জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো/ পর্ব ৮/সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো 
পর্ব ৮
সুকন্যা সাহা 

সুচেতাদি 
 ছোটোবেলা   থেকেই পাড়ার  লেকটাউন  গর্ভমেন্ট স্পনসর্ড গার্লস   হাই স্কুলে পড়েছি । স্কুলটি  আধা সরকারী  বা গর্ভ স্পনসর্ড।  আমি যে সময়ের কথা   বলছি  তখনও পর্যন্ত   মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা পাড়ার  বাংলা মিডিয়াম  স্কুলেই  পড়াশুনা  করত । সরকারী  স্কুলের এই দুরবস্থা তখনও হয় নি।আর পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার  মতো গজিয়ে  ওঠেনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আমাদের ছোটোবেলায় স্কুলের শিক্ষিকারা শুধু শিক্ষাগুরু ছিলেন না ;ছিলেন ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব আমাদের ছাত্রীদের মনে গভীর রেখাপাত  করত ।  গল্প শুনেছি স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর  স্থাপন   করার সময়   থেকেই  সুচেতাদি স্কুলের  সংগে   যুক্ত  ছিলেন ।উৎসবে অনুষ্ঠানে  স্কুল  ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি।সরস্বতী পুজোর সময়েও দেখেছি নিজের বাড়ির পুজো ফেলে  স্কুলের  পুজোয় ছুটতে । ক্লাস নাইনের মেয়েদের সংগে জোট বেঁধে ঠাকুর কেনা   থেকে ডেকরেটারের অর্ডার , মূর্তি সাজানো   থেকে প্রসাদ বিতরন পুজো সংক্রান্ত   যে কোনো কাজই সুচেতাদি ছাড়া অসম্পূর্ণ  ছিল। স্কুলের অস্তিত্ব  দিদির অন্তরে   এমনভাবে ঢুকে   গিয়েছিল যে শেষ জীবনে  নিজে  যখন খুব অসুস্থ; ক্রনিক অ্যালঝাইমার্সের  পেশেণ্ট সেসময়েও  স্কুলের   রাস্তা   তিনি ভুলে যান নি... বাড়ি   থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন  স্কুলে , বাড়ির লোকেরা  খোঁজ করতে করতে  খবর   পেয়ে শেষ  পর্যন্ত  স্কুলে এসে  নিয়ে যান ।অসাধারণ ছিল দিদির স্মৃতিশক্তি আর ইতিহাসের ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্য  ছিল তার ভালোবাসার জায়গা ...প্রানের আরাম   মনের শান্তি আত্মার   আনন্দ । তাই অনায়াসে  চোখ  বন্ধ  করে আবৃত্তি করে যেতেন কর্ণ কুন্তী সংবাদ  থেকে মেঘনাবধ কাব্য। শেষ  জীবনে   সেই অমিত স্মৃতিধর সুচেতাদি  যে অ্যালঝাইমার্সের   রুগি হয়ে যাবেন আমরা  তার ছাত্রীরা কেউই তা ভাবতেও পারিনি।ব্যক্তিগত স্তরে সুচেতাদির  সংগে  সম্পর্ক কখন যে শিক্ষক ছাত্রীর  পরিচিত গন্ডী পেরিয়ে আত্মীয়তার সূত্রে   গাঁথা  হয়ে গেছে   বুঝতেই পারি  নি । আজ পিছন ফিরে  তাকালে   মনে  হয় দিদির  কথা কোথা   থেকে শুরু করব আর কোথায়ই বা শেষ  করব বুঝতেই পারি না...


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
                  সুচেতাদি  বরাবর আমার  কাছে  শুধু  শিক্ষক নন,  ভরসা , নির্ভরতার জায়গা ,  আশ্রয়স্থল , জীবনের তাপিত দিনে ভালোবাসার  শান্তির  কোমল  স্পর্শ মাথায় ছোঁয়াবার  একজন   মানুষ । শিক্ষক ছাত্রীর  সম্পর্ক  ছাড়িয়ে  কখন যে ব্যক্তিগত  সম্পর্ক তৈরী হয়ে  গেছে  জানতেও পারি নি ।মাধ্যমিক দেওয়ার সময় যখন দিদির বাড়ি যেতাম আরো কাছ থেকে দিদিকে দেখার সুযোগ হয়েছিল... দেখেছিলাম শাসনের  আড়ালে লুকিয়ে থাকা  এক কুসুম কোমল মন যে মন  লেকটাউন  গার্লসের ছাত্রীদের  নিজের মেয়ে মনে  করেন ... কতদিন   এমন  হয়েছে  দিদির বাড়ি দুপুরে ভাত খেয়েছি, আংকেলের  সেতার শুনেছি,কনক,মিনুর  সঙ্গে  গল্প করেছি, তুতুর  (দিদির পোষ্য)  সঙ্গে খেলা করেছি ... কত স্মৃতি ... কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব ? তাই সুচেতাদি আমার আবেগ আমার ছোটোবেলা ,বয়সন্ধির   সেই দিনগুলোর  অনেকখানি জুড়ে রয়েছেন দিদি আর  দিদির বাড়ির  স্মৃতি। জীবনের  নানা ওঠা পড়ায় যখনই দিদির পরামর্শ চেয়েছি , স্মিত  মুখে  সব শুনে  সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন।
দিদির  জীবনের লড়াই অনমনীয়তা বরাবর টেনেছে  আমায় । এমনকি  আংকেল(দিদির হাসবেন্ড ) যখন খুব  অসুস্থ সব সামলিয়েছেন  একা  হাতে , দু হাতে  বাজার  করেছেন  দৃপ্ত  পদক্ষেপে ।দিনের  শেষে সেতারের নৈবেদ্য সাজিয়েছেন প্রাণের  ঠাকুর  রবীন্দ্রনাথের  কাছে । জীবন দেবতার  কাছে  উৎসর্গ করেছেন অন্তরের আকুতি , নিভৃতে । 
“ক্লান্তি আমার  ক্ষমা কর প্রভু / পথে যদি পিছিয়ে  পড়ি কভু ...”
                  দিদি ,আজ  আপনি  নেই , কিন্তু আপনার মেয়েরা ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে,আপনার কথা কোনোদিনই ভুলতে পারবে না তারা ... কারণ আপনি যে তাদের  শিক্ষাগুরু ... বাবা মায়ের   পর যার অবদান  জীবনে   সবচেয়ে বেশী ...তাদের কাউকে  হাতে ধরে শিখিয়েছেন   আবৃত্তি কাউকে  অভিনয় ... যেখানেই থাক তারা কেউ আপনাকে  ভুলতে  পারবে না ।আপনি  যেখানেই  থাকুন ভালো থাকুন শান্তিতে থাকুন। পরম করূনাময়ের কাছে   আমাদের সেটাই প্রার্থনা ।
"আমার  ভান্ডার  আছে  ভরে/ তোমা  সবাকার  ঘরে ঘরে..."

(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments