জ্বলদর্চি

যমপুকুর ব্রত /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫৪
যমপুকুর ব্রত

ভাস্করব্রত পতি 


কুমারীরা কার্তিক মাস জুড়ে লৌকিক উৎসব যমপুকুর ব্রত পালন করে থাকে। মূলতঃ কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে কার্তিকের সংক্রান্তি পর্য্যন্ত এই উৎসব পালন করা হয়। কোথাও কোথাও আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকেও করে। পুরাণ বর্ণিত যমপুষ্করিণী ব্রতের অনুসারী এই যমপুকুর ব্রত। যমপুকুর লৌকিক উৎসবটি পালন করতে হয় চার বছর ধরে। পালনের শেষদিন ১২ টি কড়ি লাগে। এখন অবশ্য কড়ির চল নেই। তার বদলে টাকা দেওয়ার রীতি। সেই অর্থ ভাইকেও দিতে হয়। সেইসাথে চারজন ব্রাম্ভণকে আমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়। কেউ কেউ রাখালকে ছাতা, জুতা, কাপড়, পাচনবাড়ি আর দশ কড়া কড়ি দিতো। যমপুকুরের পূজা শুরুর আগে চার কড়া কড়ি, চারখানি হলুদ, চারখানা সুপারী ঐ পুকুরের চার কোণে পুঁতে দিতে হয়। সেইসাথে একটি প্রদীপ জ্বালাতে হবে৷ মূলতঃ মোক্ষ, মুক্তি, পুণ্যার্জন আর পিতৃকূলের ধনসম্পদ বৃদ্ধির কামনায় পালন করেন কুমারীরা। এটা সম্পূর্ণ ভাবে তাঁদের নিজস্ব উৎসব।

এই উৎসবের অন্যতম উপচার হিসেবে বাড়ির উঠোনে, অথবা বাগানে কিংবা পুকুর পাড়ের কোথাও একটি এক হাত চৌকা পুকুর খোঁড়া হয়। পুকুরটির চারপাশে চারটি ঘাট করতে হয়। পুকুরের মাঝখানে পোঁতা হয় কচু, হলুদ, কলমী, শুষনী ও হিংচের গাছ। এবার সেই গাছে জল দেওয়ার সময় বলা হয় ---
"কালো কচু সাদা কচু ল ল করে, 
সোনার কৌটা, রূপার খিল। 
খিল খুলতে লাগলো ছড়, 
আমার বাপ ভাই হোক লক্ষেশ্বর।
লক্ষ লক্ষ দিলে বর, ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর।।"

পুকুরের দক্ষিণ ঘাটের উপর মাটির তৈরি যমরাজা, যমরানী ও যমের মাসির পুতুল বসানো হয়। পরে তা জলে দিতে হয়। তখন যমরাজা, যমরানী এবং যমের মাসিকে সাক্ষী রেখে ফুল দিয়ে পূজা করে বলতে শোনা যায় --
"যমরাজা সাক্ষী থেকো যমপুকুরটি পূজি, 
যমরানী সাক্ষী থেকো যমপুকুরটি পূজি।
যমের মাসি সাক্ষী থেকো যমপুকুরটি পূজি"।
এছাড়া উত্তরদিকের ঘাটে মেছো ও মেছেনি মাছ ধরছে এরকম পুতুল, পূর্বদিকের ঘাটে শেকো ও শেকোনীর পুতুল এবং ধোপা ও ধোপানী কাপড় কাচছে এরকম পুতুল এবং পশ্চিমদিকের ঘাটে কাক, বক, চিল, হাঙর, কুমির, কচ্ছপের তৈরি মূর্তি বসানো হয়। পূর্ব বা উত্তরমুখী হয়ে বসে পূজোর শেষে জলে ফেলে দিতে হয়। এই পুতুলগুলিকে উদ্দেশ্য করেও বলা হয় ঐ মন্ত্র। সবশেষে পুকুরে জল ঢেলে বলা হয় -- 
"শুষণী কলমী ল ল করে, 
রাজার বেটা পক্ষী মারে। 
মারণ পক্ষীর শুকোয় বিল, 
সোনার কৌটা রূপার খিল।।
খিল খুলতে লাগলো ছড়, 
আমার বাপ ভাই হোক লক্ষেশ্বর। 
কালো কচু, সাদা কচু ল ল করে, 
রাজার বেটা পক্ষী মারে। 
মারণ পক্ষীর শুকোয় বিল, 
সোনার কৌটা রূপার খিল।। 
খিল খুলতে লাগলো ছড়, 
আমার বাপ ভাই হোক লক্ষেশ্বর। 
লক্ষ লক্ষ দিলে বর, 
ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর"।
এই ছড়াটিই কোথাও কোথাও বলা হয় এভাবেও --
"শুষনী কলমী ল ল করে,
রাজার বেটা পক্ষী মারে।
মারণ পক্ষী শুকোর বিল, 
সোনার কৌটা রূপার খিল।
খিল খুলতে লাগলে ছড়, 
আমার বাপ ভাই হোক লক্ষেশ্বর"।

এছাড়াও ঘটি দিয়ে জল ঢালার সময় কুমারীদের মুখে শোনা যায় --
"এই ঘটিটি জল ঢালি বাপ মার।
শ্বশুর শাশুড়ির।
পাড়া পড়শির
স্বামীর আর আমার।
সাত ভায়ের বোন আমি ভাগ্যবতী।
যমপুকুর পূজি আমি, সাক্ষী জগৎপতি"।

কমলিনী সাহিত্য মন্দির (১৩৩৩) থেকে প্রকাশিত "ব্রত দর্পণ" (৩৭ - ৪২ পৃষ্ঠা) এ যমপুকুর ব্রত নিয়ে যে কাহিনীর বিবরণ করা হয়েছে তা এরকম --- এক বুড়ি ছিল। তাঁর এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলের নাম শুকরাজ, আর মেয়ের নাম দুগরাজ। শুকরাজের এক গেরস্তর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হল। আর যমের সঙ্গে দুগরাজের বিয়ে হল। দুগ্রাজ শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। যমরাজ আর তাঁকে বাপের বাড়িতে আসতে দিলনা।

এ দিকে শুকরাজের বউ, কাৰ্ত্তিক মাস প’ড়তেই উঠানে পুকুর খুঁড়ে যমপুকুর পূজো করছে। এমন সময় তাঁর শাশুড়ি এসে বললে — “হ্যাঁ লা বউ, ও কি পূজো করছিস? কি হিড় বিড়চ্ছিস্? কি বিড়বিড়চ্ছিস? আমার ছেলেকে খাবি, না আমার মেয়েকে খাবি?” এই কথা বলে — এক লাথি মেরে, থুথু দিয়ে, জঞ্জাল ফেলে, যমপুকুর বুঝিয়ে দিল। বউ ধর্ম্মরাজকে সাক্ষী রেখে বললে—“হে ধর্ম্মরাজ! আমি এক বৎসর পুকুর পূজো করলাম, তুমি সাক্ষী রইলে।”

এমনি করে সে বছর গেল। তার পরের বছরে কার্ত্তিক মাস প’ড়তেই আবার বউ পুকুর পাড়ে, কলা গাছের ধারে, লুকিয়ে পুকুর খুঁড়ে পুজো করতে লাগলো। একদিন শাশুড়ি হঠাৎ দেখতে পেয়ে, বউকে বকতে বকতে বললে—“হ্যাঁ লা, আবার তুই কি হিড় বিড়চ্ছিস? কি বিড় বিড়চ্ছিস? আমার ছেলে খাবি? না আমার মেয়েকে খাবি?” এই না ব'লে আবার লাথি মেরে, থুথু দিয়ে, জঞ্জাল দিয়ে, পুকুর বুঝিয়ে ঘরে চলে এল। বউ কাঁদতে কাঁদতে বললে —“হে যমরাজ, তুমি সাক্ষী থেকো আমি দু'বছর যমপুকুর পুজো করলাম।”

সে বছরও কেটে গেল, তারপর আবার কার্তিক মাস পড়তেই, রান্নাঘরে, উনুনের গোড়ায়, যমপুকুর খুঁড়ে পূজো করতে লাগলো। এ দিকে শাশুড়ি আবার দেখতে পেয়ে বউকে লাথি মারলো, আর বলল “আবার সেই পুজো করছিস? ফের হিড় বিড়চ্ছিস, ফের বিড় বিড়াচ্ছিস? ছেলে খাবি না মেয়ে খাবি?” এই না বলে, লাথি মেরে, ফের পুকুর বুজিয়ে দিল। বউ কাঁদতে কাঁদতে ধর্ম্মরাজকে সাক্ষী রেখে বললে— "হে ধৰ্ম্মরাজ। তুমি সাক্ষী থেকো, আমি এই তিন বছর যমপুকুর পুজো করলাম।"

তারপরের বছরে বউ বাড়ির পেছনে ছাইগাদার পাশে, পুকুর খুঁড়ে লুকিয়ে পূজো করতে লাগলো। কিছুদিন পরে, মাস যায় যায়, সংক্রান্তির আগের দিন, ফের শাশুড়ি দেখতে পেয়ে বউকে যাচ্ছেতাই বলে, খুব গাল দিল। লাথি মেরে আগের মত ফের পুকুর বুজিয়ে দিল। বউ কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে, ধর্ম্মরাজকে সাক্ষী রেখে বললে—“হে ধর্ম্মরাজ ! আমার এই যমপুকুর পুজো ব্রত উদযাপন শেষ হল, তুমি সাক্ষী রইলে।” এই বলে নমস্কার করে ঘরে ফিরে এল।

কিছুদিন যায়। দু তিন বছর পরে শাশুড়ির শক্ত রোগ হল। দুগরাজকে খবর দিয়ে আনানো হল। কত ওষুধ, কত টোকা করা হল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা। শেষে একদিন ম'রে গেল। শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাওয়ার পর দুগরাজ শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। দুগরাজ আসতেই যমরাজ বললে, “দেখ দুগরাজ, তুমি তিন দিকেই, ইচ্ছেমত যেমন বেড়াতে, তেমনি বেড়িয়ো। কেবল দক্ষিণ দিকে যেওনা।”

দুগরাজ মনের সুখে বেড়িয়ে বেড়ায়। একদিন হঠাৎ দক্ষিণ দিকটা বেড়াতে তাঁর ভারি সাধ হল। একদিন লুকিয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়ে ভয়ে একেবারে আঁৎকে উঠলো। ভাবলো, এই জন্যে বুঝি যমরাজ আমায় বারণ করেছিল। এমন সময় শুনতে পেল, যেন নরককুণ্ডর মাঝখান থেকে কে যেন তাঁর আর দাদার নাম করে বারে বারে ডাকছে। চেয়ে দেখে, নরককুণ্ডর মাঝে, অনেক পাপীরা সব হাবুডুবু খাচ্ছে। আঁর ভয়ানক চেঁচাচ্ছে। শেষে দেখল, ঠিক যেন তাঁর মার মত। এক একবার মাথা তুলে উঠছে, আর অমনি ভীষণ যমদূতরা বড় বড় ডাঙ মেরে গুয়ের ভেতর ডুবিয়ে দিচ্ছে। আবার খাবি খেয়ে উঠছে। বড় বড় পোকা সব নাকে মুখে ঝুলছে। 'শুকরাজ, দুগরাজ আমায় বাঁচা' ব'লে চেঁচাচ্ছে। অমনি যমদূতরা বড় বড় মুগুর মেরে আবার ডুবিয়ে দিচ্ছে। মা'র এই রকম সাজা দেখে, কাঁদতে কাঁদতে, দুগরাজ যমপুরীতে ফিরে এল। তার পরদিন দুপুর বেলা যমরাজ যখন খেতে বসেছে, তখন হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে দুগরাজ সেখানে এসে বললে— “আমি একটা কথা বলতে এসেছি।” যমরাজ বললে, "বল”। তখন দুগরাজ বললে, “ভয়ে বলব কি নির্ভয়ে বলব?” যমরাজ বললে,—“নির্ভয়ে বল”। তখন দুগরাজ বললে, “আমায় দক্ষিণদিকে যেতে বারণ করেছিলে। আমি ভাবলাম, যখন বারণ করেছ, তখন ওখানে নিশ্চয়ই কোনো আশ্চর্য্য জিনিষ আছে এই ভেবে আমি কাল সে দিকে গেছলাম। গিয়ে দেখি, আমার মাকে নরককুণ্ডতে ফেলে তোমার লোকেরা সব মারছে। কি করলে মা'র উদ্ধার হয়, তাই তোমায় করতে হবে"।

যমরাজ বললে—“তোমার দাদার বউ যখন যমপুকুর পুজো করত, আর তোমার মা সে সব লাথি মেরে, থুথু দিয়ে জঞ্জাল দিয়ে, বুঝিয়ে দিত। সেই পাপে এই সাজা। ওর আর উদ্ধার হবেনা।” এই শুনে দুগরাজ খুব কেঁদে কেটে বললে—“না, তোমায় উপায় করতেই হবে।” তখন যমরাজ বললে, “একটা উপায় আছে, যদি তোমাদের বউ চারটি যমপুকুর তোমার মা'র নামে পূজো করে, তবেই উদ্ধার হবে। নইলে নয়।”

দুগরাজ বললে—“মা যখন বউকে অত কষ্ট দিয়েছে, তখন বউ কি মার জন্যে করবে?” দুগরাজের দুঃখ দেখে, যমরাজ বললে, “আচ্ছা দেখ, তোমাদের বউ এখন পোয়াতি। ওঁর বিয়োবার সময় আমি ওঁকে ভর করব। খুব কষ্ট দেবো। সেই সময় যন্ত্রণায় রাজি হয়ে পুজো করবে। যেই পূজো হয়ে যাবে, অমনি তাঁরও ছেলে হবে। আর তোমার মা'রও উদ্ধার হবে।” এই কথা শুনে তখন দুগরাজ একটা ভাল দিন থেকে বাপের বাড়ি এসে বউকে খুব আদর যত্ন করতে লাগলো। পাঁচ মাসে কাঁচা সাধ দিল। আট মাসে ভাজা দিল। ন মাসে পঞ্চামৃত ও সাধ খুব ঘটা করে দিল। তারপর দশমাস দশদিনে ব্যথা হল। তখন দুগরাজ বললে, “ভাই বউ, আমার মা'র নামে যদি চারটা যমপুকুর পুজো করিস, তা হলে বড় ভাল হয়।” বউ বললে, “আমি তা পারবো না, আমায় যে কষ্ট দিয়েছে লাথি মেরেছে, পুকুর বুজিয়ে দিয়েছে, পুজো পর্যন্ত করতে দেয়নি, তাঁর জন্যে আমি পুজো করব না।”

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
এ দিকে ক্রমে ব্যথা খুব জোর জোর হতে লাগল। তবু ছেলে হয়না। কষ্ট হ'তে লাগল। তখন দুগরাজ ফের বললে, “ভাই, তুই চারটে যমপুকুর মা'র নামে পূজো কর। তোর এখনি ছেলে হবে।” বউ বললে, “কিছুতেই নয় — আমি পূজো করব না।” এ দিকে যমরাজের ভর হয়েছে। খুব কষ্ট হ'তে লাগলো। ছেলে কিছুতেই হয়না। যন্ত্রণায় বউয়ের প্রাণ যেতে বসেছে, ছট্‌ফট্ করছে। তখন দুগরাজ ফের বললে, “ভাই, তুই চারটে যমপুকুর মা'র নামে পূজো কর, তোর সব কষ্ট যাবে, এখুনি ছেলে হবে।” তখন আর কি করে, তাড়াতাড়ি চারটে যমপুকুর পূজো করল। তা করতেই অমনি সব ব্যথা, সব কষ্ট জুড়িয়ে জল হয়ে গেল। সুন্দর ছেলে হ'লো, আর ওদিকে মা'ও নরককুণ্ড থেকে উদ্ধার হয়ে গেল। এ দিকে ষষ্ঠীপূজার পর দুগরাজ শ্বশুরবাড়ি চলে এল। ওদিকে শুকরাজ বউ, ছেলে নিয়ে সুখে ঘরকন্না করতে লাগল।

Post a Comment

0 Comments