জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৫৬ / প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৬

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

বিজ্ঞানানন্দজী বেলুড় মঠকে অতীব পবিত্র স্থান বলে বিবেচনা করতেন। শ্রীশ্রীমা ও ঠাকুরের ষোলজন অন্তরঙ্গ সন্ন্যাসী পার্ষদদের পূতস্পর্শে ধন্য এই মঠ। একবার তিনি বলেন -- “মা অন্নপূর্ণা বেলুড় মঠে চির বিরাজমানা। এটি ভিক্ষু সন্ন্যাসীদের আবাসস্থল যাদের কাছে কোনও অর্থ সম্পদ নেই। কিন্তু মানুষ খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এখানে নিয়ে আসেন। মায়ের কৃপায় মঠের ভাণ্ডার সবসময়ই পরিপূর্ণ থাকে। বেলুড় মঠে অবস্থান করে কেউ যদি আন্তরিকভাবে জপ ও ধ্যানাভ্যাসের ভিতর দিয়ে সময় অতিবাহিত করে তবে নিশ্চিতভাবে সে অমূল্য আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।” ১৯৩৭ সালে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের তৃতীয় সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী অখণ্ডানন্দ দেহত্যাগ করেন, চতুর্থ সঙ্ঘগুরুর পদে আসীন হন বিজ্ঞানানন্দজী মহারাজ।
 স্বামী বিবেকানন্দের একান্ত বাসনা ছিল বেলুড় মঠে মন্দির নির্মাণান্তে সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন। সেই মন্দির হবে স্থাপত্য ও ভাবে অনন্য, যা যুগ যুগ ধরে মানবমনে বিস্ময় ও অনুপ্রেরণার উদ্রেক করবে। স্বামীজী প্রকল্পিত এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন দ্বিতীয় সঙ্ঘগুরু স্বামী শিবানন্দজী, ১৯২৯ সালের ১৩ মার্চ তারিখে। এরপর নতুন করে মন্দির নির্মাণস্থল নির্বাচিত হয় ১৯৩৫ সালে জুলাই মাসে। বিজ্ঞানানন্দজী ইতিমধ্যে স্থাপিত ভিত্তিপ্রস্তরটি পুনরায় স্থাপিত করেন ১০০ ফুট দক্ষিণে। মন্দিরের মূল অংশটি গঠন করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল, নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করতে আরও এক বছর। ১৯৩৮ সালের শুরুর দিকে বিশিষ্ট মনস্তত্ত্ববিদ ডা. কার্ল জি জং বেলুড় মঠে আসেন। বিজ্ঞানানন্দজীকে প্রশ্ন করেন, “স্বামী বিবেকানন্দই কি এই রামকৃষ্ণ মন্দির নির্মাণে ধারণা দিয়েছিলেন?” উত্তরে বিজ্ঞানানন্দজী জানান, “তাঁর ভাব অনুযায়ীই আমি প্রথম প্ল্যানটি তৈরি করি, কিন্তু সেটি স্বামীজীর পছন্দ হয় নি। আবার নতুন করে বেশ কয়েকবার করার পর অবশেষে স্বামীজীর অনুমোদন মেলে।”
 বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যের মিশ্রণের নিদর্শন। মন্দিরটি ২৩৫ ফুট লম্বা, ১৪০ ফুট চওড়া। চূড়ার উচ্চতা ১০৮ ফুট। মন্দিরে একটি মার্বেলের বেদির উপর ইতালীয় মার্বেল নির্মিত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মূর্তি স্থাপিত। সমাধিস্থ অবস্থায় উপবিষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরিচিত ভঙ্গিমার অনুকরণে নির্মিত এই মূর্তি। মন্দির নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৮ লক্ষ টাকা। যার মধ্যে সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা দান করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনস্থিত রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্বামী অখিলানন্দজীর দুই আমেরিকান শিষ্যা -- মিস হেলেন রুবেল এবং মিসেস অ্যানা উরসেস্টার।
 ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি রামকৃষ্ণ মন্দির উৎসর্গ অনুষ্ঠানে এলাহাবাদ থেকে বেলুড় মঠে এসে উপস্থিত হন স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী। ১৪ জানুয়ারি ভোরে নতুন গেরুয়া বসন পরিধান করে  চেয়ারে উপবিষ্ট হয়ে সেই পবিত্র মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই সময় সেবককে বলেন, “নতুন মন্দিরে ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠা করবার সময় স্বামীজীকে বলব, আপনার উৎসর্গীকৃত ঈশ্বর আপনার পরিকল্পনায় নির্মিত মন্দিরেই আজ স্থাপিত হলেন। আপনি বলেছিলেন, উপর থেকে দেখব। দয়া করে দেখুন ঠাকুর নতুন মন্দিরে কেমন উপবিষ্ট হয়ে আছেন।”

 এই সময়ে বিজ্ঞানানন্দজীর শরীর খুব ভালো ছিল না। সেই কারণে মঠ বাড়ি থেকে মন্দিরে পৌঁছতে তাঁর জন্য একটি গাড়ির বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এক সন্ন্যাসী পুরনো মন্দির থেকে ঠাকুরের সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্নসমূহ এনে গাড়িতে অপেক্ষারত বিজ্ঞানানন্দজীর হাতে অর্পণ করেন। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বণিসহ ধূপের সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে। শোভাযাত্রার পুরোভাগে একদল গায়ক উচ্চকণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশন করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকেন -- ‘এসেছে এক নতুন মানুষ দেখবি যদি আয় চলে’। সকাল সাড়ে ছ'টায় নতুন মন্দিরে এসে পৌঁছায় শোভাযাত্রা। মন্দিরের অন্তর্দেশে প্রবেশ করে ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্নগুলি বেদিতে স্থাপন করেন বিজ্ঞানানন্দজী। পুষ্প নিবেদন করেন। পূজান্তে ফিরে আসেন নিজ ঘরে।
 প্রাতরাশের পর সেবক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, নতুন মন্দিরে ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠার সময় স্বামীজীকে তিনি কিছু বলেছিলেন কিনা। উত্তরে বিজ্ঞানানন্দজী বলেন, “হ্যাঁ, আমি স্বামীজীকে বললাম, আপনি বলেছিলেন যে উপর থেকে দেখবেন -- এখন অনুগ্রহ করে দেখুন ঠাকুর কেমন নতুন মন্দিরে বসেছেন। তারপর স্পষ্ট দেখলাম স্বামীজী, রাখাল মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, শরৎ মহারাজ, হরি মহারাজ, গঙ্গাধর মহারাজকে। অন্যান্যরা দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে দাঁড়িয়ে এই উৎসর্গ অনুষ্ঠান অবলোকন করছিলেন।” এই কথা বলার কিছুক্ষণ পরে বললেন, “এখন আমার কাজ শেষ। স্বামীজী আমার উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন তা সম্পন্ন করে আজ আমি মুক্ত বোধ করছি।”
 কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে ইহজগতে তাঁর কার্য সমাপনের জন্য আগমন করেন। তাঁরা কতদিনের জন্য এই কার্য করবেন তা ঈশ্বরই নির্দিষ্ট করে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বিজ্ঞানানন্দজীকে বলেছিলেন, “তুই মায়ের লোক। তোকে অনেক মায়ের কাজ করতে হবে।” বলা বাহুল্য মা বলতে জগজ্জননীর কথাই বুঝিয়েছিলেন তিনি। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ গুরুর এই আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। বহু মানুষকে তাঁর পবিত্র, ত্যাগপূর্ণ উচ্চ আধ্যাত্মিক জীবনধারার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের উৎসর্গ কার্য সমাপনের পর ইহজগত পরিত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেন। 
 ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি এলাহাবাদে ফিরে যান বিজ্ঞানানন্দজী। আবার ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলুড় মঠে ফিরে আসেন ঠাকুরের জন্মতিথি উৎসবে যোগদান করতে। মঠে এসে সন্ন্যসীদের বলেন, “দয়া করে অন্য কাউকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঠিক কর। আমার ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে পুনরায় আসতে পারব বলে মনে হয় না।” তাঁর পা ফুলতে শুরু করে, এক চিকিৎসক একে সংক্রামক শোথরোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেবক তাঁকে ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে জোর করলে তিনি বলেন, “ডাক্তারদের উপর আমার কোনও বিশ্বাস নেই।” ঠাকু‌রের প্রতি নির্ভরতাই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। বলতেন, ঠাকুরের চেয়ে বড় ডাক্তার কেউ নেই। আমি তাঁরই চিকিৎসাধীন। এইবারটাই ছিল তাঁর শেষবারের জন্য বেলুড় মঠে আসা। ১৯৩৮ সালের ৮ মার্চ এলাহাবাদে ফিরে আসেন। এই বছরেই ২৫ এপ্রিল মহাসমাধিলাভ করেন। যাত্রা করেন শ্রীরামকৃষ্ণলোকে। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইংরেজি মুখপত্র ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ এই বিষয়ে মে, ১৯৩৮ সংখ্যায় লেখে -- It is with deep sorrow that we have to announce the passing away of Srimat Swami Vijnanandaji maharaj, the President of the Ramakrishna Math and Mission, on Monday, the 25th April, at 3-20 p.m.at Ramakrishna Math at Muthiganj, Allahabad.
 ...The swami became President of the Ramakrishna Math and Mission in April, 1937, when most of the direct disciples of Sri Ramakrishna had passed away. He was therefore the source of spiritual peace and joy to the members of the Ramakrishna Order and thousands of devotees and visitors from far and near, from India and abroad. His exit from mortal scene has, therefore, left a void which can never be filled. May his pure life, burning renunciation and towering spirituality inspire us all in our efforts at God-realization!
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments