জ্বলদর্চি

মাধুরী /শিশির পাল


 মাধুরী

শিশির  পাল

সন্ধে আটটা কুড়ির মেমু লোকাল গড়বেতা স্টেশনে ঢুকতেই সব্জির তিনটে বস্তা কামরার ভেতরে ঠেলে ঢোকাল মাধুরী। প্রতিদিন নিয়ম করে মেদিনীপুরে সব্জি নিয়ে আসে। সঙ্গে আরও কয়েকজন মহিলা পুরুষও একই ব্যবসা করে । গড়বেতার আশেপাশে, বগরী, খড়কুসমা, চন্দ্রকোনা এইসব জায়গায় প্রচুর সব্জি চাষ হয়। এখান থেকেই পাইকারি দরে কিনে, বাড়িতে নিয়ে যায় মাধুরী। ভোরবেলা খুচরো ব্যবসায়ীরা নিয়ে যায়।বাড়ি থেকে। নিজে গড়বেতায় না এসে এজেন্টের মাধ্যমে সব্জি ব্যবসা করাই যায়। মার্জিন হয়তো একটু কমবে। ঝক্কি কমবে তারও বেশি। আসলে, নিজেকে ব্যাস্ত রাখাটাও খুব দরকারি। বাড়িতে, প্রাইমারি স্কুলে পড়া একরত্তি ছেলে। বিধবা শাশুড়ি।স্বামী পরিত্যক্তা ননদ। দারিদ্র আর ঝগড়া নিত্য সঙ্গী। মাঝেমধ্যেই কোর্টে যাওয়া।এই দুঃসহ দৈনন্দিন থেকে মুক্তির জন্যও এই ছোটাছুটি বলা যায়।
ডেইলি প্যাসেঞ্জারের বেশ কিছু গ্রুপ আছে এই লাইনে। কখনো কখনো ট্রেনেই কেউ কেউ কেনে। চারটে ফুলকপি। দুটো বাঁধাকপি। এইরকম গোটা গোটা। থোক দামে।
“আজ কত করে নেবে, তোমার ফুলকপি ? সেদিনের গুলো বেশ ভালো ছিলো।”
 ডেইলি প্যাসেঞ্জার মৃদুল বলে।
শীতকালের ট্রেন। সব জানালা বন্ধ। বাইরের আওয়াজ খুব বেশি আসে না। মৃদু কু ঝিকঝিক। মাধুরী বলে, “দাদাভাই, আমরা সব সময় ভালো মালই রাখি। আপনাদেরকে তো খারাপ দেওয়ার প্রশ্নই নাই। আজ, কিন্তু চল্লিশ টাকা জোড়া লাগবেই।”
মৃদুল আবার বলেন, “দাম তো দেখছি, ডেইলি বাড়াচ্ছো ! তিরিশ টাকা জোড়া দাও।”
“না না। পারবো না দিতে দাদাভাই। এখনই তো একটু দাম পাই। কিছুদিন পর তো দশ টাকা জোড়া নেওয়ার লোক থাকবে না।”
সত্যি কথা। কাঁচা সব্জির ব্যবসার ক্ষেত্রে নিয়মটাই এরকম। সিজনের প্রথমে, যখন সবে ফলন শুরু হয় ফসল তোলা হয়, চাষী, ফড়ে, পাইকারি বা খুচরো বিক্রেতা সবাই একটু মুনাফা করতে পারে। সিজন শেষ।সব শেষ। শুধু ফড়েরা মারে। আর শেষ ক্রেতারা মারা যায়। শেষে, পঁয়ত্রিশ টাকায় ফাইনাল।

ট্রেনটা প্রতিদিনকার মতো একটু দেরি করে স্টেশনে পৌঁছায়। পাড়ার ভ্যানওয়ালা বাপন, প্লাটফর্মে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকে।মাধুরীর সঙ্গে সব সব্জিবস্তাগুলো নামায়।ভ্যানে তোলে। ভ্যান ঠেলে এগোয় বাপন। পেছনে  মাধুরী।রেললাইন বরাবর নেপালিপাড়া দিয়ে হাঁটছে। রেললাইন ক্রস করে বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে কিছুদুর গিয়ে পাড়ার গলির মুখে ভ্যানটাকে ঢোকায়। রাস্তার বড় স্ট্রিট লাইটটা এখানেই শেষ।তার আলোটা মাধুরীদের বাড়ি অব্দি পৌঁছায় না।কিছুটা প্রায় অন্ধকারেই যেতে হয়।মোবাইলের টর্চটা মাধুরী জ্বালায়। এগোতে থাকে।হঠাৎ বাপন ভ্যান থামায়।মাধুরী বলে, “কী হলো ?”
বাপন কথা না বলে পেছনে ঘোরে।মাধুরীর দিকে একটু এগিয়ে আসে। গলির অন্ধকার।শীতের রাত।লোকজনও নেই।মাধুরী একটু অবাক হয়। বাপন সম্পর্কে মাধুরীর দেওর।বলে, “বৌদি একটা কথা ছিল।”“দেরি হচ্ছে তো ! আগে বাড়ি যাই।তারপর শুনি ?”
“না।আসলে, অনেকদিন ধরেই কথাটা বলবো ভাবছি।সাহস করে বলতে পারছি না।”
মাধুরীর মন কু ডাকে।ভয়ও পায়। একরকম বাধ্য হয়েই বলে, “বলো।কী বলতে চাও।”

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
“বৌদি।রতনদা তো মাতাল। খুনি।জেল খাটছে। এরকম একটা খারাপ লোকের সঙ্গে তোমার আর থাকার দরকার নেই।”

ঝাঁঝিয়ে ওঠে মাধুরী।”বাপন, এসব কথা বলবে না। অগ্নিসাক্ষী রেখে বিয়ে করেছি ওকে।এসব কখনও ভাবি না আমি।আমার ছোট ছেলে আছে।তার মুখ দেখে সব ভুলে থাকি । আর তোমার দাদা খুনি, একথা কে বলল ? ও খুন করতেই পারে না। ওকে দীনেশ জানা ফাঁসিয়েছে ! এখনও কোর্টের রায় বেরোয়নি। ও খুনি নয়।সব পরিষ্কার হয়ে যাবে একদিন। ঠাকুর আছেন।তিনি সব দেখছেন উপর থেকে।”

একটানা কথাগুলো বলে মাধুরী একটু হাঁপায়।বলে, “এসব বাজে কথা ছাড়ো। চলো।তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো। কেউ এসব শুনলে কী হবে, তোমার কোনও ধারণা নেই। এমনিতেই পাড়ায় কান পাতলে অনেক কথায় কানে আসে আজকাল।আমি পাত্তা দিই না।”
বাপন একটা ঝটকা খায়। বুঝতে পারে না, মাধুরী এভাবে রিয়্যাক্ট করবে। আশা ছাড়ে না। বলে, “তোমার ছেলের দায়িত্বও আমি নেব।আমরা মেদিনীপুর ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে ঘর করবো। প্লিজ  বোঝার চেষ্টা করো। একটু ভেবে নাও দু'এক দিন।তারপর বলো আমাকে।”
মাধুরী আর কোনও উত্তর দেয় না। অন্ধকারে মাধুরীর মুখের অভিব্যক্তিও টের পায় না বাপন। একটা চাপা নৈঃশব্দ নেমে আসে। বাপন ভ্যানটাকে আবার ঠেলে বাড়ির দিকে এগোয়।
#
বাপন চলে যাওয়ার পর, রাজেশ আসে।দলবল নিয়ে।পার্টির দাদা।পাড়াতেই থাকে। গলা উঁচুতে।“মাধুরী। বেশ তো কামাচ্ছিস। আমাদের এ মাসেরটা এখনও দিস নি। নিতে এলাম। এবারে পুরো হাজার টাকাই নেব। গত মাসে তোর রিকোয়েস্ট রেখেছি।আটশ টাকায়। দে দে। তাড়াতাড়ি। সকালেই তো লোক পাঠিয়ে বাড়িতে টাকা রেডি রাখতে বলেছিলাম। ক্লাবে যাবো সবাই।”
মাধুরী পা ধরতে বাকি রাখে। বলে, “তেমন কামাই তো হচ্ছে না, দাদা। আটশোই নাও।”
“না না। হাজার টাকাই দে।”
রাত অনেক।তারপর এইরকম একদল লোক। উপায় আর কী আছে। হাজার টাকা বের করে দেয় মাধুরী। ভেতরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে মাধুরীর ছেলে। যাওয়ার সময় রাজেশ বলে, “তোর স্বামী তো থাকে না।আপদে বিপদে পড়লে বলিস।আমরা আছি।কোনও ভয় নেই। তোর অবশ্য সাহায্য লাগবে না। বাপন তো আছে!”
রাজেশের সঙ্গে থাকা ছেলেগুলোর একটা সম্মিলিত হাসির আওয়াজ ওঠে। ক্লান্ত, ভীত মাধুরী বলে, “একটা দরকার আছে, দাদা।”
“কী ? বল।”
“সিপাই বাজারে, দীনেশ জানার বাড়িতে যেতে হবে। আমার স্বামীকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে ও।আমার বিচার চাই।”

একটা চাপা কান্নার শব্দ।রাজেশ একটু গম্ভীর হয়। সবাই চুপচাপ। ডিসেম্বরের শীত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
“ওটা তো গৌতমের এলাকা। ঠিক আছে।কাল সকালে গৌতমের বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে চলে যাস।আমি ওকে এখুনি ফোনে বলে দিচ্ছি।”
 রাজেশ চলে যায়।বাপন তো চলে গেছে অনেকক্ষণ। রাত্রে কিছুতেই ঘুমোতে পারে না মাধুরী। কেন এত সংগ্রাম ওর ! সবাইকেই কি এমন জটিলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাপনের কি কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে ? কই, ওই অন্ধকারে বাপন তো তার শরীরে হাত দেয়নি।যেটা সে অনায়াসেই করতে পারত।মাধুরীর কিছুই করার থাকত না। সে কি মাধুরীকে খুব ভালোবাসে?রতনের পিসির ছেলে বলেই বাপনের সাহায্যটুকু নিয়ে ব্যবসায় নামা। বাপনের তো নিজের তেমন কোনও রোজগারও নেই।একশ দিনের কাজ আর টিউশন পড়ানো এইসব দিয়ে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে একলা ঘর।তাই কি তার মনে এমন নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন। কিন্তু কেন ! মাধুরীর স্বামী সন্তান আছে। এটা  তো সত্যি। তেমনই বাপনের মনকেও বেঁধে দেওয়ার ক্ষমতা নেই মাধুরীর,এটাও অমোঘ। এক অদ্ভুত বিভাজন নিয়ে শীত রাতের স্তব্ধতাকে চিরে দেয় ঘুমহীনতা।ছেলের মায়াবি মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে যায় মাধুরী।ঠাকুরকে ডাকে।”শক্তি দাও।পথ দেখাও।”

সকালে, পরিকল্পনা মতো, সোজা ছুটে যায়। সিপাই বাজারে। গৌতমের ঘরে। দীনেশ জানার কাছে গিয়ে জবাব চাইতে হবে যে !
গৌতম এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ওকে দেখে, দীনেশ অবাক হয় না। ভেতরে ডাকে।সঙ্গে মাধুরীকে দেখে আসার উদ্দেশ্য বুঝে নেয়। দীনেশ বলে, “কী ব্যাপার, তুই আজ হঠাৎ ? কিছু বলবি ? শুনলাম আজকাল সব্জি ব্যবসায় নেমেছিস। রতনটা, এক্কেবারে জানোয়ারের কাজ করেছে। পুরো সংসারটাকে ভাসিয়ে দিল !”
কমদামি উলের চাদরে দাঁড়িয়ে থাকে মাধুরী। ঠান্ডায় আর রাগে কাঁপছে ভেতরে ভেতরে। চুপ করে থাকে। এ বাড়িতে এর আগেও এসেছে ও। রতন দীনেশ জানার ব্যবসার গাড়ি চালাত এতদিন।সেইসূত্রে  দু'একবার এসেছে মাধুরী। বাধ্য হয়ে আজ আবার আসা। কথা বলতে বলতে দীনেশ ভেতরে নিয়ে যায় গৌতমকে। কিছুক্ষণ পর মাধুরীকেও ডাকে। গৌতম বোঝায়। “দেখো, মাধুরী, রতন যা করেছে, তার কোনও ক্ষমা নেই।”
মাধুরী অবাক। এ কী বলছে, গৌতম বাবু। কী বলবে এর পর। ওকে সব কথাই বলেছে মাধুরী। তারপরও এ কথা বলছে কী করে ! মাধুরী বলে, “না, আপনারা ভুল বলছেন। ও কোনও অন্যায় করেনি। ও এরকম করতেই পারে না। দিঘার বড় হোটেলে খারাপ মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে তাকে খুন করার মতো ক্ষমতা, টাকা , সাহস ওর কিচ্ছু নেই।ও এ কাজ করতেই পারে না। আমি সব জানি, এ কাজ কে করেছে। একদিন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি সব বুঝি। আপনার কাছে কোনো উপকারই পাব না।”
বলতে বলতে রেগে যায় মাধুরী।গৌতমের দিকে ঝলসে দেওয়া দৃষ্টিতে তাকায়। আর কোনও কথা না বলে, বিড়বিড় করতে করতে ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসে।

#
জজ কোর্টে এলেই কেমন অস্থির আর ভয় ভয় লাগে মাধুরীর। কোর্ট চত্ত্বরে অনেক ভিড়। কালো কোর্ট পরা উকিল।ছোট ছোট শেডের নীচে উকিলের টেবিল ঘিরে লোকজন।এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি। পুলিশ।আজ রতনের ফাইনাল রায় বেরোবে।মাধুরীর উকিল নতুন ল পাশ করা একজন সহৃদয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে।সে তার সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে। বাকিটা প্রেক্ষিত, সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচারকের নিরপেক্ষ দৃষ্টির উপর ছেড়ে দিতে হবে। কোর্টরুমে এক সাইডে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে মাধুরী।সঙ্গে ওর ছেলে, শাশুড়ি, ননদ সবাই।বাপনও।

কোর্টরুমে ডিস্ট্রিক্ট জজ সাহেব মন দিয়ে ফাইলটা দেখছেন।সবাই চুপ।পিনড্রপ সাইলেন্স।আজ ফাইনাল রায়।মাধুরীর উকিলও অনেকটা ভীত। তবে সে আত্মবিশ্বাসে অটল। বাইরে প্রিজন ভ্যান।পুলিশ। জজসাহেব রায় পড়েন। খুনের অপরাধে রতনকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ওর যাবজ্জীবন জেলের নির্দেশ দেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে মাধুরী আর ওর বাড়ির লোকজন।বিশ্বাস হয় না মাধুরীর। ও জানে দীনেশ জানা দিঘার হোটেলে এবং সম্ভাব্য সকল জায়গায় টাকা দিয়ে , রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, মিথ্যে মামলা সাজিয়ে এইসব করেছে। রতন খুন করতেই পারে না।মাধুরীর উকিল মাধুরীর গায়ে হাত রাখে।জড়িয়ে ধরে।মাধুরী আরও জোরে কাঁদে। মাধুরীকে বলে, “চিন্তা করো না।আমরা হাই কোর্টে অ্যাপিল করবো। ভরসা রাখো। সত্য একদিন প্রতিষ্ঠা পাবেই।” 

পাশেই অপ্রস্তুত বাপন দাঁড়িয়ে থাকে । কালো প্রিজন ভ্যানে রতনকে তুলছে পুলিশ।খোঁচা খোঁচা না কাটা দাড়ি, না আঁচড়ানো চুলের ছন্নছাড়া শীর্ণকায় রতন মাধুরীর হাতটা ধরে। সে কান্নায় অবসন্ন। ভয়ে বিহ্বল।বলে, “মাধুরী বিশ্বাস করো আমি নির্দোষ।আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।” মাধুরী বেশ জোরে ধরে রতনের হাত। তার অবলম্বনের হাত।যেন পায়ের তলার মাটি সরে সরে যাচ্ছে। বলে, “কেউ মানুক না মানুক, আমি জানি, তুমি নির্দোষ। আমি তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করেই ছাড়ব। দেখ, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে তুমি। ভরসা রাখো। নতুন করে আমরা আবার সংসার পাতবো।”

প্রিজন ভ্যান এগিয়ে যায়। ভ্যানের গ্রিলের ভেতর দিয়ে রতনের ছলছল চোখ দেখতে থাকে মাধুরী। যে চোখে ভাসে একঝাঁক প্রশ্ন, বিরল বিস্ময় আর বিম্বিত হয় মাধুরীর জন্য অসহ্য কষ্টের  স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।

Post a Comment

2 Comments