জ্বলদর্চি

এক ডিভোর্সি মেয়ের কথা /সঞ্জীব ভট্টাচার্য

এক ডিভোর্সি মেয়ের কথা
 
সঞ্জীব ভট্টাচার্য 



'মি, মি মি,ও মিলি,ও মুখপুড়ি',মা ডাকলো ।মেয়ে উত্তর দিলো, সুর করে ডাকতে পারো না?ক্লাস ইলেভেনে পড়া মেয়েকে  শিক্ষিকা মা সস্নেহে ধমকে উঠলেন, আমার  দ্বারা এর বেশি হবে না,কখন যে কী হয়, এখন আবার  বঙ্কিম ভর করেছে।মেয়ে দৌড়ে এসে মায়ের  গলা জড়িয়ে ধরল।
      
       মেয়েটা কে বুঝতে পারছো? আমি। আমি মানে শর্মিলী মিত্র। মাঝে মিত্র রায়,এখন আবার শুধুই  মিত্র। ওরফে মিলি মিত্র। কেন এই ওলট পালট? সেটা জানাবো বলেই তো তোমাদের  মুখোমুখি হওয়া।

      বাবা প্রায় বলত ,আমার মেয়েটা একেবারে অন্য ধরনের। বাবার কথার মানে আমি এখনো বুঝতে পারি নি।যা ঘটল আমার  জীবনে বা যা ঘটালাম, সেটার জন্যই কী! কে জানে?বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত উত্তরটা পেতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয়জন, সবচেয়ে বড় আশ্রয় বাবাকে যখন হারালাম তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।সেই সময় থেকেই আমার সঙ্গী বলতে মা,পড়াশোনা আর চোখের জল।না বাবা বেশি বলব না,তোমরা আবার সহানুভূতির ঝুড়ি খুলে বসবে।তার চাইতে আসল কথায় আসি।
          যত দিন যাচ্ছিল বেশ টের পাচ্ছিলাম আমি একটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগের উপাদান হয়ে উঠছি।আমার সৌন্দর্য সম্পর্কে ছেলে বন্ধুদের সুললিত বাণী - 'শালা কোনো কথাই হবে না'।বাইরে বেরোলেই মাপজোক। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হত।পরে অভ্যেস হয়ে গেল। 
    ফিজিক্সে মাস্টার্স করলাম। ভাল কলেজে পড়ানোর চাকরিও পেয়ে গেলাম। কিন্তু মায়ের চোখে একটা মেয়ের  জীবনে এগুলোই সব নয়।সুতরাং সুপাত্রের  সঙ্গে বিয়ে। দেখতে শুনতে বেশ ভাল। ইঞ্জিনিয়ার। বড় কোম্পানির বড় পদ।কোথাও ফাঁক নেই। 
        
              কিন্তু ফাঁক যে কোথায় ক্রমশ  সেটা বুঝতে পারছিলাম। সময় ছাড়া আমি সবই পাচ্ছিলাম যেগুলোর আমার কাছে কোনো তাৎপর্যই ছিল না।।ওর কাছ থেকে পাওয়া সন্তানকে শুধু আনন্দের সঙ্গে আঁকড়ে ধরতে পেরেছিলাম। সত্যি বলতে কি,বাবার পরে আমার বড় আশ্রয় আমার একমাত্র সম্বল এই আমার ছেলে।তাই কী?সেটাই তো বুঝতে পারছি না।আর সেইজন্যই তো তোমাদের মুখোমুখি বসা।
      দেখতে দেখতে বিয়ের বয়স চার পেরিয়ে পাঁচএ  পড়ল। স্বামীর আচরণের জন্য তাকে যে খুব দায়ী মনে হচ্ছিল, তা না।চরম উচ্চাকাঙ্খী মানুষের কাছ থেকে কতটাই বা আশা করা যায়।
       
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
  
        মনকে  ঠিকঠাক যখন  বুঝিয়ে নিচ্ছিলাম ঠিক সে সময়েই.........।এক শনিবার টাকা তুলতে গিয়ে দেখি একাউন্ট লকড।টাকার খুব দরকার ছিল। ক্যাম্পাসের  মধ্যেই ব্যাঙ্ক ।  সোমবার হতে না হতে ঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে  পড়লাম ম্যানেজারের ঘরে।কী যে বলতে  বাকি রেখেছিলাম সেদিন কে জানে। 

        'সরি ম্যাডাম, কিন্তু বারবার জানানো সত্ত্বেও আপনার কেওয়াইসি সাবমিট হয় নি'।বলার ঢং এবং আকর্ষণীয় স্বর।এতক্ষণে ভালোভাবে ম্যানেজারকে দেখলাম। নতুন পোস্টিং। সৌম্যদর্শন ।এরকম মানুষের সঙ্গে ভাব হতে বেশি সময় লাগে না।কিন্তু সেদিনের সেই  সূচনা কখন যে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে যাচ্ছিল বুঝতেই পারি নি।কমন ক্যান্টিনে একবার না দেখা হলে মনে হত দিনটাই বৃথা।
 
          একদিন জোর করেই তার বাসাতে গেলাম। ব্যাচেলর ড্রেন বলতে যা বোঝায় তাই।তায় আবার চল্লিশোর্ধ ব্যাচেলর। লোকটার উপর সেই মুহূর্তে আমার রাগ হচ্ছিল। চোখে মুখে একরাশ ভালোবাসা,অথচ বাইরে যা ঘরেও তাই।আমার শরীরের দিকে কোন নজরই নেই।সেই রাগ নিয়ে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এক উদাসীন পুরুষ কখন যে শিল্পী হয়ে উঠল। হাত তখন যেন তুলি।তার এক একটা টানে নতুন করে জেগে উঠছিল আমার শরীরের প্রতিটি অংশ। আমার এপার ওপার জুড়ে এক অদম্য ঢেউ।আমার অদেয় কিছুই থাকল না।
'আসছি',- বলে কোনোক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে এসে  বাঁচলাম।

                ঘরে ফিরে নিজেকে যতটা স্বাভাবিক রাখা যায় তারই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অবশ্য অস্বাভাবিক থাকলেও কিছু যেত আসতো না। পতি দেবতার আমার দিকে নজর দেওয়ার ঈচ্ছে  বা সময় কোনোটাই ছিল না।কিন্তু নিজেকেই আয়নার কাছে নিয়ে যেতে পারছিলাম না।ছেলের দিকে তাকালেই কান্না আসছিল।
       
              পরের দিন যথারীতি কলেজ গেলাম। যদিও কলেজ সেদিন মুখ্য ছিল ন।যে মুখ্য ছিল  দ্রুত তার রুমে পৌঁছালাম। আমাকে দেখামাত্র তার চোখমুখ আনন্দে চক চক করে উঠল। ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করে বলে উঠলাম, 'কালকের ঐ ঘটনার পর  আমার শরীর মন প্রতি মুহূর্তে রি রি করছে'
কথাটা শুনেই মানুষটার মুখ টা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দ্রুত ফিরে এসে আমি কলেজে কয়েক দিন ছুটির  জন্য আবেদন করলাম। মঞ্জুর হয়ে গেল। 
        
              ছুটি শেষে আবার কাজে যোগ দিলাম। ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটাই স্থির করতে পেরেছি।মানুষটার সঙ্গে দূরত্ব তৈরী করতে হবে।ওদিকটা যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে।অন্য সময় ক্যান্টিনে যাওয়া শুরু করলাম। হঠাৎই  সেখানে পরিচিত একজন  ব্যাঙ্কের স্টাফের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কথায় কথায় তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম ম্যানেজার নাকি  হঠাৎই চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে।


               সেই রাতেই আমি চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ডিভোর্স। কিন্তু ব্যাপারটা কী অত সহজ হবে? রাতে মনের জোর এনে বললাম। আশ্চর্য মায়ের কথায় আমার ইহকাল  পরকাল জানালো যে তার কোন আপত্তি নেই ।তবে কোম্পানি তাকে দু এক মাসের মধ্যে আমেরিকাতে পোস্টিং করছে সেই অব্দি অপেক্ষা করতে হবে।কেন না মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে।এও জানালো, সে কোনোরকম সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারবে না।শুধু স্বার্থপর নয়,নির্বোধও বটে।

                      এখন, আজ থেকে আমি মিলি মিত্র। সম্পূর্ণ স্বাধীন ।আমি আর আমার সন্তান, আর আমার......,না এ থাক একান্ত ব্যক্তিগত। 

            সব শুনলে তো ?এবার তোমরা কাটা ছেঁড়া করতে থাকো।ও আর একটা কথা গোপনে তোমাদের বলে রাখি, ম্যানেজারকে আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম। সেদিন আমার শরীর মন রি রি করে নি।আদৌ করে নি।

Post a Comment

1 Comments