জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৫৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৩

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ১৮৮৭ সালে হরিপ্রসন্ন পাটনা কলেজ থেকে স্নাতক হন। এরপর তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান পুনা কলেজ অব সায়েন্সে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে ভালোবাসার মানুষ। সেই সময় কলেজ অব সায়েন্স থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারীরা সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পেত হয় বম্বে সরকার কিংবা ভারত সরকারের অধীনে। হরিপ্রসন্নের এক সহপাঠী ছিল রাধিকাপ্রসাদ রায়। গরিব ও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। তাঁর চাকরি পাওয়াটা ছিল ভীষণ জরুরি। হরিপ্রসন্ন জানতেন তিনি নিশ্চিতভাবে পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অধিকার করবেন। সেই কারণে ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে রাধিকাপ্রসাদকে বলেন, “ভাই, তোমার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারলে নিশ্চিতভাবে সরকারি চাকরি পেয়ে যাবে। একথা বিবেচনা করে এই বছর আর পরীক্ষায় না বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” সত্যই তিনি পরীক্ষা দিলেন না! রাধিকাপ্রসাদ অবশ্য প্রথম বা দ্বিতীয় কোনও স্থানই অধিকার করতে পারেন নি। কিন্তু সারাজীবন হরিপ্রসন্নের মহত্ত্বের কথা স্মরণ করে গেছেন।
 কিছুটা সময় আগে, ১৮৮৫ সালে হরিপ্রসন্ন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে প্রথম ডিভিশনে ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপরই চলে আসেন বিহারের বাঁকিপুরে, সেখান থেকে পাটনা কলেজ অব সায়েন্সে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করার জন্য। পরবর্তী সময়ে হরিপ্রসন্ন বলতেন --“যেদিন মহাসমাধিতে লীন হলেন ঠাকুর ( ১৬ অগাস্ট, ১৮৮৬ ), সেদিন হঠাৎ দেখলুম আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, ঠাকুর এখানে কেমন করে এলেন! এভাবে দর্শন দানের কারণই বা কী?” পরদিন বসুমতী সংবাদপত্রে ঠাকুরের দেহত্যাগের সংবাদটি পাঠ করেন। স্বভাবতই দুঃখসাগরে নিমগ্ন হন। কিন্তু এই মনঃকষ্ট দূর হয় ঠাকুরের কথা স্মরণ করে। তিনি হরিপ্রসন্নকে একবার বলেছিলেন, “কেন তোদের এত ভালোবাসি জানিস? তোরা, ছোকরারা আমার প্রাণের জন। জগজ্জননী তোদের ভালোবাসতে বলেছেন।” হরিপ্রসন্ন আরও বলেছিলেন, “আমাদের ঠাকুর কত ভালোবাসতেন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এমনভাবে অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমাদের নেই। ঠাকুরকে দেখে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছি, আর এখন মানুষ তাঁর কথা শুনে অনুপ্রেরণা লাভ করছে, কত কৃপা পেলে এটা হয়!”
বাল্যাবস্থায় পিতৃহারা হওয়ার কারণে পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা গঠনের স্বার্থে হরিপ্রসন্নকে কর্ম স্বীকার করতে হয়। মায়ের দেখাশোনা ও অনুজ ভ্রাতার শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। এইভাবেই চলছিল। কিন্তু কিছু সময় অতিক্রমান্তে পিতৃব্য বিবাহের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। জাগতিক বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়ার কোনও অভিপ্রায় হরিপ্রসন্নর ছিল না। তিনি পিতৃব্যের এই উদ্যোগে বেশ বিরক্তবোধ করলেন। এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পেতে শেষমেশ ১৮৯৬ সালে আলমবাজার রামকৃষ্ণ মঠে যোগ দিলেন। সেখানে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন জপ-ধ্যানে। দীনতার সঙ্গে দিন যাপন করতেন। স্বল্পভাষী ছিলেন, কোনওরকম গল্পগুজব, আড্ডা বা ব্যঙ্গ রসিকতায় কালাতিপাত করতেন না।

 ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। হরিপ্রসন্নকে সঙ্গে করে নিয়ে তিনি পশ্চিম ও উত্তর ভারত পরিভ্রমণে যান। এই সময় রাজপুতানার প্রাচীন হিন্দু মন্দিরগুলি পরিদর্শন করেন তাঁরা। ভবিষ্যতে রামকৃষ্ণ মন্দিরের স্থাপত্য ঠিক কীরকম হবে সেই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন স্বামীজী। মন্দির নির্মাণ বিষয়ে নিজের ধারণাটি তাঁর কাছে পরিস্ফুট করেন। কলকাতায় মঠে ফিরে হরিপ্রসন্ন স্বামীজীর ভাবনা অনুসরণ করে রামকৃষ্ণ মন্দিরের একটি নকশা অঙ্কন করেন। এই বিষয়ে বিশিষ্ট স্থপতি মি. গিথারের সঙ্গে পরামর্শও করেন। নকশাটি দেখে স্বামীজী অত্যন্ত প্রীত হন এবং বলেন, “এই মন্দির নিশ্চিতভাবেই গড়ে উঠবে, কিন্তু আমি সম্ভবত তখন থাকব না ... উপর থেকে দেখব।”
 ১৮৯৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আলমবাজার থেকে মঠ স্থানান্তরিত হয় বেলুড়ে নীলাম্বর মুখার্জির বাগানবাড়িতে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় মঠের জন্য জমি ক্রয় করা হয় এই বছরেরই মার্চ মাসে। বেলুড় মঠের মূল গৃহের পুনর্নির্মাণ, নতুন নির্মাণ ও মন্দির নির্মাণের বিষয়ে স্বামীজী হরিপ্রসন্নের উপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর রামকৃষ্ণ মঠ উৎসর্গ করেন। ১৮৯৯ সালের ৯ মে হরিপ্রসন্ন আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “আমরা যেমনভাবে সন্ন্যাস নিয়েছি, তুইও সরাসরি ঠাকুরের কাছ থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ কর।” হরিপ্রসন্ন রামকৃষ্ণ মন্দিরে বিরজা হোম সম্পন্ন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, সন্ন্যাস নাম হয় স্বামী বিজ্ঞানানন্দ।
 স্বামীজীর মনে একদিন ইচ্ছা উঠল বেলুড় মঠ সংলগ্ন গঙ্গার ঘাট ও বাঁধ নির্মাণের। এটা করতে গেলে কত খরচ হতে পারে তার একটা আনুমানিক হিসাব করতে বললেন বিজ্ঞানানন্দজীকে। স্বামীজী আবার যাতে মত পরিবর্তন না করেন সেই আশায় খরচ একটু কমিয়েই বললেন বিজ্ঞানানন্দজী। জানালেন মোটামুটি তিন হাজার টাকা লাগবে। খরচের এই পরিমাণ শুনে আনন্দিত হলেন স্বামীজী। শীঘ্রই আলোচনা সেরে ফেললেন ব্রহ্মানন্দজীর সঙ্গে এবং আলোচনান্তে কাজটি শুরু করার নির্দেশ দিলেন। কাজ যত এগোতে থাকল, বিজ্ঞানানন্দজী বুঝতে পারলেন এই কাজ সমাপনে নিশ্চিতভাবে পূর্বকৃত আনুমানিক খরচের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। ব্রহ্মানন্দজীকে বিনয়ের সঙ্গে একথা জানালেন তিনি, কেননা ব্রহ্মানন্দজীই এই কাজ শুরুর নির্দেশ দেন। কনিষ্ঠ গুরুভ্রাতার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নিলেন ব্রহ্মানন্দজী, সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজীর কাছে তিরস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনাও মেনে নিলেন। কয়েকদিন পরে স্বামীজী কাজে কত খরচ হল সেকথা জানতে চাইলেন ব্রহ্মানন্দজীর কাছে। যখন জানতে পারলেন খরচের পরিমাণ মূল হিসাব অতিক্রম করে গিয়েছে ইতিমধ্যেই এবং কাজ অসমাপ্ত, ব্রহ্মানন্দজীর উপর ভয়ানক রেগে গেলেন। প্রবল তিরস্কার করলেন এবং সেই তিরস্কার শান্তভাবে গ্রহণ করলেন ব্রহ্মানন্দজী। স্বামীজী নিজের ঘরে ফিরে গেলে, ব্রহ্মানন্দজীও নিজের ঘরে গিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে স্বামীজী শান্ত হলে পরমপ্রিয় গুরুভ্রাতাকে ক্রোধজনিত তিরস্কারে প্রবল অনুতপ্ত হন। বিজ্ঞানানন্দজীকে ডেকে বলেন, “রাজা ( ব্রহ্মানন্দজীকে এই নামেই ডাকতেন ) এখন কী করছে দেখে আসতে পারবি?” বিজ্ঞানানন্দজী ব্রহ্মানন্দজীর ঘরের সামনে গিয়ে দেখেন দরজা-জানালা সব বন্ধ। ডেকেও সাড়া পেলেন না। একথা স্বামীজীকে এসে জানালে তিনি বললেন, “তুই একটা বোকা! আমি তোকে দেখে আসতে বললাম রাজা কী করছে তাই, আর তুই কিনা এসে বলছিস দরজা জানালা বন্ধ! আবার যা, দেখে এসে বল ও কী করছে।” এবার বিজ্ঞানানন্দজী দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখলেন ব্রহ্মানন্দজী বিছানায় শুয়ে কাঁদছেন!

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments