জ্বলদর্চি

ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা (বিজ্ঞানী, সাউরী, পশ্চিম মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩৮

ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা (বিজ্ঞানী, সাউরী, পশ্চিম মেদিনীপুর)

ভাস্করব্রত পতি 

Classical Mechanics' এর ওপর তাঁর এম.এসসি.-র পাঠ্যবই আজও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিদেশের অক্সফোর্ড, হাভার্ড-এও পড়ানাে হয়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করেছেন - 'Observer's Planner'। ১৯৯৫ এ প্রকাশিত হয় 'Challenge to Aestronomy' বইটি। এ বছরই তিনি লেখেন 'Myth and Legends Related to Eclipse' নামে আর একটি বই। এছাড়া তাঁর লেখা 'Night Fall on a Sunny Morning' এবং 'Our Solar System'-ও বেশ আলােড়ন ফেলেছিল। 

নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না -- কার কথা বলছি! এক ক্ষনজন্মা মানুষ রতন, যাঁকে মেদিনীপুর তথা ভারতের মানুষ পেয়েছিল মাত্র ৪১ বছরের জন্য। ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন-২নং ব্লকের সাউরি গ্রামে ১৯৫৪ সালের ১২ই অক্টোবর জন্ম। 

এই বিরল প্রতিভার বিজ্ঞানীকে আমরা বেশিদিন পাইনি। ১৯৯৬ এর ২২ আগষ্ট তাঁর মৃত্যু হয়। খুব ছােটোবেলা থেকেই হৃৎপিণ্ডের অসুবিধা ছিল। ফলে প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বাড়িতে আর্থিক অবস্থা ভালাে ছিলনা। তাই সুষ্ঠু এবং সঠিক চিকিৎসা করানাে যায়নি। শারীরিক এই অসুবিধার কারণে তিনি বিবাহ করেননি। প্রবলভাবে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকে স্মরণ করতেন। সেখানে পেতেন বেঁচে থাকার শক্তি এবং প্রেরণা। নিজের পিএইচ.ডি.র থিসিস পেপারটি তিনি উৎসর্গ করেন রামকৃষ্ণদেবের চরণে। 

অখ্যাত এই সাউরি গ্রাম থেকে নারায়ণচন্দ্র রানা হয়েছিলেন একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে তাঁর উঠে আসা এই মানুষটি। সাউরি ভােলানাথ বিদ্যামন্দিরে তাঁর পড়াশুনা। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। সে সময় যা ছিল অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। কিন্তু তিনি তা পেয়েছিলেন। বাবা ছিলেন রাজেন্দ্র রানা ছিলেন লৌহশিল্পী এবং মা নাকফুঁড়ি রানা সাধারণ গৃহবধু। একজন দিনদরিদ্র কর্মকার পরিবারের সন্তান হয়েও নিজের অভূতপূর্ব মেধা ও মনন প্রক্রিয়ার সহায়তায় বিদ্বজনের নজর কেড়ে নিতে পেরেছিলেন।
নারায়ণই তাঁদের পরিবারের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে উচ্চশিক্ষার দুয়ার ডিঙিয়ে ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাশ করেন। স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় স্থান পান। এরপর ১৯৭৭ সালে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ’তে পিএইচ.ডি, শুরু করেন পদার্থ বিজ্ঞানে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার ছিলেন তাঁর গবেষণার গাইড। এই জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকারের সান্নিধ্যে থেকেই তিনি তাঁর গবেষণার প্রশস্ত দিক উন্মোচন করেছিলেন।

কিভাবে নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছিল, তার অভ্যন্তরে কি রয়েছে, এবং কিভাবে নক্ষত্ররা মহাবিশ্বে বিরাজমান – এসবই তাঁর গবেষণার বিষয়। Cosmic Microwave Radiation। ১৯৮৩ সালে তাঁর এই গবেষণাপত্রটিই বর্ষসেরার স্বীকৃতি পায়। এরপর তিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পােষ্ট ডক্টোরাল করেন। 

অবশ্য তাঁকে আকাশ সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করেন মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী। ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি'র পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাঁকে। TIFR মুম্বাই থেকে শ্রেষ্ঠ গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া হয় 'গীতা উদগাঁওকার পদক'। পুনেতে ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মান মেলে। ১৯৯৫ এর ২৪ শে অক্টোবর এক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহনের দিন তিনি সারা ভারত থেকে বাছাই করা ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে রাজস্থানের দিল্লি জয়পুর হাইওয়েতে সূর্যের ব্যাস পরিমাপ করতে নেমেছিলেন। সেখানে প্রায় আট কিলোমিটার জুড়ে ৬৬০০০ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সূর্যের ব্যাস নির্নয় করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। 
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আমরা বেশিদিন পাইনি এই বিজ্ঞানীকে। অথচ মৃত্যুর কিছুদিন আগেই ১৯৯৬ এর ১৭ ই জুন থেকে ২৩ শে জুলাই তিনি ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, পােল্যাণ্ড সহ ইউরােপের ৭ টি দেশে ঘুরে ঘুরে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন মহাকাশ বিষয়ে। অতলান্ত মহাকাশের অসীম রহস্য ভেদ করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। সারা জীবনে ৭০ টির বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন। দুবার জাতীয় সম্মান পান। 'Evolution of Galaxy and Earth' বিষয়ে গবেষণার জন্য ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল Wealth Bursnay Award এবং SERC ফেলোশিপ। Indian National Science Academy তাঁকে দিয়েছে Best Young Scientist Award। এছাড়া The National Council for Science Academy and Technology Communication এর পক্ষ থেকে পেয়েছেন মরণােত্তর সম্মান। 

বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানাকে নিয়ে দীপক কুমার দাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নারায়নচন্দ্র রানা' (২০১৭)। 'মনীন্দ্র নারায়ন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট' এই বইটির প্রকাশক। এই  সংকলনে রয়েছে বিজ্ঞানীর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা এবং তাঁকে নিয়ে নানা ব্যক্তির স্মরণ ও মূল্যায়ন। ২০১৬ সালে 'ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি'র নিজস্ব 'ইণ্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স' ম্যাগাজিনের ৫১ তম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় লেখা হয়েছে নারায়ণচন্দ্র রানাকে নিয়ে। এখানে উৎপল মুখোপাধ্যায় ও শৈবাল রায়ের লেখা গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ 'এন সি রানা : লাইফ অ্যাণ্ড হিজ কন্ট্রিবিউশনস ইন অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল সায়েন্স' ছিল বিজ্ঞানীর প্রতি এক অনন্য মূল্যায়ন। এই ২০১৬ সালেই স্বপ্নময় চক্রবর্তী লিখেছেন উপন্যাস 'পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ'। মুলতঃ নারায়ণচন্দ্র নারায়ণ রানার জীবনের কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাসের প্রকাশক 'মিত্র ও ঘোষ'। এতে আছে এক প্রান্তিক গ্রামের সাধারণ পরিবারের ছেলের মহাকাশবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার আশ্চর্য কাহিনি। 

আজ তাঁর স্মৃতিতে সাউরি গ্রামে স্থাপিত হয়েছে নারায়ণ স্মৃতি মন্দির। সেখানে তাঁরই দেওয়া দুটি দূরবীণ যন্ত্র (একটি ৬ ইঞ্চি ব্যাস, অন্যটি ১০ ইঞ্চি ব্যাস) রয়েছে। সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের প্রয়াত স্যারের জন্য বিদেশ থেকে এনেছিলেন এই ১০ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপটি। ১৯৯১ তে তিনি গড়ে তুলেছিলেন 'এম এন লাহিড়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'। মেদিনীপুর কলেজে রয়েছে 'এন সি রানা স্কাই অবজর্ভেশন সেন্টার'। যা এখনও মেদিনীপুরের এই প্রয়াত বিজ্ঞানীর স্মৃতি বহন করে চলেছে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীনই প্রকাশিত করেছিলেন 'কিশোর' নামে একটি দেওয়াল পত্রিকা। সেই মানুষটিই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য মানুষ রতন।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

0 Comments