জ্বলদর্চি

সুব্রত কুমার বুড়াই (শিক্ষারত্ন, সর্প বিশেষজ্ঞ) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩২

সুব্রত কুমার বুড়াই (শিক্ষারত্ন, সর্প বিশেষজ্ঞ)

ভাস্করব্রত পতি

কোনো দিনই দেরী করে স্কুলে যাননি। তেমনি কোনো দিনই বিনা কারণে তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে আসেননি। আসলে স্কুল তাঁর কাছে 'ভালোবাসার পানপাত্র'। যে পানীয় মনের তেষ্টা মেটায়, বুকের জ্বালা জুড়ায়, চোখের প্রশান্তি আনে। যে পানীয় সমাজের জন্য নিবেদিত থাকার শক্তি জোগায়। কাজের প্রতি আবেগভরা সততা, একনিষ্ঠতা আর তাগিদ তাঁকে 'মানুষ রতন' করে তুলেছে। মেদিনীপুরের মাটিতে থেকে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন জেলাবাসীর স্বার্থে। মানুষের স্বার্থে।

আপাতত ৩৫ বছরের চাকরিতে একদিনের জন্যেও কোনো অনৈতিক সুযোগ নেননি ঘাটালের দাসপুর ২ ব্লকের গোমকপোতা গুনধর বিদ্যামন্দির উচ্চমাধ্যমিকের প্রধান শিক্ষক সুব্রত কুমার বুড়াই। এখানেই ১৮ বছর ধরে চাকরি। এর আগে ১৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন চন্দ্রকোনার চাঁদুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। যেখানেই থেকেছেন সেখানেই ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে একটা আলাদা জগৎ তৈরি করেছেন। আলাদা পরিবেশ বানিয়েছেন। শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ককে মজবুত করেছেন হৃদয় দিয়ে। ভালোবাসা দিয়ে। বুঝিয়েছেন যে, শুধু পুঁথিপাঠে নয়, সত্যিকারের মানুষ হতে হলে দরকার নিজের মানসিকতার পরিবর্তন। সমাজ, সংসার সবকিছু নিয়েই চলতে হবে একসাথে।

১৯৬৪ তে সীতাপুর গ্রামে জন্ম এই মানুষটির। বাবা সুধাংশু শেখর বুড়াই এবং মা বীণাপাণি বুড়াই। শিক্ষা পরিবেশনে তাঁর নাছোড়বান্দা কাজের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ তে পেয়েছেন 'শিক্ষারত্ন' সম্মান। সত্যিকারের আদর্শ শিক্ষকই তিনি। আসলে তিনি চেয়েছেন ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মানবিক শিক্ষা গড়ে উঠুক। শুধু 'নিজের নিজের' ভাবনা থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে এসে 'সকলের সাথে সকলে' ভাবনাতে জারিত করেছেন তিনি।

২০০৪ থেকে শুরু করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'সৃষ্টি'। জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের প্রসারে নিমগ্ন এই সংগঠন। মূলত মানুষের মন থেকে কুঃসংস্কার নিপাত করতে তিনি কাজে লাগান 'সৃষ্টি'কে। প্রতি বছর ২৮ - ৩১ শে ডিসেম্বর নবীন মানুয়া এলাকায় আয়োজন করেন বিজ্ঞান মেলা। পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় বিজ্ঞানীদের উপস্থিতিতে ভরে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। যা অন্য কোথাও মেলেনা। এই মেলায় যেমনি হাতে কলমে দূরবীন তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তেমনি দূরবীনে রাতের আকাশ চেনানো হয় আগ্রহীদের। এছাড়া এই 'সৃষ্টি' স্টুডেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে পাশে দাঁড়ায় এলাকার দরিদ্র বাচ্চাদের পাশে। এ সব কিছুই তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত।

২০১৮ তে প্রকাশিত হয় প্রথম বই 'সাপের দেশে'। ১৯৯৯ - ২০০০ থেকে সাপের প্রতি ভালোবাসা। 'ক্যানিং বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থা'র মাধ্যমেই এই ভালোবাসা। এই সংগঠনের বিজন ভট্টাচার্যের কাছে পেয়েছেন সাপ নিয়ে যাবতীয় আগ্রহ। সাপ নিয়ে পড়াশোনা করেন নিয়মিত। নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত সর্পবিদ তথা Herpetologist দের সাথে। তবে পরবর্তীতে সাপ নিয়ে অনেক কিছুই জেনেছেন এবং শিখেছেন বিখ্যাত সর্প বিশেষজ্ঞ ডাঃ দয়ালবন্ধু মজুমদারের সান্নিধ্য পেয়ে। আজ তিনি গোখরো, কালাজ, চন্দ্রবোড়া, শাঁখামুটিদের কামড় এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে সম্যক ধারনা তুলে ধরেন বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে। সাপ কামড়ালে তৎক্ষণাৎ কি করা উচিত, তা তিনি তুলে ধরেন জেলা জুড়ে নানা কর্মশালা, আলোচনা সভা, সেমিনার, বক্তব্যের মাধ্যমে। কখনও স্লাইড শো, কখনও ভিডিও শো'র মাধ্যমে সহজ সরল এবং প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেন সাপ কামড়ানোর প্রতিকার এবং উপায়। প্রতি বছর ৫০ - ৬০ টির বেশি শিবির করে জনসচেতনতার দাওয়াই দেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন হাসপাতালে সাপের কামড়ের চিকিৎসা হয়, তা তাঁর নখদর্পনে। তাই যেকোনও এলাকার সাপে কামড়ানো রোগীর সন্ধান পেলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন নিকটবর্তী সেই চিকিৎসা কেন্দ্রের সন্ধান, যেখানে সাপে কামড়ানোর চিকিৎসা হয়।

১৯৯০ থেকে নানা বিষয়ে স্লাইড শো করে চলেছেন। বিখ্যাত মানুষ অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়কে 'গুরুদেব' মানেন। মহাকাশের প্রতি অমোঘ ভালোবাসা থেকেই কলকাতার বিভিন্ন মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জমে ওঠে সম্পর্ক। তাঁর স্লাইড শো'তে নানা জনমুখী বিষয় যেমন Global Warming, Water Pollution ও প্রাধান্য পেয়েছে। 

বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ কুমার চক্রবর্তীকে পাশে পেয়েছেন। সন্দীপবাবুর সহযোগিতায় সীতাপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে 'মহাকাশ বিজ্ঞান কেন্দ্র'। সেখানে তিনি নিজেকে কর্মী বলেই ভাবেন। নিজে ভূগোল বিষয় পড়ালেও আদপে তিনি পরিবেশ বিজ্ঞান এবং ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। টানা ৩২ বছর ধরে অষ্টম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের পড়িয়ে চলেছেন বিনামূল্যে। তাঁর প্রশিক্ষণে মাধ্যমিকে ভূগোলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে একাধিক বার। আজ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে সাপ নিয়ে প্রচারের মুখ হয়ে উঠেছেন সুব্রত কুমার বুড়াই।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. সুব্রত দা, সুকণ্ঠের অধিকারী।এই গুণটির কথা লিপিবদ্ধ করা দরকার ।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ।। করে দেবো 👍

    ReplyDelete