জ্বলদর্চি

শেখ আবু জাফর (ছড়া কাটা ফকির, ভিক্ষাজীবী, ডঙ্গলসা, পশ্চিম মেদিনীপুর)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩৪

শেখ আবু জাফর (ছড়া কাটা ফকির, ভিক্ষাজীবী, ডঙ্গলসা, পশ্চিম মেদিনীপুর)

ভাস্করব্রত পতি

"বাপ হল আজ গরুর রাখাল,
বাড়ির কর্তা বউ ব্যাটা!
শিশুর মতো শুনতে হবে,
আদেশ তারা করবে যেটা"!!

সমাজের অতিবাস্তব বিষয়কেই স্থান দিয়েছেন নিজের ছড়ায়। চলতে ফিরতে নিজের চোখে দেখা এমন হাজার বিষয় মনের মাধুরিমা মিশিয়ে যিনি ছড়া কাটেন তিনি 'ছড়া ফকির'। আসল নাম শেখ আবু জাফর। কিন্তু কেউই জানেনা সেই আসল পরিচয়। মেদিনীপুরের গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে তিনি ছড়া শোনান। লোকজনের মনোরঞ্জন করেন।

আসলে তিনি পেশায় একজন ভিক্ষাজীবী মানুষ। নিতান্ত গরিব এই ভিখিরির সম্বল বলতে মুখের অবিশ্রান্ত ছড়া। কতকগুলো 'ইসলামিয়া বাগিচার ফুল', 'ফুলবাগিচা' বই থেকে নেওয়া। বেশিরভাগই অবশ্য নিজের মনের অন্দরমহল থেকে তুলে আনা। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অসংখ্য ছড়ার জন্ম দেওয়াই তাঁর জলভাত ব্যাপার।

ভিক্ষাই তাঁর পেশা। কিন্তু সেই ভিক্ষাজীবী মানুষটি কখন নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন লোকশিল্পী তাঁর খোঁজ রাখার জন্য কেউই নেই। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার ডঙ্গলসা গ্রামে বাড়ি। ক্ষীরাই বাক্সি খালের আশে পাশে তাঁর একচিলতে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সদা হাস্যময় এই মানুষটির মুখে যেন ছন্দের খই ফোটে। যেকোনও বিষয়ে যেকোনও সময়ে তিনি অবলীলায় আউড়ে যেতে পারেন ছড়া এবং গান। মেদিনীপুরের তথাকথিত ছড়াকার কিংবা কবিকূলকে হেলায় হারাতে পারেন তাঁর তাৎক্ষণিক সৃষ্টির উপঢৌকন দিয়ে। আজ তাঁর মতো 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' খুঁজে পাওয়া সত্যিই বিরল।

পরণে আধ ময়লা লুঙ্গি। ফুলহাতা গেঞ্জি। কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ। তাতে ভরা তেল চিটচিটে গামছা, তেলের শিশির, চিরুনি আর ভিক্ষে করে পাওয়া চাল, মুড়ি ও খুচরো পয়সা। এক হাতে লম্বা সেকেলে ছাতা আর অন্য হাতে বাঁশের লাঠি। থুতনিতে এক গোছা সাদা দাঁড়ি। আর মুখটা যেন ছড়া তৈরির কারখানা। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে তিনি তা পরিবেশন করেন আবালবৃদ্ধবনিতার সামনে। আট থেকে আশি -- প্রত্যেকের ভালোবাসার পাত্র হয়ে উঠেছেন নিজের এই বিরল গুণের নিমিত্ত।

তাঁর মুখে হরেক কিসিমের ছড়া। হরেক স্বাদের ছড়া। ছেলে, বুড়ো, জোয়ান, মদ্দ -- সকলের মনোরঞ্জনে দুই মেদিনীপুরের গ্রাম বাংলায় এক পরিচিত নাম এই 'ছড়া ফকির'-এর। মেদিনীপুরের বুকে এক বিস্ময়কর চরিত্র।

হ্যাঁ ভিক্ষা করাই তাঁর জীবন যাপনের অন্যতম মাধ্যম। দোরে দোরে চাল, টাকা, মুড়ি চেয়েচিন্তে তাঁর চলে। অভাবের সংসারে এই পেশা তাঁর কাছে অন্যায় নয়। সম্মানের। তিনি চুরি বাটপাড়ি করেননা। মহান আল্লাহ তায়ালার একনিষ্ঠ ভক্ত। মিথ্যা বলেননা। স্রেফ দোরে দোরে ছড়া শুনিয়ে তিনি উপার্জন করেন। যদিও এটা তাঁর কাছে ভিক্ষা নয়। এ এক অলিখিত সাহিত্যকীর্তি। যে কীর্তির জন্য তিনি কখনও কবি সম্মেলনে ডাক পাননা। যে কীর্তির জন্য কেউ তাঁকে মেডেল, স্মারক, উত্তরীয় পরিয়ে দেননা। তথাকথিত এলিট কবিকূলের সংসারে আদপে তিনি ব্রাত্য কবি। দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ঘুরে ছড়া শোনানোর বিনিময়ে এক টাকা দু'টাকা পেলেই তিনি বেঁচেবর্তে যান! মুসলিম হয়েও হিন্দু শাস্ত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান তাঁর জিম্মায়।

এই পেশাকে সামনে রেখে ছড়া বানানোর নেশা তাঁকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। ছড়ায় কথা বলা, ছড়ায় গল্প শোনানো, ছড়ায় কোনো বিবরণ দেওয়া -- সবেতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। নীতিকথা, ধর্মকথা থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দেন ছড়ায়। ছড়াই তাঁর প্রেম। ছড়াই তাঁর ভালোবাসা। এই ছড়া আজ তাঁকে 'পরিচিতি' দিয়েছে, 'ভিক্ষার চাল' দিয়েছে। তাই ছড়া ফকিরের সিক্ত চোখে ভেসে ওঠে ছড়ার কলকাকলি --
"ছড়া আমায় দিয়েছে ভাত,
ছড়া আমার ভরেছে পেট!
ছড়া মেখেই কাটে যে রাত,
তাই, ছড়ার কাছেই হয়েছি হেঁট"!!

বিদ্যের জাহাজ নয়। মাত্র দু কেলাস পর্যন্ত পড়েছেন 'ছড়া ফকির' আবু জাফর। বাপু চাইলো না। ফলে ইস্কুলে যাওয়ার চ্যাপ্টার ক্লোসড। 'আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছে মৌ'-- ঘাড় দুলিয়ে মুখস্থ করার সুযোগ জোটেনি আবু জাফরের কপালে। একে গোঁড়া মুসলিম পরিবার, তায় সংসারের প্রচণ্ড অনটন। পড়াশুনার মতো 'বিলাসিতা'য় গা না ভাসানো আবু জাফরের মনের কোনে ছিল কিন্তু পড়ার অদম্য ইচ্ছা। জানার ইচ্ছা। অসম্ভব স্মৃতিশক্তির অধিকারী আবুর কথায়, 'পড়াশুনা করলে আজ হয়তো আমি জজ ব্যারিষ্টার হতাম'।

ছড়া ফকিরের স্মৃতিশক্তির দাপট দারুণ। যে কোনো বিষয়ের ওপর যে কোনো সময়ে বানিয়ে দিতে পারেন একেবারে উপযোগী কোনো ছড়া। এক নাগাড়ে বলে যেতে পারেন হাওড়া থেকে পুরি পর্যন্ত প্রতিটি রেল স্টেশনের নাম। দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে বহু মুখ্যমন্ত্রীর নামও তাঁর ঠোঁটস্থ। হকচকিয়ে যেতে পারেন যে কোনো 'কুইজার'। বিবাহিত দম্পতির কলহ, কলেজের টিন এজার প্রেম, শাশুড়ি বউ দ্বন্দ্ব, পরকিয়া থেকে শুরু করে যে কোনো সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে আবু জাফর ওরফে ছড়া ফকিরের ঠোঁটে ছড়ার ফুলঝুরি। যেন সাহিত্যের দেওয়ালির রোশনাই!

ছড়ার প্রতি এ হেন প্রেম কি করে এলো? আর এতেও সেই ছড়ায় জবাব তাঁর --
"কেউ কাটে ঘাস
কেউ কাটে বাঁশ,
কেউ কাটে গাছের গোড়া!
কেউ কাটে পকেট
কেউ কাটে লকেট,
ক'জন কাটে ছড়া?' 

এমনই তাঁর যুক্তি। ছড়া নাকি সুস্থ রাখে দেহমন। অশান্তি দূর করে, প্রশান্তি এনে দেয়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বাড়ছে। অবিশ্বাস বাড়ছে। এমতবস্থায় মন ঠিক রাখতে ছড়াই নাকি একমাত্র দাওয়াই। এ যুক্তি এই নিরক্ষর গেঁও কবির। মেদিনীপুরের মতো শিক্ষিত মানুষের ভিড়ে অপাংক্তেয় এই কবির জন্য হয়তো মঞ্চ জোটেনা, ডায়াস জোটেনা, সম্মান জোটেনা। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জোটে।

এক সময় হাপু খেলা দেখাতেন। এখন তা অচল। সেসব ছড়া বলা বন্ধ। এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কবচ মাদুলিও বেচেন। আর কাওয়ালী গান করেন। একটানা চার পাঁচ ঘন্টা শ্রোতাদের বসিয়ে রাখার বিরল ক্ষমতা এই প্রায় নিরক্ষর গেঁয়ো ভিখিরির রয়েছে। তাঁর ছড়ায় হাল্কা রসিকতার সাথে রয়েছে চটুল রসিকতার মিশ্রণ। আছে গভীর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবন যৌবনকে ঘিরে তাঁর ছড়া হাসি আনে। যাঁরা সোজা পথে চলতে চায়না, একটু বেঁকিয়ে চলা যাঁদের অভ্যাস, এই ছড়া ফকিরের ছড়া সোজা গিয়ে তাঁদের হাড়ে এবং মজ্জায় বেঁধে। এমন দাবি শ্রোতাদেরও।

পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা, পাঁশকুড়া, ময়না, সবং, তমলুক, ডেবরা, কেশপুর, দাসপুর, কোলাঘাট, খড়গপুর এলাকার গ্রামের মানুষ চেনেন এই মানুষটিকে। গ্রামে এলেই তাঁকে শোনাতে হয় নতুন নতুন ছড়া। এক বাটি চাল, এক টাকা আর এক কোচড় খুদ মুড়ির বদলে শুনিয়ে যান -- "ভিক্ষা দাও গো নগরবাসী / তোমরা আমার মাসি পিসি"।

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments