আমি আমার মতো
পর্ব ৪
সুকন্যা সাহা
রথের মেলা ...
তখন বেশ ছোটো ... বয়স সাত কি আট হবে ... বাঙ্গালীর যেমন বারো মাসে তেরো পার্বন আমাদের বাড়িতেও কথায় কথায় পুজো আচ্চা লেগেই থাকত ... এক কথায় ভক্তজনের বাড়ি। দোল , রথযাত্রা সবেতেই পাব্বন আর ছোটোদের আনন্দ দেখে কে !
সেইসময় কিন্তু মা বাবাদের এত মোচ্ছব উৎসবে মেতে থাকলে পড়বে কখন এসব নিয়ে চিন্তান্বিত হতে দেখিনি ... রথের দিন সকালবেলাতেই কাঠের তিনতলা রথ হাজির। সঙ্গে মাটির জগন্নাথ বলরাম আর সুভদ্রার মূর্তি । এসব ব্যাপারে আমার দাদু মানে ঠাকুর্দার সঙ্গে আমার জমাটি ভাব ছিল। আর বংশের প্রথম সন্তান বলেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক ঠাকুমা দাদুর আদর আমার ওপর একটু বেশী বেশী ছিল । রথ সাজাবার পাতাবাহার গাছ আর ঠাকুরের বেল কুঁড়ির মালা এসে যেত না চাইতেই । আর আসত কলা আর সন্দেশ । রথে যে জগন্নাথকে কলা দিতে হয়।
আমাদের পাড়ায় আমার সমবয়সী বেশ কিছু মেয়ে ছিল...(বর্তমানে তাদের সবার বিয়ে হয়ে কলকাতার বাইরে ), তাদের সবার মধ্যে চলত রথ টানার কম্পিটিশান। উল্টো রথের দিন সেই কাঠের রথ আবার টেনে তবে ক্ষান্তি...
গেল হপ্তাহে রথ গেছে ; অফিস থেকে ফেরার পথে একটা জায়গায় দেখি লেখা আছে রথের মেলা , কৌতূহলের বশে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম । বাইরে বিক্কির হচ্ছে তালপাতার বাঁশি, একটা বড় লোহার কড়াইতে ফুটন্ত তেলে পাঁপড় ভাজছে কালো কেলো একটা বউ পরণে ডুরে শাড়ি , চুলটা উঁচু করে বাঁধা ... পাঁপড় দেখে বড় লোভ হল,প্লেন পাঁপড় আমার বড় প্রিয় ... ভাঁজে ভাঁজে এই বড় একটা গোল চাকতি... কত করে গো মাসি ? শুধোই তারে । একগাল হেসে জবাব দেয় ... "মোটে দশ ট্যাকা গো দিদিমণি , খাও , লিয়ে যাও বাড়ির জন্যি ...
বল কি দশ টাকা একটা পাঁপড় ? কি দিনকাল পড়ল ... মানুষ খাবে কি ! মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, ব্যাগে অল্প কিছু টাকা পড়ে আছে । মাসের শেষ বড় বালাই ! কিন্তু পাঁপড়ের লোভ অতিক্রম করতে পারলাম না ...
দাও ... একটা ... দশ টাকা দিয়ে পাঁপড় কিনে একটা কামড় বসালাম। কি মচমচে ! পাঁপড় না হলে রথের মেলা জমে ? মেলার বাইরের দিকে একটা লোক কাঠের হামানদিস্তা বিক্রি করছে । কাঠের হাওয়া কল , বাচ্চাদের খেলনা , আরো হরেক রকম পসরা । একজন বয়স্ক মানুষ বেলুন বিক্রি করছে, অফিস ফেরতা এক ভদ্রলোক একটা বেলুন কিনলেন , বোধহয় বুড়ো মানুষের কষ্ট দেখে দয়াপরবশ হয়ে ...মেলার ভিতরে বিক্রি হচ্ছে গরম জিলিপি, রসে টইটুম্বুর, ভন ভন করে মৌমাছি ঘুরছে ,এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি , কত করে? না পিস হিসেবে বিক্রি নেই , ওজনে নিতে হবে ... কে খাবে অত জিলিপি? তাই পা বাড়ালাম । মেদিনীপুরের বড়ি ও আচার শিল্প, পাঁপড় শিল্প কোনো কিছুরই অভাব নেই ... মণিহারীর দোকানে চকচকে কানের দুল , গলার হার , সিটি গোল্ড ... হরেক পসরা , অভাব নেই কোনও কিছুরই ... তবে লোকজন নেই বিশেষ ... টিভিতে ভারতের সেমিফাইনাল , ওতেই ব্যস্ত বোধহয় ... যাক গে আমার ওসব বালাই নেই । টিভি দেখা ছেড়েছি আগেই, কাগজ পড়াও এখন আমি শুধু মানুষ দেখি , বিভিন্ন মানুষের জীবন চরিত দেখি । একটা বাচ্চা ছেলে ময়লা জামা প্যান্ট, এককোণায় বসেছে তালপাতার ভেঁপু নিয়ে , বড্ড করুণ চোখে বলল , ও দিদি নেবে ? একটাও বিক্রি হয় নি ... ওর মায়া মাখানো চোখের টান এড়াতে পারলাম না ,কিনেই ফেললাম দুটো বাঁশি , দশ টাকা করে ।
কিরে ইস্কুল যাস না ? মলিন মুখে বলল , না । আর বেশি কথা বাড়ালাম না । কি জানি কার দুঃখের জায়গায় হাত পড়ে যায় । একটা পাগলাটে গোছের লোক ... মাথায় চুলের জট, জামাকাপড়ে অজস্র তাপ্পি , খোলা গলায় গাইছে " একবার বিদায় দে মা , ঘুরে আসি ...
আরো খানিকক্ষণ ইতি উতি ঘুরে বাড়ীর পথ ধরলাম । ঈশান কোণে জমে থাকা কালো মেঘটা তখন সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেছে ... একটা বাচ্চা মেয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ওকে দেখে আমার মনে হল রাধারাণী, মাহেশের রথের মেলায় হারিয়ে গিয়েছে ...
(ক্রমশঃ)

0 Comments