জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী/উপপর্ব — ০৪/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৬৯

এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

(মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী)
উপপর্ব — ০৪

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


(১)
থিয়েটারের মাধুরী :

মঞ্চ বাঁধা হল। তিনদিক খোলা মঞ্চ। মঞ্চের পেছন দিক রঙিন কাপড় দিয়ে ঘেরা। খান কতক হ্যাজাক লাইট টাঙানো হল মঞ্চে। হ্যাজাকের আলোয় রীতিমত উৎসবের আমেজ জমিদার বাড়িতে। কশাড়িয়া গাঁয়ের জমিদার শ্রী মণীন্দ্র নাথ মণ্ডল। তাঁর ভাই অঘোরনাথ মণ্ডল। তাঁর গানবাজনার বিস্তর শখ। থিয়েটারের শখও বারোআনা। আদ্যন্ত শৌখিন মানুষ তিনি। রসিকও বটে! মাঝেমধ্যেই গানবাজনা আর থিয়েটারের আসর বসে তাঁর বাড়িতে। জমাটি সে-আসর। গাঁ জুড়ে তখন আনন্দের মহল। থিয়েটারে মঞ্চস্থ হত হরেক রকম নাটক।

গানবাজনা শোনা হোক কিংবা নাটক দেখা — সবেতেই গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে পড়ত জমিদার বাড়িতে। সন্ধ্যার মুখে। মেলা লোকের সমাগমে গমগম করে ওঠে জমিদার বাড়ি। ছোটাছুটি, তৎপরতা বাড়ে। হই হট্টগোল চলে। হ্যাজাকের অল্প আলোয় চকচক করে ওঠে গাঁয়ের চাষাভুষা লোকগুলোর মুখ চোখ। সন্ধ্যা নামার আগে থেকেই মঞ্চের সামনে ভীড় বাড়ে। অনন্ত অপেক্ষা — কখন শুরু হবে নাটক! সারাদিন অমানুষিক খাটাখাটনির পরেও অক্লান্ত লোকগুলো! ক্লান্তির লেশমাত্র নেই চোখে মুখে! গাঁয়ের গরীব গুর্বো মানুষগুলোর জীবনে শখ আহ্লাদ পূরণের সাধ্য হয়তো নেই; তবে সাধ আছে ষোলআনা। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় একফোঁটা খামতি নেই। 
   ‌ ‌‌
সেবার গাঁয়ের জমিদার বাড়িতে বসল থিয়েটারের আসর। মঞ্চস্থ হবে নাটক 'বঙ্গে বর্গী'। আশেপাশের এলাকায় আলোর বেগে পাঁচ কান হয়ে গেল খবর খানি। দলে দলে লোক এসে হাজির থিয়েটার দেখতে। নাটকের একটি মুখ্য নারী চরিত্র 'মাধুরী'। সেসময় গ্রামের মহিলারা নাটক অথবা সিনেমায় অভিনয় করতে ভয় পেত, লোকলজ্জা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতায়। অগত্যা পুরুষদের মহিলা সাজিয়ে অভিনয় করানো হত নাটক কিংবা যাত্রায়। কিন্তু মাধুরীর চরিত্রে অভিনয়ের শিল্পী পাওয়া ভার হল কশাড়িয়া গ্রামে। নারী চরিত্রে অভিনয়ে সকলে নিমরাজি। শেষমেশ ডাক পড়ল রামের। নাটকে মাধুরীর চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব আসে। এক হাতে লুফে নেয় সে। একে বড়দের অনুনয় বিনয়, তায় নিজের ভেতরে সুপ্ত ইচ্ছা। হোক না নারী চরিত্রে অভিনয়। সোৎসাহে রাজি কিশোর রাম। সে এক পায়ে খাড়া মাধুরীর চরিত্রে অভিনয় করতে। লম্বা পরচুলা, মুখ ভর্তি পেইন্টিং আর শাড়ি পরিহিতা রামকে দূর থেকে দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে সে মেয়ে নয়, আসলে ছেলে! দর্শকরা বেজায় খুশি। মুহুর্মুহু করতালি। রামের বহুরূপী টের পায়নি কেউ। বরং কান্নার দৃশ্যে অভিনয়ের সময় রামের চোখ দিয়ে গলগল অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখে দর্শকরাও নিজেদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। ঝরঝর রামের অশ্রু যত গড়িয়ে পড়ে অবলীলায়, দর্শকের হাততালিতে তত সরগরম হয়ে ওঠে মঞ্চ। উচ্ছসিত ধ্বণীতে অন্ধকারে থমকে দাঁড়ায় নিশাচরও। করতালির বন্যায় দারুণ প্রশংসিত হয় রামের অভিনয়। যদিও তার এ চাঞ্চল্য তাৎক্ষণিক! এ আনন্দ ক্ষণিকের! সাময়িক উচ্ছাসে ভাসতে অপারগ তার স্থির মন। তার লক্ষ্য আরও গভীরে। উদ্দেশ্য শিক্ষার আলোয় নিজেকে রাঙিয়ে তোলা। চাই নিরবচ্ছিন্ন লেখাপড়া। হয়তো আকাশ সমান বাধা! বিস্তর প্রতিবন্ধকতা। সবচেয়ে বড় অন্তরায় চরম অর্থকষ্ট। এমনিতেই অর্থাভাবে দুর্ভিক্ষ আর মহামারী পরবর্তী জীবন বড় অসহায়! বিশাল দুর্বিষহ। বড় কঠিন সমাজে মাথা তুলে সোজা শিরদাঁড়া সমেত দাঁড়িয়ে থাকা। বেঁচে থাকা বড় দায়! লেখাপড়া সেখানে বিলাসিতা। তাছাড়া, দূরের স্কুলে পড়তে যাওয়ার মতো বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। হাতের কাছে অল্প যে ক'জন বন্ধু আছে, তারা সব দিকভ্রষ্ট। দিশাহীন। মাঠে ঘাটে চাষের কাজে ব্যস্ত। 

তবে উপায় কী? সম্ভব নয়‌ নিজের গোপন স্বপ্নপূরণ? নাহ! অসম্ভব। অলৌকিক শক্তির আশির্বাদ ব্যতিত পড়াশুনা টিকিয়ে রাখা আপাত কঠিন একটা টাস্ক।

(২)
অদৃশ্য শক্তি :

'হাট বসেছে শুক্রবারে'। অজানবাড়ির হাট। সপ্তাহে দুদিন। প্রত্যেক সোমবার আর শুক্রবার। অজানবাড়ির হাটে আচমকা মিলে গেল সেই অদৃশ্য শুভ শক্তির দেখা, যার খোঁজে দিনরাত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা নিবেদন করত রাম। এ হেন শুভ শক্তির সঙ্গে মিশে গেল তার আত্মশক্তির সংযোগ। হাটে প্রহ্লাদবাবুর পাশের মুদি দোকানদার শ্রী কেদারনাথ প্রামাণিক। পাশাপাশি দোকান হওয়ায় বেচাকেনার ফাঁকে সাংসারিক কথাবার্তা চলে অনায়াসে। কথায় কথায় উঠল রামের প্রসঙ্গ। পড়াশুনার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহের কথা। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র রাম। লেখাপড়ায় বরাবরই দারুণ আগ্রহ। ভালোবাসে পড়াশুনায় নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন মনে। অথচ উপায় নেই। সুযোগের সন্ধানে হাপিত্যেশ করে বেড়ায় সারাক্ষণ। আশেপাশে কোত্থাও স্কুল নেই! মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বড্ড আকাল এলাকায়। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে ক্লাস সিক্স অব্দি তার লেখাপড়ার চাকা মসৃণ এগোচ্ছিল। এরপর তার শিক্ষার গতি মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে দানবীর কর্ণ-এর রথের চাকার মতো থমকে দাঁড়ায়। একফোঁটা এগোয়নি। তখন ১৯৪২ সাল। অস্থির সময়। অস্তিত্ব বাঁচিয়ে লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল না সেসময়। দিনকে দিন স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। অশান্ত হয়েছে সময়। বন্ধ হয়েছে অধিকাংশ স্কুল কলেজ সরকারি অফিস আদালত ইত্যাদি। তারপর দেখতে দেখতে তিন বৎসর কাল অতিক্রান্ত। ১৯৪৫-এর তপ্ত আগুন এখন ঠাণ্ডা। বিশ্ব রাজনীতির উলট পূরাণ ঘটেছে। হিটলারী ক্ষমতার পতন হয়েছে। থেমে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বৃষ্টি ভেজা ধরিত্রীর মতো অশান্ত মেদিনী আংশিক শান্ত হয়েছে। কিন্তু ভারতবাসী দিশাহারা। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অকাল মৃত্যুর হৃদয় বিদারক সংবাদে বিপ্লবীরা ছত্রভঙ্গ। আংশিক দিকভ্রষ্ট রামও। তার জীবনের তিন তিনটা বছর নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হয়েছে তার অসীম উদ্দিপনা, পড়াশুনার প্রতি তীব্র আসক্তি। 
    
ওদিকে, দুই অভিভাবকের কথার প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে অনন্তের কথা। তার লেখাপড়ার গল্প। কেদারনাথ বাবুর ছেলে অনন্ত। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। অনন্তের বাড়ির পাশেও কোনও স্কুল নেই। অগত্যা সুযোগ বুঝে ছেলে অনন্তকে দূরে পার্বতীপুরে পাঠিয়ে দিয়েছেন কেদারনাথ বাবু, পড়াশুনা করতে। এখন সে পার্বতীপুর পতিতপাবনী হাইস্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। রেজাল্ট বেশ ভালো। মাস্টার মশাইরা দারুণ স্নেহ করেন। থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত বেশ ভালো। স্থানীয় একজনের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট। বাড়িওয়ালার দুজন বাচ্চা ছেলেকে পড়ায়। তার বদলে থাকা খাওয়া ফ্রি। একথা শুনে প্রহ্লাদবাবুর চোখ চকচক করে উঠল। এবার হয়তো অদৃশ্য সলতের দেখা মিলবে কুপীর অল্প আলোয় রাঙানো তাঁর মাটির কুঁড়ে ঘরে। তাঁর রামের একটা সুরাহা হবে। কেদারবাবুকে নিজের অসহায়তার কথা গোপন করলেন না। সব কথা খুলে বললেন প্রহ্লাদবাবু। শুনালেন বিস্তর বাধা বিপত্তি। কেদারবাবুও তাঁর মহানুভবতার পরিচয় দিলেন। তিনি বললেন — 'ছেলে পরের সপ্তাহে শুক্রবার বাড়ি ফিরবে। তখন না হয় ছেলে দুজনে পরস্পর আলাপচারিতা করবে', যদি বয়সে ছোট রামের পড়াশুনার একটু সুরাহা হয়।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
আজ শুক্রবার। হাট বসেছে পুকুর পাড়ে। শেষ বিকেলের লালচে আলোয় রামের সঙ্গে অনন্ত কুমার প্রামাণিক-এর দেখা। দুজনের কথা হচ্ছিল অজানবাড়ি বাজারের পুকুরঘাটে বসে। সময় আর জায়গা পূর্ব নির্ধারিত ছিল। সেজন্য অনন্তদাকে চিনে নিতে রামের অসুবিধা হয়নি। দেখা হতেই তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কাছে এগিয়ে গিয়ে অনন্তদাকে প্রণাম করে সে। পড়াশুনার ইচ্ছা প্রকাশ করে। রামের কথায় চাপা কষ্ট। অসহায়তা স্পষ্ট হয়। হৃদয়ের ব্যথা ঝরে পড়ে। অনুজ রামকে কাছে টেনে নেয় তার অনন্তদা। সহানুভূতি দিয়ে উদার কণ্ঠে সে বলল — 
'আগামী সোমবার সকালে রওনা হবো। চলো আমার সাথে, দেখি আমি কী করতে পারি। তোমার বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। দীর্ঘপথ হেঁটে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে যাবে।'
পড়াশুনার আশ্বাসবানীর কথা শুনে আনন্দাশ্রু ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে; গড়িয়ে পড়ে রামের দুগাল চিবুক বেয়ে। এমন সুযোগের সন্ধান পেতে অনেক বিনিদ্র রজনী পার করেছে সে, বুকে পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে। এবার বোধহয় পরমেশ্বরের কৃপাদৃষ্টি পড়ল তার উপর। তার মনে হল — 
'কোনো অদৃশ্য শক্তি আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে পথ দেখাতে শুরু করেছে।'

বাড়িতে তখন তীব্র টানাপোড়েন। স্নেহময়ী মায়ের মন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পড়াশুনার জন্য তাঁর রামকে বাইরে পাঠাতে রাজি তিনি। সমস্যা বাধল বাবাকে নিয়ে। প্রহ্লাদবাবুর মনে প্রখর দ্বন্দ্ব! পড়াশুনার আকাশ সমান খরচাপাতি, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি খরচ যোগানো তাঁর মতো অভাবী লোকের পক্ষে যেমন কষ্টকর; তেমনি দৈনিক মাঠের কাজ, হাটে-বাজারে ন্যূনতম একজন সঙ্গীর অভাবও তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। শেষমেশ মনের কথা মনে চেপে রেখে সম্মতি দিলেন প্রহ্লাদবাবু। শুরু হল শিক্ষার আলোকে পৌঁছতে রামের পথচলা। পিছনে পড়ে রইল নিত্য দিনের দুঃখ দৈন্যতা। (ক্রমশ...)


তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি

Post a Comment

0 Comments