জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে - ৫৩/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫৩

সব কিছু কেমন বদলে যাচ্ছে, বিশেষ করে মানুষের মানসিকতা, আচার আচরণ, আরও অনেককিছু। অবশ্য আগেই সেটা বলেছি। তবুও যখন এই ধরণের  পরিস্থিতির শিকার হই, তখন নতুন করে উপলব্ধি করি।  যেমন আজ একটা ব্যপার খুব খারাপ লেগেছে।  বিকেলে বকুল বাড়ি এসেছে। তার কিছু আগে  বরহান(খান সাহেবের ভাই) এসেছিল। ওনার ভাইবোনেদের বিষয়ে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। এই পর্বে বলার চেষ্টা করব। এখন বর্তমান প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বরু এসেই ওর দাদার সঙ্গে কথা বলে আমার সঙ্গে দেখা না করে সঙ্গে  সঙ্গে চলে গেল। কেন চলে গেল সেটা পরে জানতে পারলাম, গতবছর যে জমিগুলো ওর আচরণের কারণে  খান সাহেব ওনার ছোটভাই সালেহানকে চাষ করতে দিয়েছিলেন, সে জমি ও আবার চাষ  করতে চায়, ওর ঘ্যানঘ্যানানিতে খান সাহেব ওকেই চাষ করার  অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। কথাটা আমাকে লুকনো হয়েছিল। এই লুকনো ব্যপারটা আমার ঠিক লাগেনি। ধান্ধা ছাড়া ওরা কখনো আসেনা, প্রয়োজন পড়লে ঠিক দৌড়ে আসে। অন্যসময় খোঁজখবরও রাখে না। অথচ এই ভাইদের জন্য কি না করেছেন। হাতে ধরে স্কুল নিয়ে যাওয়া  পড়াশোনার সমস্ত খরচ বহন করা, কলেজ যাওয়ার জন্য বাসভাড়া দেওয়া, এমন কি নিজের গায়ের  শার্ট পর্যন্ত খুলে দিয়ে ছেন। ৭০ এর দশকে একজন স্কুল শিক্ষক কটা টাকা মাইনে পেতেন? সব মিলিয়ে ৩০০ টাকা হবে, তাও নিয়মিত নয়। নিজের পড়াশোনার খরচ, বিয়ে করেছেন তার খরচ, বাড়িতেও আলাদা টাকা দিতে হত। আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষজন পড়াশোনার গুরুত্ব খুব একটা বুঝতেন না। বি এস সি পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই স্কুলের চাকরিটা পেয়ে গেছলেন(স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সেক্রেটারি বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাকরি  দিয়েছিলেন)। চাকরিটা নিয়েছিলেন এই ভেবে যে যাতে চাকরির পরীক্ষার (ডাব্লু  বি সি এস) যাবতীয় খরচ নিজে বহন করতে পারেন। বি এস সি পরীক্ষা ও স্কুলে চাকরি হওয়ার মাঝে কয়দিন যে বাড়িতে বসে ছিলেন। তাতেই শ্বশুরমশাই কাউকে একদিন দুঃখপ্রকাশ করে বলছিলেন, কী আর করব? জানব একটা  খোঁড়াছেলে ঘরে বসে খাচ্ছে। কথাটা শুনে খান সাহেব খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।  আসলে ওনারও খুব একটা দোষ ছিল না। চাকরি পাওয়ার বিষয়ে কোনও ধারণা ছিল না বলেই এমনটা ভেবেছিলেন। থাক সে কথা, খান সাহেব শুধু নিজের  ভায়েদেরই নয়, খুড়তুতো ভাই, পিসতুতো দাদার ছেলেকেও স্কুলে ভর্তি করে  দিয়েছিলেন এবং পড়াশোনা সংক্রান্ত সব কিছু দেখাশোনা করতেন। ৬ ভায়ের মধ্যে মেজ ও ছোটর ওপরের জন(বরু), এই দুজনকে স্কুলমুখো করতে পারেননি। এরা চাষবাস দেখাশোনা করত। সেজভাই আকবরকে হমিওপ্যাথি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ও এখান থেকে ‘ডি এম এস’ পাশ করে দাদাকেই ছোবল মারার সুযোগ খুঁজত। পরের ভাই বি এ পাশ করে এক বাঙ্গাল(হিন্দু) মেয়েকে বিয়ে করে  বসল। পড়াতে গিয়ে প্রেমে পড়েছিল। মেদিনীপুরেই বাড়িভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে। কোনও ইনকাম নেই, তাতেই তিন সদস্যের সংসার। কিভাবে ওদের সংসার চলবে? মাঝে মাঝে মেজ ননদের বাড়ি গিয়ে চাল ডাল তেল নুন চেয়ে নিয়ে  আসত। এভাবে আর কতদিন চলবে? শেষপর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। বউটি  আমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া পছন্দ করতনা। এসব কথা মনে করতে ভাল লাগছে না, এখন থাক। তবে আমার ভাইদের থেকে আরও তিক্ত অভিজ্ঞতা  হয়েছে। সে সব মনে হলে আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
    আমাদের সংসার যে খুব সচ্ছলভাবে চলত, তা নয়। মাসে মাসে হাউস বিল্ডিং লোনে মোটা টাকা কাটা যেত। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে উনি কোনো কম্প্রোমাইজ করতেন না। সঞ্চয়ী মানুষ ছিলেন, এই অবস্থাতেও কিছু কিছু  টাকা অসময়ের জন্য সঞ্চয় করতেন। ওনার ভায়েরা ভাবত দাদার অনেক টাকা। জমির আয় ওরাই ভোগ করত। তাছাড়া বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যও করতেন। তবুও ওদের মন ভরত না। দাদাকে ভয় করত, সরাসরি কিছু বলত না। কিন্তু নানা ভাবে অশান্তি করত।গ্রামে থাকা কালে জীবনটাকে এতটাই দুর্বিষহ করে তুলেছিল যে উনি বলতেন, একটা পিওনের চাকুরি পেলেও বাড়ি থেকে চলে যেতাম ।

    থাক ওসব কথা। ওসব কথা বলে কি আর হবে? এদিকে শরীরটা সাথ  দিচ্ছে না। ডাক্তার আবার ওষুধ পাল্টে দিয়েছেন। এতেও সমস্যা হচ্ছে, অবসাদে ভুগতে শুরু করেছি। ডাক্তারকে ফোন করতে উনি ওষুধ বন্ধ রাখতে বললেন। বকুল বলল, এখানে কিছু হবে না। মাকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে। দীপ বলল, কলকাতাতেও ভাল ডাক্তার আছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি। এপোলোতে অমিতাভ ঘোষ নামে একজন নিওরোলজিস্টের খোঁজ পাওয়া গেল। ওনারই অ্যাপয়েনটমেণ্ট নেওয়া  হল।বকুল আসতে পারেনি, তাই ওর কলেজের একজন স্টাফকে পাঠিয়েছে। আমি আর খানসাহেব সকালের ট্রেনে কলকাতা রওনা হলাম। বকুলের পাঠানো ছেলেটি সাঁতরাগাছি স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। আমরা ওখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এপোলো রওনা হলাম। আমার ভীষণ ভয় করছিল, এই ডাক্তারের ওষুধে আবার কী সাইড এফেক্ট হয়, এই ভেবে। ওখানে পৌঁছালে ছেলেটি আমাদের বসিয়ে রেখে যা যা করার করল। নাম ডাকতে খান সাহেবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সব শুনে, দেখে ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেন। ওখানেই কেনা হল। ছেলেটি আমাদের ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। তিনবেলা তিনখানা ট্যাবলেট। ভয়ে ভয়ে খেলাম। তেমন কোনো অসুবিধা হলনা। চোয়াল কাঁপাটা ধিরে ধিরে বন্ধ হল। দ্বিতীয় বার গেলে ডাক্তার বললেন, ওষুধ খেয়ে যেতে হবে, বন্ধ করা যাবে না। বোঝানোর জন্য আরও বললেন, শরীরের বাইরের অসুখ ওষুধে সেরে যায়, ভিতরের অসুখ সারানো যায় না বলয়েই হয়। ওষুধের সাহায্যে থামিয়ে রাখা হয়। তাই আজও সেই ওষুধ খেয়ে  চলেছি, পরবর্তী কালে আরও কিছু ওষুধ যোগ হয়েছে। ঘুম, অবসাদ, উৎকণ্ঠা এই সব মিলিয়ে অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছে।

      গতকাল(১১/০৭/২০১১)হাওড়া-কালকা মেল উত্তর প্রদেশের ফতেপুরের কাছে লাইনচ্যুত হয়ে  দুর্ঘটনায় পড়েছে। ৩৫ জন মারা গেছে। কী করে ট্রেন  লাইনচ্যুত হল কেউ বলতে পারছে না। তবে ড্রাইভার বেঁচে গেছে। দিনের শেষে  মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭০এ দাঁড়িয়েছে। খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা, চলেছে আমাদের দেশ। রেল দুর্ঘটনার পরের দিনই ১২ জুলাই মুম্বাইয়ের ৩ জায়গায় বিস্ফোরণ হয়েছে। ১৯জন মারা গেছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।  সাধারণ মানুষকে মেরে এদের কী লাভ হয় বুঝি না।

      ছেলেটা আমার কোনো উৎসবেই বাড়ি আসতে চায় না। এবার শবেবরাতে আসবে বলেও পরে জানাল আসতে পারবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা যদি না আসে তাহলে কীসের আয়োজন? কীসের উৎসব? মনটা খারাপই ছিল, আরও খারাপ হয়ে গেল খবরটা শুনে। অঞ্জন সকালেই ফোন করে জানাল, সেরিনা মারা গেছে। মাত্র ৪৪ বছর বয়স হয়েছিল। খুব প্রতিভাময়ী মেয়ে ছিল। বিদেশে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছিল। ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিল সেরিনা। কলকাতা দূরদর্শনের মহিলাদের ‘ঘরেবাইরে’ অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল। আমি অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলাম। সেরিনা, মাকসুদা ও আফরোজা অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন। খুব মিষ্টি দেখতে ছিল সেরিনা। মরণে সব মাটি হয়ে গেল। আমাদের সবাইকে একদিন মৃত্যুর কাছে হার মানতে হবে, কিন্তু সে কথা ভাবি ক’জন? আজ (১১/১২/১১) ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে আগুন লেগে প্রচুর পেসেণ্টা মারা গেছে। ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। এঁরা বাঁচার জন্য হাসপাতালে এসে ছিলেন, অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের আর বাড়ি ফেরা হলনা। হাসপাতালে এরকম অগ্নিকাণ্ড কী করে ঘটল? বিশেষজ্ঞরা এখন তার নমুনা খুঁজতে ব্যস্ত। আর মৃতের পরিবার ক্ষতিপূরণ  পাওয়াতে ব্যস্ত। এভাবেই ২০১১ শেষ হয়ে ‘সময়’ নতুন বছরে পা রাখল।
                                          ক্রমশ


Post a Comment

0 Comments