জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো/পর্ব ৯ /সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো
পর্ব ৯
সুকন্যা সাহা
 
সন্ধ্যারতি

"দিনের  শেষে  ঘুমের  দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়ায়..."
আজ চলে গেলেন আরতি মাসি। শেষ দেখাটুকুও দেখতে  যেতে পারলাম না । ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। আরতি মাসি আমার নিজের মাসি নন। কিন্তু নিজের মাসির থেকেও আপন ছিলেন।আমার ছোটোবেলার অনেকটা সময় এই মাসির কোলেপিঠেই বড়  হয়েছি।কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা পরকে আপন করে নিতে জানেন আরতি মাসিও সেরকমই একজন ছিলেন।খুব ছোটোবেলায় মামাবাড়িতে গিয়ে মাসের পর মাস দাদুমণির  কাছে  থাকতাম। আমার দিদা ছিলেন না। দাদুমণি আর দুই মামা ছিলেন। আদ্যন্ত ছেলেদের সংসার। সেই সংসারে পাশের বাড়ির আরতি মাসি যেন মরুভুমিতে মায়ের ছোঁওয়া। বলা নেই কওয়া  নেই হঠাৎ হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়তাম খটখট।

 ভরদুপুরে মাসির কাছে আবদার আজ তোমাদের বাড়ি খাব। মাসিরা কিন্তু এমন কিছু বড়লোক ছিলেন না । মধ্যাহ্ন ভোজনে  থাকত আতপ চালের  ভাত আর সিম বেগুন পটল দিয়ে বাটা মাছের ঝোল। বড়জোর কিছু সিদ্ধ। খিদের মুখে তাই ছিল অমৃত । ওই আতপ চালের ভাত সিদ্ধ হওয়ার গন্ধ আমায় টানত চুম্বকের মতো ।বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটোবেলাটাও ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে আর হারিয়ে যায় ছোটোবেলার কিছু এক্সক্লুসিভ গন্ধ । পাশের বাড়ির আরতি মাসিদের আতপ চালের ভাতের গন্ধ ঠিক সেরকমই একটা সুবাস যা আমার ছোটোবেলাটাকে আমোদিত করেছিল। বড়লোক না হলেও আমার সব আবদার হাসিমুখে সামলাতেন মাসি। মায়ের মতো অপার স্নেহ ও মমতায়। মাঝে মাঝে রান্না করতে  করতে  কিছু জিনিস ফুরিয়ে  গেলে দাদুমণি বলতেন যা মাসির কাছ থেকে  চেয়ে নিয়ে আয়। মাসিকে বললেই সব পাওয়া যেত। একগাল হাসি মুখে নিয়ে নীরবে যোগান দিতেন সবই। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন লোকের  থেকে চেয়ে আনায় কোনো গ্লানি ছিল না । বরং এটাই ছিল দস্তুর । আরতি মাসির টানাটানির সংসার যেন সব পেয়েছির দেশ। সেখান থেকে  কোনোদিন খালি হাতে ফিরতে  হয়নি আমায়।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

 লোকের  মুখে শুনেছি খুব ছোটোবেলায় বিয়ে  হয়েছিল মাসির । সেই বিয়ে টেঁকেনি। অতঃপর ডিভোর্সি মেয়ে ভাইদের সংসারে। হাসিমুখে নীরবে সহ্য করে যেতেন  সবার  সব আবদার। অসাধারণ সংসারী ছিলেন মাসি। রান্না বান্নার হাত ছিল অপূর্ব। দাদুমণির কাছে অবসর সময়ে পড়তেন । এইভাবে প্রাইভেটে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বি এ পাসও করেন  তিনি। দাদুমণির কাছে সারাজীবন চিরকৃতজ্ঞ  ছিলেন । বলতেন মেসোমশাই আমার কাছে সাক্ষাৎ দেবতার  মতো । যিনি আমায় এক অন্য ভুবনের সন্ধান দিয়েছেন ।বি এ পাশ করার পর কিছু টিউশনি জুটিয়ে নিয়েছিলেন । নিজের খরচ নিজের পয়সাতেই চালাতেন ।ভাইদের  সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেও কোনো অভাব অভিযোগ ছিল না।রাত জেগে পড়াশুনা করতেন। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য। আমায় ভালোবাসতেন খুব। আমার বাবার যখন সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় , কোমায় থাকাকালীন ট্রেনে করে কোয়েম্বাটুর  নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। মায়ের এক কথায় মাসি সব কাজ ফেলে একজন নার্স হিসেবে সেবা করতে বাবার সঙ্গে ট্রেনে চলে গিয়েছিলেন।এই সব সরল সাদা সিধে অথচ কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ আর আসবেন না । অসম্ভব ভালো সেবা শুশ্রূষা করতে পারতেন ।দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে নিজের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের সেবা করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।আজও মনে পড়ে দরজার কড়া নাড়লে মাসির হাসি মুখখানা । বলত টুম্পা এসেছিস ? আরতি মাসিরা ছিলেন তিন বোন। বড় মাসির নাম ছিল সন্ধ্যা । আর পরের দুই মাসি আরতি ও ভারতী পিঠোপিঠি দুই বোন।অন্য দুই বোন সুখে সংসার করছে দেখে আরতি মাসির মনে কোনোদিন কোনো ক্ষোভ দেখিনি। মাসি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছোটোবেলার  একটা অধ্যায় শেষ হল। 

(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments