জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৫২/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫২

মেয়েরা তো অনেক দূরে থাকে, চাইলেও দেখা করতে পারি না। তাই বকুল বাড়ি এলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ওর পছন্দমত খাবার বানানোর চেষ্টা করি।সবার হাতের রান্না শুধু নয়, খেতে দেওয়াও পছন্দ হয় না। মায়ের ছাড়া নানি আর মাসির খেতে দেওয়া পছন্দ করে। খাওয়ার সময় কোন কথা বলা চলবে না।  একবারেই বেশি করে খাবার দিতে হবে। কিছু নেবে কিনা ,বা এটা খাসনি কেন? জিজ্ঞেস করা যাবে না। টেবিল চেয়ারে নয়,  মেঝেতে বসে খেতে  খেতে বই পড়ার অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই। ওর সব কথা মায়ের সঙ্গে। একসাথে খাওয়া, গল্প করা, ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা, এসবে বাপিকে নিত না। তাঁকে বরাবরই এড়িয়ে চলে। দুজনের মধ্যে খুব কম কথা হয়। আমার তো মনে হয় প্রায় সব পরিবারেই ছেলেরা এরকমই হয়। মেয়েরা ঠিক এর উল্টো, তারা বাবার ভক্ত হয়। তার মানে এই নয়, যে বাবারা ছেলেকে কম ভাল বাসেন। কাঁথিতে থাকাকালে একটি বেশ সুখি পরিবারকে দেখেছিলাম, আলাপও হয়েছিল। ওঁদের বাড়ি মেদিনীপুর শহরে। কাঁথিতে একটি খেলার সরঞ্জামের দোকান চালাতেন। দোকানে খুব একটা বসতেন না, বিভিন্ন স্কুল-কলেজে খেলার জিনিসপত্র সাপ্লাই দিতে। স্বামী-স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার। ওনাদের পরিবার যে খুব বনেদি, তা চেহারা ও আচার আচরণেই বোঝা যেত।
 মেদিনীপুরের কোন এক নার্সিংহমে দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের পর সিজারের সেলাই ফেতে স্ত্রী মারা গেলে সদ্যজাত সন্তানটিকে এক আত্মীয়ার কাছে রেখে বড় ছেলেকে নিয়ে কাঁথি ফিরে আসেন। আগের জীবন আর রইল না। ছেলে এখন সর্বক্ষণের সঙ্গি। স্কুলে পাঠাতে পারেননি। একদিন দেখলাম দোকানের মধ্যে স্টোভ জ্বেলে রান্না করছেন। চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে, কয়েক মাসে যেন কত বয়স বেড়ে গেছে। বললেন, কি করব? এভাবেই চালাচ্ছি। অসুবিধা হয় দূরের স্কুল কলেজে মাল সাপ্লাই দেওয়ার সময়। ওকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এবছরটা নষ্ট হল, সামনের বছর আবার স্কুলে ভর্তি করব। উনি কিন্তু ইচ্ছে করলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতেন, কিন্তু করেনন। এমনিতেই তো চারটি বিয়ের অধিকার আছেই।

    যাক, আমার কথায় আসি। কোনো কাজ হচ্ছে না। কিছুতেই লেখা আসছে না। আজ পাপু আশাপূর্ণা দেবীর ‘বকুল কথা’ ফেরৎ দিয়ে গেছে। লেখিকা কত কি ভেবেছেন ও লিখেছেন। আমার ভাবনাই সার হচ্ছে, লেখা হচ্ছে না।  মাঝে মাঝে  ক্রিকেট খেলা দেখছি। কলকাতার ইডেনে টি ২০ খেলা চলছে। স্বাভাবিক ভাবেই ‘কে কে আর’ কে সমর্থন করছি। আজ ১ জুলাই, সারদা কল্যাণ ভাণ্ডার থেকে রেখাদি ফোন করে জানতে চাইলেন, ৮ জুলাই স্টুডেন্টদের ইন্টারভিউ আছে, আমি  যেতে পারব কি না। আমি অসুবিধা নেই বলাতে, বললেন তাহলে ওইদিন তুমি আর নন্দিনী ইন্টাররভিউ নেবে। চিঠি পাঠিয়ে দিচ্ছি। 
    অনেকদিন পর নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে অনেক কথা হল। এদিকে বকুলের খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। সাবিনা ফোনে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না,আমি খেয়াল রাখছি। রোজ ওর সঙ্গে ফোনে কথা না বললে মন শান্তি পাই না। ওকে নিয়েই  আমার বেশি চিন্তা। কবে যে ওর ঘরসংসার হবে, জানিনা। এদিকে মায়ের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, আজ গড়বেতা এসেছে। ওখানে মেজ ছেলের কাছে থেকে ডাক্তার  দেখাবে। তেমন হলে এখানে নিয়ে এসে ডাক্তার দেখানো হবে। সে দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়,  সবার এই দায়িত্বটি আমাকেই নিতে হয়।দাদার দু’বার অপারেশন  হয়েছে আমার এখান থেকে। বৌদির ডেলিভারি হয়েছে এখান থেকে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ঝামেলা আমাকে পোয়াতে হয়েছে। মা বা শাশুড়ি মায়ের ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, এঁদের ভালমন্দ দেখা আমার মানবিক দায়িত্ব, এদের সুবিধা অসুবিধার কথা এঁরা আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আমি এঁদের বুঝি। শাশুড়ি মায়ের হাত  ভাঙতে সবটা আমি আর আমার ভাই করেছি। সেদিন শাশুড়িমা বলেছিলেন, বিপদের সময় আমার দশ দশটা ছেলেমেয়ে কেউ তো কাজে এলনা! খান সাহেবের পোস্টিং তখন খড়কুশমা ব্রাঞ্চে। উনিও সেদিন ছিলেন না। আসলে এঁদের ধ্যান ধারণা অন্য রকম, স্বামী- সন্তানের বাইরে অন্য কেউ দায়িত্ব নিতে পারে এটা ভাবতেই পারেন না। এরা জন্ম থেকেই পুরুষ নির্ভর।
    খান সাহেব রিটায়ার্ড হওয়ার পর মাঝে মাঝে কাছে পিঠে বেড়িয়ে আসি। জুলাইয়ের শেষ, বৃষ্টির কারণে গরম কিছুটা কমেছে। একদিন সকালে ট্রেন ধরে শুশুনিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ছাতনাতে নেমে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম।  তখন ওখানে কিছুই তেমন ছিলনা। শুধু গরিব পাথর শিল্পীরা তাদের পসরা সাজিয়ে তীর্থের কাকের মত বসে আছেন। ওদের থেকে কয়েকটা জিনিস কিনলাম। এখানের ঝর্নার জলটি খুব সুস্বাদু। শুনলাম পাহাড়ে অনেককিছু  দেখার রয়েছে। শিলালিপি রয়েছে, রয়েছে জানা অজানা পশুর জীবাশ্ম। পাহাড়ে ওঠা শুরু করেছিলাম। কিন্তু কিছুটা ওঠার পর নেমে আসলাম। খান সাহেবে উঠতে দিলেন না।
    আগস্টে হঠাৎ করেই  লন্ডনে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে, খবরে জানলাম। লন্ডন  থেকে বারমিংহাম ও নটিংহামে ছড়িয়ে পড়েছে। ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদা, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের লড়াই। ব্রিটিশ পুলিশ নাকি এদের মানুষ বলেই মনে করে না। ওদের তেমন কোনো সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হয় না। গণ্ডগোলের বিষয়ে জানতে বাবলিকে ফোন করেছিলাম। ও বলল, সিটিসেন্টারের দিকে হতে পারে। আমি ঠিক জানিনা। খবরে অবশ্য বাজার এলাকার কথাই বলা হচ্ছে। পরের দিনই বাবলি জানালো, গণ্ডগোল থেমে গেছে। বারমিংহামে যে তিনটি মুসলিম ছেলে মারা গেছে, তারা খুবই সাধারণ। একটি ছেলে তো বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।ব্যপারটা খুবই দুঃখজনক।

      আজ আমাদের ৪৪ তম স্বাধীনতা দিবস। বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে যেতাম, এখন যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তবে সকাল থেকে প্রচুর শুভেচ্ছা বার্তা পাচ্ছি। দূরদর্শনে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু আজকাল টিভি অন করা দায়, এদিকে সুশান্ত ঘোষের কঙ্কালকাণ্ড ওদিকে আন্না হাজারের ‘লোকপাল বিল’। সারাদিন এই নিয়েই কচকচানি চলছে।

    যাই করিনা কেন, সামাজিক দায়িত্ব তো এড়িয়ে যেতে পারিনা। আজ মুক্তার কাকার কাজ, যেতেই হবে। এদিকে ‘সারদা কল্যাণ ভাণ্ডার’ থেকে রেখাদি ফোন  করেছিলেন। ২৮ আগস্টের মিটিংএ যেন অবশ্যই যাই। বলেছি চেষ্টা করব। আগে তো ডাক্তার কী বলেন দেখি। আর একটা নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেটা খান সাহেবকে বলিনি। ওনার দুশ্চিন্তা বাড়াতে চাই না। চিন্তায় আছি, ডাক্তার আবার সিটিস্ক্যান করতে বললে অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে যাবে।
    আন্না হাজারের আন্দোলনকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজে উঁচু তলার বহুমানুষ সমর্থন কছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। অভিনেতা রঘুবির যাদব আজ আন্না হাজারের অনশন মঞ্চে গিয়েছিলেন। কিরণ বেদীর মত ব্যক্তিত্বরা তো আছেনই। জিনিসপত্রের দাম দিনদিন বেড়েই চলেছে। ৫০/৬০ টাকার নীচে কোনও সবজি নেই, অন্যান্য জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ১০গ্রাম সোনার দাম আখন ২৭০০০ টাকা, সেটা থেমে নেই। প্রতিদিন বাড়ছে।

  আজ আমাদের একটি বিশেষ দিন। সেটা হল নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে। জীবনে কোনদিন ভাবিনি নিজেদের গাড়ি হবে। সে যে দামেরই হোক না কেন। খড়গপুরের ভাণ্ডারীর শোরুম থেকে নেওয়া হল। বাবলি বকুল দুজনেই গাড়ির কথা জানতে ফোন করে ছিল। সেই সময় আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা চারচাকা থাকা মানে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। ঘোড়া কিনলেও চাবুক কেনার সাধ্য ছিল না, সবসময়ের ড্রাইভার রাখা সম্ভব নয়। মাসে ৫/৬০০০ টাকা খরচ  করব কোথা থেকে? খান সাহেব ২০০৭ এ রিটায়ার্ড হয়েছেন টাকাপয়সা যা পাওয়ার তা তখুনি পেয়ে গেছেন। এখন কলসির জল ঢেলে ঢেলে খাওয়া। তাছাড়া গাড়ি ব্যবহার হবে কতটুকু? মাসে ১/২ দিনের বেশি গাড়ি নিয়ে বের হওয়া হবে না। তার জন্য আশেপাশে অনেক ড্রাইভার আছে, ২/৩দিন আগে বলে রাখলেই পাওয়া যাবে।
                                            (ক্রমশ)

ক্লিক করে পড়ুন। পি সি সরকার জুনিয়রের সাক্ষাৎকার। 👇
 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments