জ্বলদর্চি

অধ্যাপক দিলীপ রায় (বৃক্ষ প্রেমী)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩১

অধ্যাপক দিলীপ রায় (বৃক্ষ প্রেমী)

ভাস্করব্রত পতি

এখানে এলে মনপ্রাণ নাড়িয়ে দেয়। দুদণ্ড দাঁড়িয়ে জিরোতে ইচ্ছা করে। গাছগাছালি পাখপাখালি আপন করে নিতে হাত বাড়ায়। চারিদিকে অজস্র ফুলের গাছ। বাহারি গাছ। লুপ্তপ্রায় গাছ। রঙবেরঙের অর্কিড থেকে শীতকালীন ফুল। না, কোনো ব্যবসায়িক কারণে এত ফুলের সমারোহ এখানে নয়। তমলুকের নাড়াদাঁড়ি গ্রামে অধ্যাপক দিলীপ রায়ের হাতের যাদুতে গ্রাম জুড়েই ফুলের উৎসব। সবুজের উৎসব।

এখানে নাকি শ্মশানেও ফুল ফোটে। রাস্তার দু'পাশে চলতে চলতে দেখা মিলবে ফুলের আলিঙ্গণ। গ্রামের মানুষও মজেছে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে। তাই ছোট থেকে বড় সবার হৃদয়ে পরিবেশ সচেতনতার মন্ত্র। সারা বছর ধরে নানা ধরনের ফুলে ফুললিত এই সুললিত গ্রাম। 

আর অভিনব এই পরিবেশ আরাধনার মূল পুরোহিত 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দিলীপ রায়। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করে ময়না কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন। গাছের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকে নাড়াদাঁড়ি গ্রামের বাড়িতে শুরু করেছেন গাছের উৎসব। সেই উৎসবের রেশ আজ গ্রাম ছাড়িয়ে জেলা, জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যে। ছোট্ট মাটির বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বহু মানুষের মননে।

কোনো পুরাণ বা বেদ থেকে উচ্চারিত মন্ত্রে নয়, পরিবেশকে ভালোবাসার গূঢ় মন্ত্র তিনি শিখিয়েছেন গাছের সাথে মানুষকে একাত্মিভূত করেই। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিটি মানুষ যদি এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারে তবে পৃথিবীর বুকে জমবেনা দূষণের কালো ছায়া। একটা নির্মল মনোহর প্রশান্তির পরিবেশ রচিত হবে বিশ্বজুড়ে।

মানুষের মধ্যে গাছের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে বীতশোক পট্টনায়েকদের সাথে নিয়ে তৈরি করেছেন 'তমলুক ফ্লাওয়ার লাভার্স অ্যাসোসিয়েশান'। তিনি এখন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এই অভিনব সংগঠনের। সমীর খাটুয়া, ক্ষুদিরাম বেরাদের উদ্যোগে পুষ্পমেলায় প্রদর্শিত কাশাগ্রান্ডি ফুলটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও লাভ করেছে। যেটির নতুন নাম হয়েছে ‘কুইন অফ তমলুক’। আর তিনি? 'Gardener of Tamluk'!

তমলুক পৌরসভা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে প্রতি বছর লাগানো হয় অসংখ্য গাছ। দুষ্প্রাপ্য বাওবাব (Adansonia digitata) গাছ আজ আফ্রিকা ছেড়ে তমলুকের আনাচে কানাচে বেড়ে উঠছে এই সংগঠনের বদান্যতায়। যার মূল কারিগর দিলীপ রায়। এছাড়াও আয়োজিত হয় পুষ্প প্রদর্শনী। নানা ধরনের ফুলের সম্ভার নিয়ে সেই প্রদর্শনীতে বেলাগাম উন্মাদনা। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনের কোণে জেগেছে ফুলগাছ লাগানোর তীব্র বাসনা। যা পক্ষান্তরে পরিবেশ সচেতনতার ফসল।

প্রকৃতি এখানে হাতের নাগালে। এখানে এলে অশোক, জারুল, পলাশ, আম, অমলতাস, রুদ্রপলাশ গাছের ছায়া, আর ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ্দুর পথচলতি মানুষকে স্বাগত জানায়। প্রকৃতি, ফুল আর পরিবেশ এখানে আত্মীয় রূপে হাজির। পুকুরের জলে আফ্রিকার বন্য শালুক থেকে একতারা বানানোর লাউতুম্বি গাছ অপেক্ষা করে পরিবেশের পাঠ বোঝাতে।

বিভিন্ন ধরনের পেশার মানুষ আসেন দিলীপবাবুর সহকারি হিসেবে। সকলেই চান সবুজের বিপ্লবের সহায়ক হতে। তাঁর বাড়ির ধানের গোলা এখন 'বইয়ের গোলা'। সেই কলেবর দেখতে এখানে এসেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত, কেতকি কুশারী ডাইসন, নিত্যপ্রিয় ঘোষ, নিমাই ভট্টাচার্য্য প্রমুখরা। কবি শঙ্খ ঘোষ অকপটে লিখেছেন, "এত শ্রীময়, এত সুরুচিময় পরিবেশে সময় কাটাবার অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে অল্পই ঘটে। সমস্ত নির্মাণ এখানে সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। যাঁর বা যাঁদের পরিচর্যায় সেটা সম্ভব হতে পেরেছে, তাঁকে বা তাঁদের সবাইকে আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই"।

একসময় দক্ষিণ পূর্ব দিকে গড়বেতালদিঘীতে ছিল একটি শক্তিশালী জলদূর্গ। এই দূর্গে থাকতেন হরি রায়। তিনি ছ’পয়সা রাজ্যের রাজা ছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, তিনি মগ দস্যু ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের হাত থেকে তমলুকবাসীকে রক্ষা করেছিলেন। বর্তমান নাড়াদাঁড়ি গ্রামের 'রায়'রা সেই ইতিহাস আজও স্মরণ করে কৃতজ্ঞচিত্তে। এই গড়বেতালদিঘী জলদূর্গের যিনি সেনাপতি ছিলেন তাঁর উপাধি ছিল 'মহাপাত্র'। এছাড়া ভৌমিক, পট্টনায়ক, জানা পদবিধারী মানুষজনও গ্রামে নানা কীর্তির সাথে জড়িত। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের বিপ্লবী সৈনিকরা এই গ্রামেরই শ্রীপতি দাস কর্মকারের হাতে গড়া দেশী বন্দুক কাঁধে চাপিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। স্বাধীনোত্তর ভারতে সেই নাড়াদাঁড়ি গ্রামের মানুষ আজ ফুলের সাথে সখ্যতা গড়েছেন। যার মূল কারিগর অকৃতদার অধ্যাপক দিলীপ রায়।

কচিকাঁচাদের নিয়ে নিয়মিত আয়োজিত হয় প্রকৃতি পাঠের আসর। চলে গাছ চেনানোর কর্মশালা। আর গাছকে ভালোবাসার সিলেবাস বহির্ভূত পাঠক্রম। এখানে শেখানো হয়, বর্তমান পরিবেশে দূষণ যেখানে আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন, সেখানে গাছই হতে পারে নিবিড়তম 'বন্ধু'। এ সত্যতা শেখাতে পেরেছেন নাড়াদাঁড়ির দিলীপবাবু।

ড. মৌসম মজুমদার দিলীপ রায় সম্পর্কে লিখেছেন, "বিশাল বাগানে শীতের সময় ভরে ওঠে মরশুমী ফুলে। আগে নিজেই মাটি তৈরি, জল দেওয়া, সার দেওয়া সব কিছু করতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মালী রাখতে বাধ্য হয়েছেন। আর এ কাজে তাঁকে এখন সাহায্য করে তাঁর বাড়িতে থাকা অনাথ শিশুরা। হ্যাঁ, অনাথ শিশুরাই, যাঁদের কাছে তিনি 'দাদু' নামেই পরিচিত, গাছ লাগানোর পাশাপাশি বেতাল মশাল গ্রামে রামকৃষ্ণ অনাথ আশ্রমকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজের বাগানবাড়িতে মানুষ করে চলেছেন বেশ কয়েকজন দুস্থ শিশুকে। তাঁদের খাওয়া দাওয়া, পোশাক, পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। তাঁদের গাছ চিনতে শিখিয়েছেন, বিজ্ঞানসম্মত নাম শিখিয়েছেন। উত্তর প্রদেশ থেকেও অনাথ শিশুকে এনে মানুষ করে তুলেছেন তিনি। তাঁর কাছে পালিত হয়েছিল গৌরি, যাঁর বিয়ের দায়িত্ব হাসিমুখে নিজেই সামলেছেন। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এখন অনেকটাই দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন, ফলে দিলীপবাবুর কাছে এখন চার পাঁচজন থাকে। তাঁরাই এখন দিলীপ বাবুর প্রধান সহায়"।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments