জ্বলদর্চি

সোমলতা জাত সোমরস- আদতে সে যুগের এক চমৎকারী পানীয় /প্রসূন কাঞ্জিলাল

 জাত সোমরস- আদতে সে যুগের এক চমৎকারী পানীয়

প্রসূন কাঞ্জিলাল

নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের চিরকালের আকাঙ্ক্ষা ছিল অমর হওয়ার। শুধুমাত্র এই অমরত্ব লাভের উপায় খুঁজতেই অনেকে নিজের জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রাচীন যুগের যোগীদের থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের গবেষকরা পর্যন্ত সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়েছেন অমরত্ব লাভের খোঁজে। সন্ধান করেছেন অমৃত সুধা। যা পারে নিজের অস্তিত্বকে সমগ্র মহাজগতের সঙ্গে এক করে ফেলতে, নিয়ে যেতে পারে জাগতিক দর্শনের ঊর্ধ্বে। মানুষকে করতে পারে সর্বশক্তিধর, নিরোগ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং ধনরত্নপ্রদায়ক।

সোমলতা বা সোমরস তেমনি এক উপাদান। হাজার হাজার বছর ধরে চলছে অনুসন্ধান। গবেষণা চলছে এখনো। কারণ, ধারণা করা হয় এই সোমলতা থেকে নির্গত সোমরস মানুষকে এনে দিতে পারে অমরত্ব বা দীর্ঘায়ু! সোমরস বৈদিক চিন্তার একধরনের মহাজাগতিক শক্তি। একধরনের আধ্যাত্মিক নীতি। উদ্ভিদ জগতের প্রতিরূপ হলো এই সোমরস।

মূলত সোম হলো গুল্ম বা লতা। এই লতার রস ছিল আর্য এবং প্রাগবৈদিক যুগের ঋষিদের অতি প্রিয় পানীয়। সোমরস বিন্দু বিন্দু করে ক্ষরিত হতো বলে এর নাম দেয়া হয়েছিল "ইন্দু"। এই রস হতে একধরনের উত্তেজক তরল প্রস্তুত হতো। প্রাচীন মুনি-ঋষিদের বিশ্বাস ছিল সোমরস পান শুধু তাদের শক্তি এবং সাহস দেবে তাই নয়; বরং এটি পান করলে ধনার্জনে পারঙ্গমতা লাভ করবে এবং বেড়ে যাবে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাও। সোমরস ছিল যজ্ঞের প্রধান আহুতি।

সোমলতা থেকে সোমরস তৈরি হতো। দেবতাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে সোমরস অগ্নিতে আহুতি দেয়া হতো। ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলে সোম দেবতা নামে সোমের স্তুতি করা হয়েছে। বলা হয় বহুকাল আগেই সোমলতা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তা কতটা ঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই। এত জনপ্রিয় পানীয় সত্যিই  কি হারিয়ে গেছে?

লতা অর্থে শুধু পেচিয়ে গাছে জড়ানো উদ্ভিদ নয় বরং শীর্ণ কাণ্ড বিশিষ্ট উদ্ভিদও হতে পারে। বৈদিক যুগে হয়তো তেমনটাই বোঝাত। কেননা বেদে সোমলতার যে গাঠনিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার সাথে কাণ্ডবিশিষ্ট উদ্ভিদের মিল পাওয়া যায়।

যেমন:---

১. সোমলতার পাতা বিচিত্রকুশযুক্ত।
 (ঋগ্বেদ, ১/২৩/১৩,১৪) 

২. হে সোম! তোমার যে দুটি পাতা বক্রভাবে অবস্থিত ছিল তদ্বারা তোমার সর্বাপেক্ষা চমৎকার শোভা হয়েছিল।
 (ঋগ্বেদ, ৯/৬৬/২) 

৩. হে সোম, তোমার চতুর্দিকে লতা অবস্থায় যে সকল পত্র বিদ্যমান ছিল তদ্বারা তুমি সকল ঋতুতে সুশোভিত ছিলে। 
(ঋগ্বেদ, ৯/৬৬/৩) 

৪. এ সোম, শৃঙ্গ যূথপতি বৃষভের ন্যায় তীক্ষ্ম।
 (ঋগ্বেদ, ৯/১৫/৪) 

উপরের বর্ণনাগুলিতে বর্তমানের ইক্ষু তথা আখ গাছের সাথে হুবহু মিলে যায়। আখের দুটি পাতা ৺বাকা, আখ একবর্ষজীবী, ৩ নম্বর মন্ত্রে তা বলা হয়েছে। আবার এর পাতা ষাড়ের শিং এর ন্যায় ৪ নম্বরে বলা হয়েছে। শুধু তাই নয় ইক্ষু যেভাবে কান্ডের মাধ্যমে জন্মায় সোমের ক্ষেত্রেও তাই বলা হয়েছে।

৫. হে সোম, তোমার প্রধান উৎপত্তিস্থান স্বর্গের মধ্যে বিদ্যমান আছে, সেখান থেকে গ্রহণপূর্বক পৃথিবীর উন্নত প্রদেশে তোমার অবয়বগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, সে স্থানে তারা বৃক্ষরূপে জন্ম নিল।
( ঋগ্বেদ, ৯/৭৯/৪) 

আবার আখ জারিত করে গুড় তৈরির পদ্ধতিটি বর্তমানে যেমন ঠিক একই পদ্ধতির কথা ঋগ্বেদের ১ ও ৯ মণ্ডলের যথাক্রমে ক্রমিক ২৮ ও ৬৬ সূক্তে উল্লেখ করা হয়েছে সোমরসের ক্ষেত্রে।

অন্যদিকে সোমরসের রঙের বর্ণনাও রয়েছে বেদে :-----

৬. এর ধারা হরিৎবর্ণ। 
(ঋগ্বেদ, ৯/৬৬/২৬) 

৭. শুভ্রবর্ণ সোমরসগুলি ক্ষরিত হতে হতে এবং নানাবিধ স্তুতিবাক্য গ্রহণ করতে করতে উৎপাদিত হত। 
(ঋগ্বেদ, ৯/৬৩/২৫) 

৮. লেহিতবর্ণ সোমরসকে নিষ্পীড়নের দ্বারা প্রস্তুত করা হল। 
(ঋগ্বেদ, ৯/৮২/১) 

ইক্ষুরস লোহিত, পিঙ্গল কিংবা রস নিষ্কাশনের পর শুভ্র বর্ণ ধারণ করে। একারণে বলা যেতে পারে সোম হয়তো আখেরই অন্য নাম। পরবর্তী সময়ে এর নেশাজাতীয় যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে আখের আড়ালে সোম নামটি হয়তো চাপা পড়েছে।

কিন্তু যারা সোমকে মদ বলে মনে করেন তাদের জেনে রাখা দরকার যে হিন্দুধর্মে মদ বা যেকোন নেশাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

"নকী রেবন্তঃ সখ্যায়া বিন্দসে পীয়ন্তি তে সুরস্বঃ। / য়দা কুয়োসি নদানু সমূহস্যাদিত পিতেব হূয়সে"।।

( ঋগ্বেদ, ৮/২১/১৪) 

অর্থাৎ, তোমার নেশাকারী সঙ্গী অথবা বন্ধু যদি সবচেয়ে বিদ্বান বা ধনীও হয় তার উপরেও বজ্রপাততূল্য এবং অবশ্য পরিত্যাজ্য।

"সুরা বৈ মলমন্নানাং পাপ্মা চ মলমুচ্যতে। / তস্মাদ্ ব্রাহ্মণরাজন্যৌ বৈশ্যশ্চ ন সুরাং পিবেৎ।।"

 (মনুসংহিতা, ১১/৯৪) 

অর্থাৎ, সুরা হল অন্নের মলস্বরূপ, পাপরূপ তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় নির্বিশেষে সকলের জন্যই অবশ্য বর্জনীয়।

পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাচীন আখ্যানে অমরত্ব প্রদানকারী রূপে কোনো না কোনো বনস্পতির উল্লেখ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকি "প্লিনি" র রচনাতেও অমরত্ব প্রদানকারী "অ্যাম্ব্রোসিয়া" বা অমৃত শব্দ বিভিন্ন বনস্পতির প্রতি নির্দেশক। বনস্পতির দীর্ঘকালীন জীবন, প্রাচীন মানবদের নিকট চিত্রিত হয়েছিল - বনস্পতি মরণহীন রূপের প্রতিচ্ছবিতে। মানুষ সম্ভবত এ রকম দীর্ঘজীবী বৃক্ষগুলোকে দেখে প্রথম অমরত্ব লাভের কল্পনা করতেও শুরু করে।

পৃথিবীব্যাপী বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বেশকিছু পাইন ও অলিভ বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। যেগুলোর বয়স কয়েক হাজার বছর। অদ্যাবধি প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত প্রাণের একটি হলো "স্প্রুস গোত্রের বৃক্ষ"। যার অবস্থান সুইডেনে। "ওল্ড টিজেআইকেকেও " নামে পরিচিত। এই বৃক্ষের বয়স আনুমানিক প্রায় ৯ হাজার ৫ শত ৫০ বছর বলে ধারণা করা হয়। গবেষণা চলছে, হতে পারে এই প্রাচীন কোনো বৃক্ষের মাঝেই লুকিয়ে আছে চীরাকাঙ্ক্ষিত অমরত্বের রহস্য !

উৎপত্তিস্থল:---

তবে আধুনিক ধারণায় সোম আসলে শুধু একটি উদ্ভিদ নয়। যদিও একসময় নির্দিষ্ট কোনো স্থানে প্রাথমিকভাবে সোম উদ্ভিদ বা সোমলতার অস্তিত্ব ছিল বলে প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদ অনুযায়ী বিভিন্ন বিশেষ উদ্ভিদের পরিমাণ মতো মিশ্রণেও তৈরি হয় সোমরস (ঋগ্বেদ ১০/৯৭/৭)। 

এ ছাড়াও ঋগ্বেদে সোমের আরো কিছু ধরনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। যেমন, হিমালয় থেকে উৎপন্ন হিমবাহের জল। 
(ঋগ্বেদ ৬/৪৯/৪)। 

বেদ অনুসারে অগ্নি বা আগুনের প্রতিটি রূপের মধ্যেও রয়েছে সোম। এই ক্ষেত্রে মহাবিশ্বের সর্বত্রই সোমের উপস্থিতি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এমনকি অগ্নি এবং সোম, চীনা ‘ইন অ্যান্ড ইয়ং’ দর্শনের সমতুল্য।

প্রাচীন গ্রন্থে সোমরসের বর্ণনা অনুযায়ী, সোমরস শুভ্র-বর্ণ, ঈষৎ অম্ল ও মাদকতাজনক। যার জন্মস্থান মুজবান পর্বত কিংবা সরস্বতী নদী। বলা হয় স্বর্গ হতে শ্যানপক্ষী সোম আহরণ করে এনেছিলেন। এরপর সোমকে পর্বত হতে শকটে করে যজ্ঞ স্থানে আনা হতো। পরে পাথর বা লোহা দ্বারা ছেঁচে সোমরস নিষ্কাশন করা হতো। রস নিষ্কাশনের একটি পদ্ধতিও ছিল। দুই হাতের দশ আঙুল দিয়ে চেপে রস নিঙড়ানো হতো। পরে ‘তনা’ নামে মেষলোম - নির্মিত ছাঁকনি দ্বারা ছেঁকে দুগ্ধ মিশ্রিত করে সোমরস পান করা হতো। এটি ছিল অমরত্ব লাভের লুকায়িত জ্ঞান। যা যুগে যুগে মানুষেরা নিজেদের ভেতর ধারণ করে এসেছিলেন।

আধুনিক পণ্ডিতদের মতে "এফেড্রা" থেকে সোমরস তৈরি হয়। আফগানিস্তান এবং ইরানে এফেড্রা খুবই পরিচিত উদ্ভিদ। ফারসিদের কাছে এফেড্রাই ছিল সোম উদ্ভিদ। এমনটাই ধারণা করা হতো। বর্তমান যুগেও ভারতের কিছু অংশে এফেড্রার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যা সোমলতা নামে পরিচিত। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু মতভেদ রয়েছে। সোম নিঙড়ালে দুধের মতো রস নির্গত হয়। কিন্তু এফেড্রা শুকনো উদ্ভিদ যা থেকে সামান্য পরিমাণে রস নির্গত হয়। তাই এফেড্রা থেকে সোম রস তৈরির যুক্তি পরে খুব বেশি গ্রহণযোগ্যও হয়নি। 

প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে পৃথিবীব্যাপী সোমের সন্ধান খুঁজে চলেছেন গবেষকরা। তার মধ্যে বিগত আড়াইশ বছর ধরে বিশেষভাবে আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানদের মধ্যে চলছে সোম রস খোঁজার চেষ্টা।

চালর্স উইন্সকিনের মতে ,---  "সোম একপ্রকার লতাজাতীয় বনস্পতি। যা যজ্ঞ অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্যায়ে পশুবলির পর সোম রস পান করা হয়।"

গ্রিক জেনারেল জেনোফেন ৪০১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তার গবেষণায়---- তিনি মধুকে সোমরস বলে ভুল করেন।

১৮৫৫ সালে ম্যাক্সমুলার একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক শ্লোক উদ্ধার করেন। সেই শ্লোক অনুযায়ী সোম শুভ্র-বর্ণ, ঈষৎ অম্ল ও মাদকতাজনক। সোমরস নিয়ে এটিকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সঠিক বর্ণনা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
এছাড়া ড. ওয়াল্টার রক্সবার্গ, জর্জ স্টিফেনসন, ড. ডেভিড ফ্রোলে বিভিন্ন সময় সোমলতা এবং সোমরস আবিষ্কারে নিয়োজিত ছিলেন।

অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, সোমরস "অ্যামানাইটা মাসকারি"  মাশরুম থেকে তৈরি হয়। যার উৎপত্তি স্থল সাইবেরিয়াতে। বেদে সোমকে ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যার পাতা রয়েছে। কিন্তু মাশরুমের কোনো পাতা হয় না।

এছাড়া অথর্ব বেদে বলা হয় (অথর্ব বেদ ১১/৬/১৫) -- কিছু উদ্ভিদ যেমন মারিজুয়ানা বা গাঁজা, যব অথবা দূর্বা থেকে সোম অনেক উন্নত। কিন্তু ডারভা বা দূর্বার, মারিজুয়ানার মধ্যে সোমের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অন্যান্য উদ্ভিদ যেগুলো সোমের সাথে সংযুক্ত সেগুলো হলো পদ্ম এবং শাপলা। সোমের মতো এই উদ্ভিদগুলো পিষলে এদের থেকেও দুধের মতো রস নির্গত হয়। সোমরস সুমিষ্ট, এই রস যেমন পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো-তেমন দুধ, দধি ও ক্ষীরে দেয়া হতো মিষ্টতার জন্য। এই কারণেও হয়তো সোমকে মধুও বলা হয়ে থাকে।

আয়ুর্বেদে বিভিন্ন রোগনাশক ভেষজ ঔষধি উদ্ভিদের নাম হিসাবে সোমকে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান আয়ুর্বেদে সোম উদ্ভিদ বলতে কোনো একটি বিশেষমাত্র উদ্ভিদকে চিহ্নিত করে না। 

সোম উদ্ভিদ মানে উদ্ভিদগোষ্ঠীর প্রায় ২৪ ধরনের বিভিন্ন উদ্ভিদের সমন্বয়। সোম গোষ্ঠীর উদ্ভিদগুলোর ভেষজ গুণাগুণ সম্পর্কে বৈদিক ঋষিরা খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন।

সোমলতা মস্তিষ্কের সঙ্গে দেহের আত্মিক এক সম্পর্ক তৈরি করে - যা যোগাসন, প্রাণায়াম অথবা ধ্যান করতে  সাহায্য করে।

সোমকে প্রাচীন এবং পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবে ধরা হয়। যা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধিকারী, অনুপ্রেরণাদায়ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি উন্নয়নকারী। ধারণা করা হয় প্রতিটি সম্প্রদায়ে অথবা ভৌগলিক অঞ্চলে তাদের নিজস্ব সোমলতা রয়েছে।

ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের ৪৭ নম্বর সূক্ত:-- ‘এই সোম পীত হইয়া আমার বাক্যের স্ফূর্তি বিধান করিতেছে। ইহা অভীষ্ট বুদ্ধি প্রদান করিতেছে।’ কী সহজসরল বাস্তব অনুভূতি!

কিন্তু সোমরস জিনিসটা ঠিক কী? সম্ভবত আফগানিস্থান, পাকিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চলে "এফিড্রা সিনিকা" নামের এক লতা। কিন্তু পণ্ডিতেরা এখনও নিশ্চিত নন। আপাতত, তাঁদের ওই ব্যর্থতার জন্যই আমরা যথার্থ সোমরস পান করতে পারিনি , রাম-হুইস্কি আর কালী মার্কাতেই তৃপ্ত থাকতে হয়।

চাঁদনি রাতে এই লতাটাকে মূলসুদ্ধু উপড়ে, ছাগলে-টানা গাড়িতে নিয়ে আসা হত যজ্ঞস্থানে। আমাদের চেনা ব্যা-ব্যা করা ছাগল নয়। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আফগানিস্থানের তাগড়াই পাহাড়ি ছাগল। যজ্ঞস্থলে আগে থেকেই ঘাস আর কাঠকুটো দিয়ে একটা জায়গা করা থাকত। সেখানে ওই সোমলতাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পাথরে পেষা হত। তার পর ওই পিষে-যাওয়া লতাগুল্মকে পশমের ছাঁকনিতে রেখে দশ আঙুলে চটকানো হত।

 ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৯৪ নম্বর সূক্তে ---  সোমলতা পেষাই করার পাথরগুলির প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁরা, ‘এই অবিনাশী প্রস্তরদিগের গুণকীর্তন করে। দশ আঙুল যখন সোমরস নিষ্পীড়ন করার সময় এদের স্পর্শ করে, পাথরটাকে মনে হয় দ্রুতগামী ঘোড়া। দশটি রজ্জু তাদের টেনে নিয়ে চলেছে।’

পাথরে ছেঁচা, ঈষৎ হলুদরঙা ওই রস এ বার দুধে মিশিয়ে টানা ৯ দিন ধরে গাঁজানো বা জারিত করা হত। তার পরই তৈরি হত দেবভোগ্য সোমরস। আর কত যে সযত্নে রাখা হত তাকে! কাঠের পাত্রকে বলা হত ‘গ্রহ’। আর মাটির পাত্রকে বলা হতো ‘স্থালী’। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা... তিন বার সোম নিষ্কাশন করা হত। কে ক’বার টানবেন, তারও নিয়ম ছিল। যজমানেরা শুধু সন্ধ্যেবেলায় আর যজ্ঞের পুরোহিত বা ঋত্বিকরা তিন বারই।

বিদেশি বিজ্ঞানীদের সোমরস নিরসনের প্রচেষ্টা পরপর ব্যর্থ হয়ে আসছে। তবু ইউরোপ বা আমেরিকার বিশেষজ্ঞগণ আজও সোমরসের সন্ধান করে যাচ্ছেন। আজও সোমরস অনুসন্ধানে যে-পরিমাণ গবেষণা চলছে, তাতে বোঝা যায় সোমরসে হয়তো অমরত্বের সন্ধান থাকলেও থাকতে পারে। 

বিধর্মীরা মূলত “সোম” মানে কোনো মাদক পানীয় দ্রব্য হিসাবেই চেনে। অনেকে আবার সোমরস এর অর্থ হিসাবে সুরা বা মদ লেখে। এটা বর্তমান অনেক অভিধানে লিখেছে।

শ্রী গীতাতে সোম---
বাংলা ও সংস্কৃতে তে "সোম" এর সাধারণ মানে “চাঁদ”। কিন্তু সংস্কৃতে এর আনুমানিক ১৯ টি বিভিন্ন অর্থ আছে।
শ্রীগীতাতেও আছে-
“পুষ্ণামী চৌষধীঃ সর্ব্বাঃ সোমো ভূত্ত্বা রসাত্মকঃ”।

অর্থ-
(ঈশ্বর) রসাত্মক চন্দ্ররুপে ধান, যবাদি ঔষধী পুষ্টি করেন।
এখানে “সোম” মানে “চন্দ্র”।

যোগ বিদ্যায় সোম----
আবার যোগবিদ্যায় যোগীরা শরীরের পিনিয়াল গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনকে সোমরস বা অমৃত বলে থাকেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় যাঁরা দেহচক্র সম্বন্ধে ধারণা রাখেন তাহারা এই সোমরস সম্বন্ধে বুঝে থাকেন। "হটযোগ প্রদিপিকা" তে বহু স্থানে এর উল্লেখ আছে।
“সোম” এর প্রথম পরিচয় আমরা পাই ঋগ্বেদে। সেখানে একে “আয়ুবর্ধক অমৃত” বলা হয়েছে।
(ঋগ্বেদ ৮.৪৮.৩) 

"অ অপামা সোমম অমৃত অভূমগ্নাম জ্যোতির অবিদাম দেবাম।
চ কি নুনম অস্মান কমবদ আরাতিহ কীম উ ধুরতির অমৃত মর্তস্য।।"

এই মন্ত্রের মহর্ষি দয়ানন্দ এর ভাষ্যটি দেয়া হল-

সোম(ভাল ফল/খাদ্য কোনো মাদক পানীয় নয় ), অপামা (আমরা তোমাকে পান করি),অমৃত অভূম (তুমি জীবনীবর্ধক), জ্যোতির অগ্ণম (শারীরিক শক্তি দানকারী),অবিদাম দেবাম (ইন্দ্রিয়ের সংযমকারী),কি নুনম অস্মান কমবদ আরাতিহ ( আভ্যন্তরীণ শত্রু বা কু বাসনাকারী ইন্দ্রিয় বা কু-বাসনা আমার কী ই বা করতে পারে)কিম উ ধুরতির অমৃত মর্তস্য (হে ঈশ্বর, এমনকি হিংস্র মানুষ ই বা আমার কি করতে পারে)"

“হে সোম আমরা তোমাকে পান করি,তুমি জীবনীবর্ধক, শারীরিক শক্তি দানকারী, ইন্দ্রিয়ের সংযমকারী,এই পরিস্থিতিতে, আমার অভ্যন্তরীণ শত্রু(কু-বাসনা) আমার কী ই বা করতে পারে, হে ঈশ্বর,এমনকি হিংস্র মানুষ ই বা আমার কি করতে পারে”।

এখানে “সোম” মানে ভেষজগুনসম্পন্ন পানীয় বিশেষ।
ঋগ্বেদ এর নবম মণ্ডল এর অপর নাম সোম মণ্ডল বা বিশুদ্ধ সোম মণ্ডল।এই মণ্ডলে “সোম” এর বিভিন্ন অর্থ ও তার প্রয়োগ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। 

একইভাব সামবেদ এর পূর্বাক্তে ও প্রথম পর্বে সোমকে বর্ণনা করা হয়েছে এই রূপে-

১)আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধিকারী
২)অনুপ্রেরণাদায়ক
৩)বুদ্ধিবৃত্তি উন্নয়নকারী

৫. অথর্ববেদ ১৪.১.৩ তে বলা হয়েছে- “সাধারন ভাবে সোমকে তোমরা রোগনাশক হিসেবে জানো, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানীরা দ্বেষ নাশক অমৃতরুপ সোম এর সন্ধান করেন।"

আয়ুর্বেদে সোম--

আয়ুর্বেদে বিভিন্ন রোগনাশক ভেষজ ঔষধীয় উদ্ভিদের নাম হিসাবে “সোম” কে বর্ণনা করা হয়েছে।বর্তমান আয়ুর্বেদে “সোম” উদ্ভিদ বলতে কোনো একটি বিশেষ মাত্র উদ্ভিদ কে চিন্হিত করে না। “সোম” উদ্ভিদ মানে উদ্ভিদগোষ্ঠির ২৪ ধরণের ভিন্ন উদ্ভিদ সমূহ।

উদাহরণ-

Ephedra sp,
Saccharum sp ,
Desmostachya sp, 
Cannabis sp, 
Hordeum sp, 
Peganum sp, 
Nelumbo  sp, 
Papaver sp, 
Argyreia sp, 
Sarcostemma sp, 
Periploca sp , 
And
Some Different Species of Mushrooms Etc.

আর এই সমস্ত “সোম” গোষ্ঠীর উদ্ভিদগুলির ভেষজগুন সম্বন্ধে বৈদিক ঋষিরা খুব ভালো ভাবে পরিচিত ছিলেন। আর হবে নাই বা কেনো পবিত্র বেদের উপ-বেদগুলির একটি শাখা হলো এই “আয়ুর্বেদ”।

আবার হটযোগ প্রদিপিকা তে আমরা সঠিক “সোমরস” এর অর্থ খুঁজে পাই- সোমলতা নামক উদ্ভিদের নির্যাসিত রস, যা স্বাদে লবনাক্ত, বর্ণ সবুজাভ, দুগ্ধ, ঘি ও মধু মিশ্রিত এক ধরণের পানীয়। ইহা বিশেষ ভেষজ গুনাবলী যুক্ত এবং একজন যোগীর জন্য উত্তম পানীয়।

অর্থাৎ উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা পাই যে “সোম” শব্দটি্র একদিকে অর্থযুক্ত ও অপর দিকে রোগ নিরাময়কারী ঔষধ হিসেবে বিবেচিত হয় ও সে যুগের উপাদেয় স্বাস্থ্য বর্ধনকারী ও উত্তেজক পানীয় বিশেষ। 


তথ্যঋণ ----
১. ঋগ্বেদ সংহিতা , বাংলানুবাদ:রমেশচন্দ্র দত্ত 
(সায়ন , ম্যাক্সমুলার সহ অন্যান্যের ভাষ্যাদিকে টীকাকারে উল্লেখকৃত), 
হরফ প্রকাশনী 
(এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট 
কলকাতা ৭ ,১৯৭৬) 
২. শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার।
৩.  “ঋগ্বেদ ও নক্ষত্র” - বেলাবাসিনী ও অহনা গুহ , ১৯৬৯ , গোপা প্রকাশনী , কলকাতা ।
৪. ইন্টারনেট ও অন্যান্য।

Post a Comment

2 Comments

  1. বাহ্! খুব তথ্য পূর্ণ রচনা। অনেক কিছুই জানলাম।

    ReplyDelete