জ্বলদর্চি

সরস্বতীর সঙ্গে কিছুক্ষণ / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

সরস্বতীর সঙ্গে কিছুক্ষণ 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

এই বয়সে এসে আবার কলেজ জীবনের সেই সরস্বতী পুজোর কথা মনে পড়ছে। কলেজের এক সহপাঠিনীর সঙ্গে সবেমাত্র প্রেম শুরু হয়েছে। কোনোপ্রকার বাড়িয়ে বলা হবে না, যদি বলি মেয়েটি প্রকৃত সুন্দরী। সেদিন সে কলেজ- পুজোয় এসেছিল লাল পাড় সাদা শাড়িতে। অবিকল দেবী সরস্বতীর মতো লাগছিল। কিন্তু এ তো প্রকৃত দেবী সরস্বতী নয়, বস্তুত রক্ত মাংস হাড় দিয়ে তৈরি একটা জীবন্ত কাঠামো। যদি আমি আমার প্রেমিকাকে দেবী সরস্বতীর প্রতিবিম্ব বলে ভাবি, তবে এটি বাস্তব আবার অবাস্তবও বটে। যখন আমি আমার প্রেমিকাকে দেখছি, তখন মনে হচ্ছে এ আমি কাকে দেখছি? আবার দৃষ্টি যখন তার থেকে দেবী সরস্বতীর দিকে গেল, তখন প্রতিমাকে বাস্তব মনে হলো, আবার অবাস্তবও মনে হবে। কারণ আমার দৃষ্টি যেখান থেকে গেছে, সে তো আসলে দেবী সরস্বতী নয়। এখানে আমার প্রেমিকা হচ্ছে ইউটোপিয়া। যেমন দর্পণ হলো এক স্থানহীন স্থান। দর্পনে আমি আমাকে যেখানে দেখি, সেখানে আমি নেই। আমি যার মধ্যে ঠাকুর সরস্বতী দেখছি, সেখানে আদপে তিনি নেই। এই ছায়া-রূপের মাধ্যমে আমি দেবীকে দেখতে সমর্থ হচ্ছি এমনভাবে, যেখানে দেবী অনুপস্থিত। আমার প্রেমিকা হলো দেবী সরস্বতীর কল্পক্ষেত্র। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
অনেক সময় আমরা ছাদে বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ করি, বিভিন্ন পরিবেশ থেকে ফুলের চারা তুলে এনে। কিন্তু আমরা তা করি কেন? শুধু আমাদের মনের সাধ মেটানোর জন্য। অনেকেই আবার শখের জন্যও করে। এই ছাদের ফুল চাষ বি-কল্পক্ষেত্র। তেমনি যদি আমরা ধরে নিই দেবী সরস্বতী স্বর্গে থাকেন, আমরা এই পূজার দিন তার প্রতিমা গড়ে প্যান্ডেলে বসাই। এই পূজাও একটি বি-কল্পক্ষেত্র। 

এখন সবাই সরস্বতী দেবীর 'ছবি আলা' মুখ চায়। যেন ছবির মতো সুন্দর দেখতে হয়। প্যান্ডেলের জাঁকজমকে এমনভাবে এই সরস্বতী পূজার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, কত বেশি সংখ্যক মানুষকে এখানে আকর্ষণ করা যায়। এই পূজাতে ঘিরে থাকে আমোদ প্রমোদ বিভিন্ন ফুর্তিফার্তা। আমার বাড়ির কাছে এমন একটি পুজো হয়, যাতে শব্দদূষণ এবং তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য পুজোর ক'দিন বাড়িতে থাকা দায় হয়। আজকালকার সরস্বতী পূজা-অর্চনার জন্য নির্মিত হয়নি, নির্মিত হয়েছে দেখা এবং দেখানোর জন্য। এই পুজোতে শব্দ রঙ আতসবাজি আরও অনেক কিছু দিয়ে পুজোকে উপভোগের বস্তু করা হয়। যেমন প্রেমিকাকে দেখে পূজার সব ইচ্ছাই আমার চলে গিয়েছিল। শুধু ছিল প্রেমিকাকে দেখার এক উদ্দীপনা । 

কোন স্কুল কত বড়ো, কোন ক্লাব কত দরের, কোন পরিবার কতখানি স্বচ্ছল, সেটা এই পুজোর মাধ্যমে দেখিয়ে দেওয়া হয়। যেমন দুর্গাপূজার সময় কলকাতার তিনটি বিখ্যাত পূজার কথা প্রচলিত ছিল- জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়িতে মা এসে গয়না পরেন,  ভোজন করেন কুমারটুলির অভয়চাঁদ মিত্রের বাড়িতে, আর রাত জেগে নাচ দেখেন শোভাবাজারের রাজবাড়িতে। এইসব কাহিনী প্রচলিত থাকার জন্য, ঐসব পুজোতে ভক্তদের ঢল নামতো। এখন এইসব কাহিনীর জৌলুষ কমে গেছে বলে, ভিড় জমাতে পুজোতে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। বি-কল্পক্ষেত্রের ভূমিকা হল অন্য, অপর, পরিসর বা স্থান সৃষ্টি করা, যা হবে সেই রকম নিখুঁত সুবিন্যস্ত নিটোল, যেরকম আমাদের জীবনটা বিশৃঙ্খল ও অসংগঠিত তালগোল পাকানো। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণের বি-কল্পক্ষেত্র। 
এই যে আমরা কথায় কথায় বলি আমাদের দেশ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। এটা নিয়ে আমাদের একটা গর্ব আছে। গণতন্ত্র মানে আমার অথবা আমার গুষ্টির ভালোর জন্য লড়াই নয়। এই দেশে যত চোর ডাকাত পাজি বজ্জাত ভদ্রলোক আছে, তাদের সকলকে সমান বলে মানতে শেখাই গণতন্ত্র। কিন্তু আমাদের যে বৃহৎ অংশের জনগণ, তাদের মধ্যে শিক্ষার শ-টুকু নেই। তাই দেশে শাসকের অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, কিন্তু ভোটের সময় দেখা যায় যেই কে সেই।  শাসক সেই আগেকার রয়ে গেছে। শুধু খুন জখম ছাড়া নিয়মানুবর্তি নির্বাচন পরিচালনা হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। সেই জন্য আন্দোলন করে কোন কিছু হয় না। আন্দোলন যখন থিতিয়ে যাবে সেই আগের অবস্থা। নইলে এত বিপ্লব মাঠে মারা যায়। বিপ্লবকে বাঁচাতে হলে জনগণের মানসিকতার বদল চাই। জনগণের এই মানসিকতার বদলা আনতে পারে শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষা কোনোদিন কি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব ছাড়া পাওয়া যেতে পারে? প্রকৃত শিক্ষা বলতে ভদ্রলোকের শিক্ষা। শুধু পয়সা উপার্জন করার জন্য শিক্ষা নয়। শুধু বই টাকা পোশাক দিয়ে কিছু হবে না, চাই সৎ মানসিকতা। দেশের গরিব শ্রেণীর বা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছাত্র, যারা বড় হয়ে দেশের সম্ভাব্য ভোটার হবে, সংখ্যায় বেশি, তাদের কথা ভেবে কি সিলেবাস  তৈরি হয়। শিক্ষার জন্য যত টাকা বরাদ্দ হয়, তার সব টাকা কি নিচতলা পর্যন্ত পৌঁছায়? দীর্ঘ উপবাসে থাকা মানুষ, ভাত চিনতে ভুল করে। হৃষ্টপুষ্ট নেতার আমলারা কেন ভুল করে না টাকা চিনতে- যাদের জন্য মাঝ রাস্তায় টাকা থেকে যায়। তাই রাজনীতির আদর্শ তার পদ্ধতি প্রক্রিয়া ঠিক না হলে, গরিবদের শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রকল্প করে লাভ নেই। অশিক্ষিত গরীবের ছেলেরা  অশিক্ষিতই থেকে যায়, কারণ আমাদের বিধি ব্যবস্থাই খারাপ। স্কুলবাড়ি বানানো হচ্ছে কিন্তু শিক্ষাপ্রণালীর পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। শিক্ষা চুরি হচ্ছে শিক্ষকের চাকরি চুরি হচ্ছে। শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকমত পড়া বোঝাতে পারছেন না। ছাত্র-ছাত্রী কতটা বুঝলো তা নিয়ে শিক্ষকের কোনো মাথাব্যথাও নেই। বিদ্যালয়গুলোতে গোটা পড়াশোনাটাই সিলেবাস-মুখী। ছাত্রমুখী নয়। স্কুলগুলোতে শিক্ষক যা পড়ান তাই ছাত্র-ছাত্রীদের শিখতে হয়। বাড়ির লোকেরাও বলে- শিক্ষক মশাই যা বলবেন যা পড়াবেন তাই পড়বি। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্যতার পরীক্ষা নেওয়া হয়। দক্ষতার পরীক্ষা হয় না। বর্তমানে পয়সার বিনিময়ে অযোগ্যদের শিক্ষকতার চাকরি দেওয়া হয়েছে। যারা দু সংখ্যার যোগ বিয়োগ করতে জানে না। ইংরেজিতে নিজের নামটাও হয়তো লিখতে পারে না। আরও অনেক অসাম্য শিক্ষার ভেতরে রয়েছে। আর শাসকরা এটা ইচ্ছা করেই করে। আমাদের দেশের গরীবরা ভোটারের সিংহভাগ-ই তারা, তারা যদি সত্যিকারের শিক্ষা পায় - তাহলে গণতন্ত্র উন্নত হবে। যা লুম্পেন সরকারের কাছে ভয়ের কারণ। তাইতো তাদের পড়াশোনার মানে অবনতি ঘটিয়ে, অযোগ্যদের শিক্ষকের চাকরি দিয়ে, ছাত্র-ছাত্রীদের দেওয়া হচ্ছে ফুটবল পোশাক জুতা সাইকেল রূপশ্রী কন্যাশ্রী আরো কত কিছু। আর বড় হলে ১০০ দিনের কাজ। 
সত্যিকারের পড়াশোনা বঞ্চিত হয়ে, মানুষ আজ সরস্বতী মুখী। এই সরস্বতী পূজা কে তাদের ক্ষতিপূরণের বি-কল্পক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। মানুষজন যদি সত্যিকারের শিক্ষা পেতো তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরস্বতী পুজো করতো না। 
দেবতাদের পিতামহ ব্রহ্মা, মেয়ে সরস্বতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে- মেয়ের সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করেছিল। আমি দেবতা নয় মানুষ - আমার দেখতে সুন্দরী প্রেমিকাকে জীবন্ত সরস্বতী ভেবে, পার্কে তার সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা বিনিময় করে - সময় কাটিয়েছিলাম।

Post a Comment

1 Comments

  1. যাঁরা পড়ছেন, আশা করি তাঁরা এই লেখার যাথার্থ্য বুঝবেন। শিক্ষার একটি প্রয়োজন অবশ্যই অর্থ উপার্জন। কিন্তু, সেটাই সব নয়। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ভাল মন্দের বোধ ও তার সাহসী ব্যবহার। তাহলেই বিপ্লব ব্যর্থ হবে না বা স্বার্থের বেনোজল ঢুকে তাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে না। শিক্ষা ও সরস্বতী মায়ের প্রতিদিনের প্রকৃত বাসস্থান আমাদের হৃদয়ে, চিত্ত বৃত্তিতে, কর্মে, প্যান্ডেলে নয়।




    ReplyDelete