থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার পথে আজ এই এক্সিডেন্ট হয়েছে। বিকেলে মৃতদেহ আসার পর বাড়ির সামনের রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা ছিলনা।  আমার বড়দি সুমনের স্ত্রীর আপন জেঠিমা। ওখান থেকেও আত্মীয়স্বজন এসেছেন । 
      এই বছরেই(২০১১ র মার্চ) জাপানে ভয়ঙ্করভাবে সুনামি,ভুমিকম্প, সেইসঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের কথা গতকাল বি বি সি র খবরে জেনেছি। আজ খবরে দেখছি, জাপানে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রচুর মানুষের। সমগ্র  জাপান বিদ্যুৎহীন, তার ওপর পরমাণু চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনেকে এই  ক্ষয়ক্ষতিকে হিরোসিমা নাগাসাকির সঙ্গে তুলনা করছেন।
    তবে সবই খারাপ খবর নয়। ভালমন্দ নিয়েই আমাদের জীবন। ভাল খবর হল আমার মাসতুতো বোনের ছেলে মুন্না চাকরি পেয়েছে। এস এস সি দিয়ে এক  চান্সেই পেয়ে গেছে। যাক, মা-ছেলের আর চিন্তা থাকল না। ও যখন খুবই ছোট তখন ওর বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেলে তখন থেকেই আমার এই বোন বাবার কাছেই থাকে। মেসো খুব যত্ন করে, সবদিক খেয়াল রেখে নাতিকে বড় করেছেন। মুন্না ছাত্র হিসেবেও খুবই ভাল। কেমিস্ট্রিতে ফাস্টক্লাস পেয়ে বিদ্যাসাগর বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পাস করেছে।

      সোহেলকে(ভাইপো) আল-আমিন মিশনে পৌছাতে গেলে ইস্রাফিল এক দম্পতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওরা ওদের ছেলেকে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে। ওর বাবা মাকে আমি চিনি। ওর বাবা আমার খুড় শাশুড়ির সৎমামা।  ছাত্র অবস্থায় আমার শ্বশুর বাড়িতে থেকে গ্রামের  মাদ্রাসায় পড়তেন। শাশুড়িমা নিজের ছেলের মতই যত্ন আত্তি করতেন। পরে বাংলাদেশে গিয়ে পড়াশোনা করে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ওদেশের ডিগ্রির এদেশে কোনো মূল্য ছিলনা। এখানে এক ডাক্তারের কাছে কম্পাউডার হিসেবে যোগ দিয়ে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি একটি বিশেষ কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ডাক্তারের মৃত্যুর পর এই বিশেষ কাজটি তাঁর রোজগারের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে। উনিও ফুলে ফেঁপে ওঠেন। ধিরে ধিরে ডাক্তার হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। ততদিনে শৈশব  কৈশোরের ইতিহাস ভুলে গেছেন, কোনোদিন আমার শাশুড়িমাকে দেখতেও যাননি। তখন উনি  পৌরপিতা হওয়ার জন্য ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছেন। ওনার নাম মীর এরশাদ আলি।(বেঁচে আছেন কি না জানি না) এখানে এতদিন নাজিম আহামেদকেই লড়তে ও জিততে দেখেছি।
      পছন্দ মত পাত্রী পাচ্ছি না। পাত্রীপক্ষ চাইছে পাত্র আসুক, এদিকে ও পাত্রী দেখতে চাইছে না। আমার শরীরটা কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। কান থেকে মুখের দিকে একটা ব্যথা হচ্ছে। দীপ বলছে, এটা নার্ভের সমস্যা হতে পারে। তাই নিউরোলজিস্ট দেখাতে বলল। মাসে দুবার একজন ডাক্তার আসেন, ডঃ কুণ্ডু।  কল্পতরুতে বসেন। ওনাকেই দেখালাম। ব্রেনের সিটিস্ক্যান করতে বললেন, করালামও। খারাপ কিছু ধরা পড়ল না। উনি মেডিসিন দিলেন। কিন্তু কাজ তো হলই না, আরও সমস্যা দেখা দিল। রাতে ঘুমের মধ্যে মাথা, হাত ঝাকুনি দিয়ে উঠতে লাগল। আবার ডাক্তারের কাছে গেলে মেডিসিন পাল্টে দিলেন। এই মেডিসিনে মাথার চুল উঠতে শুরু করল। কি যে হবে? জানিনা। মন ভাল লাগছে না।

    আজ আমাদের নতুন গাড়ি কেনা হল। ব্ল্যাক কালারের অলটো। এতেই আমাদের চলে যাবে। বকুলের জেদেই কেনা হল। আমাদের কথা ভেবেই ও এই  সিধান্ত নিয়েছে। গাড়ি রাখার জায়গা ছিল না, সামনের প্রাচীর ভেঙ্গে ভাঁজ করা গেট লাগিয়ে ব্যবস্থা করা হল। সব সময়ের ড্রাইভার রাখা সম্ভব ন্য। এক তো  ব্যয়সাপেক্ষ ব্যপার, তার ওপর গাড়ি তো মাসে ২/১ বারের বেশি বের হবে না।

      আজ সন্ধ্যায়(১৯ আগস্ট) খবর পেলাম মুক্তারকাকা মারা গেছেন।  তখুনি অলিগঞ্জ ছুটে গেলাম। ইনি ঠাকুরদার দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম সন্তান। পার্টি করতেন। ওখানেই কাজল কাকিমার সঙ্গে আলাপ। কাকিমা ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে ছিলেন। বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্ম কোন বাধা হয়নি। তবে কাকিমা ইসলাম ধর্মের সবকিছু  মেনে চললেও  সিন্দুর আর নোয়া পরতেন। বলতেন, কেন জানিনা আমার মনে হয় এগুলো না পরলে আমার স্বামীর অমঙ্গল হবে। ঠাকুমা তখন বেঁচে ছিলেন, এ নিয়ে তিনি বা অন্য কেউ আপত্তি করেননি। কাকিমা কিন্তু যথেষ্ট শিক্ষিতা ও  অন্যান্য ক্ষেত্রে উদারমনা ছিলেন। মুক্তার কাকার সঙ্গে আমার ভাল যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন বিষয়ে, আমার লেখা নিয়ে কথা হত। মুক্তার কাকার মামাবাড়ির তরফ থেকে নাজিম আহমেদ আত্মীয় ছিলেন।
                                ক্রমশ

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments