জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র-২ / দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র  
                        
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                            

দ্বিতীয় পর্ব


এই স্বয়ম্বর সভায় এসেছেন মদ্র, মৎস্য, প্রাগজ্যোতিষপুর, অন্ধ্র, যাদব, বৃষ্ণি, অঙ্গ, সুদূর কেরল রাজ্যের রাজন্যবর্গ অর্থাৎ সমগ্র ভারতবর্ষের রাজা-মহারাজারা। এছাড়াও জমিদার, ভূস্বামী, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য সকলে এসেছেন। স্বয়ং যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে নিয়ে এসেছেন দ্বারকা থেকে। অবশ্য তাঁর আসার উদ্দেশ্য স্বয়ম্বর সভায় কে কোথায় বসেছেন, কে কে এসেছেন, কার কতটা সাফল্যের সম্ভাবনা - সবকিছু নিজের চোখে দেখা, বলরামের অবশ্য ততখানি আগ্রহ নেই। অঙ্গাধিপতি কর্ণ সভাগৃহে প্রবেশ করছেন দেখে বলরাম কৌতুহলী হয়ে অনুজ বাসুদেবকে বললেন "দেখ বাসুদেব, আমার মনে হচ্ছে এই আসল লোক যে লক্ষ্যভেদ করবে। এত রাজা মহারাজার ভীড়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব, উজ্জ্বল মুখশ্রী, দীর্ঘ শালপ্রাংশু আজানুলম্বিত বাহুযুগল সবকিছুই স্বতন্ত্র। বাসুদেব সেই সময় কোন উত্তর দিলেন না কারণ সেই সময়ে অন্তপুরের দ্বার খুলে বস্ত্রাবরন সরিয়ে সেই হোমাগ্নি নিষ্ক্রান্তা অযোনিসম্ভবা দ্রৌপদীকে সভায় আনা হচ্ছে। কন্যাকে দেখে বাসুদেব বিস্মিত হয়ে গেলেন। শ্যামাঙ্গী হলেও অসামান্যা সুন্দরী একথা এতদিন ধরে শুনেছেন - কিন্তু সম্মুখে যাকে দেখলেন সে যে অদৃষ্টপূর্বা। মনে মনে উচ্চারণ করলেন এই সেই অপার্থিব রূপসী, সুরকন্যা দুর্লভ রূপ, হোমাগ্নিউদ্ভূতা কন্যা! কিন্তু কন্যার শুধু অনিন্দ্যসুন্দর রূপই নয়, তার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিদীপ্ত অক্ষিযুগলও বাসুদেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মনে মনে ভাবলেন - এ নারী মানবী নয়, দেবীও নয় এ অন্য কিছু। এ মেয়ে স্রষ্টার বলে সংহাররূপিনী হয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। লক্ষ্যভেদ করে যে বীর তাকে লাভ করবে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। চিত্তকে সংযত করে কয়েক লহমায় প্রকৃতিস্থ হয়ে অগ্রজকে তাঁর আপন ভাষ্যে উত্তর দিলেন "আপনিও মেয়েটিকে দেখেননি এবং হিসেবে ধরেনি মেয়েদের সম্বন্ধে যতটুকু জানি তাতে আমার মনে হয় এই মেয়ে সুতপুত্র বর্ণকে বরণ করবে না, কর্ণ সে চেষ্টা করলে হাস্যাস্পদ হবেন"। বাসুদেবের কথা শুনে বললেন - "হয়তোবা তোমার ধারনাই সত্য হবে, কারণ মেয়েদের অন্তরের কথা তোমার থেকে বেশি আর কেউ জানে না।"                               
স্বয়ংবর সভা অনুষ্ঠান হতে কিঞ্চিত বিলম্ব থাকায় বাসুদেব অগ্রসর হলেন অঙ্গাধিপতি কর্ণ যেখানে আসন গ্রহণ করেছেন সেই দিকে। অঙ্গাধিপতিকে তিনি তাঁর নিজের ও পরিবারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরে কর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে প্রতি নমস্কার করে ও প্রতি কুশল জিজ্ঞেস করে পাশে বসিয়ে বললেন "আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে মনে রেখেছেন এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে আপনি ইঙ্গিত করলে আমি আপনার কাছে যেতাম"। শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যুত্তরে বললেন "আপনি একমাত্র বয়সে আমার থেকে ছোট কিন্তু অন্যান্য বিষয় যেমন আপনার অকুণ্ঠ দান, পরোপকার ও জনসেবাতে আপনি সমগ্র ভারতে বিখ্যাত"। কর্ণ এই কথা শুনে লজ্জিত হয়ে বললেন "আপনি এই সমস্ত কথা বলে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। বয়সেও যেমন আপনি জ্যেষ্ঠ, বিদ্যা-বুদ্ধিতে, রাজনীতিতে, রননীতিতেও আপনার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বত্র খ্যাত। আপনার প্রতিভা অসামান্য, সর্বজনবিদিত। যাক্, আপনি বলুন আচার্য বলরাম সুস্থ আছেন তো? তাঁর কি আমার কথা স্মরণে আছে?                                  
শ্রীকৃষ্ণ সহাস্যে বললেন "বিলক্ষণ, তিনি আপনাকে মনে রেখেছেন শুধু তাই নয় আপনার উপরে তাঁর অগাধ আস্থা। সভাস্থলে আপনি প্রবেশ করার সময় অগ্রজ বলরাম আমাকে বললেন 'আপনিই একমাত্র ব্যক্তি এই সভাস্থলে যিনি আপন দক্ষতায় আজকের এই দুরূহ লক্ষ্যভেদ করে দেবাংশ জাতা,সুরবন্দিতা কন্যাকে লাভ করবেন'। বাসুদেবের এই কথা শুনে কর্ণ আনন্দে ও বিস্ময়ে আসন ছেড়ে বললেন "আচার্য বলরাম এই কথা কি করে বললেন? আমার মনে হয় আপনি সেই কথার রেশ ধরে আমার সাথে পরিহাস করছেন"। বাসুদেব ভ্রূকুঞ্চিত করে মুখে বিস্ময়ের ভাব এনে বললেন "আপনার মনে এই সন্দেহ কেন এলো? আপনি নিজেকে নিয়ে অযথা বিনয় করছেন, সত্য করে বলুনতো আজকের সভাস্থলে যেসকল রথী-মহারথীরা এসেছেন ধনুর্বিদ্যায় দক্ষ বলে পরশুরামের শিষ্য আপনি সকলের শ্রেষ্ঠ কিনা? অবশ্য তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন জীবিত থাকলে এ কথা বলতাম না। তখন হয়ত আপনাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত"। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

অর্জুনের নাম শুনে কর্ণের মুখমন্ডল আরক্তিম হয়ে উঠল, কিন্তু সেই অভিব্যক্তি ত্যাগ করে বললেন "আমি এখানে লক্ষ্যভেদের জন্য আসিনি। বন্ধু দুর্যোধন এসেছেন লক্ষ্যভেদ করে কন্যার বরমাল্য গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে, আমি শুধু তাকে সঙ্গদান করতে এসেছি"। দুর্যোধনের কথা শুনে বাসুদেব বললেন "অঙ্গরাজ এটা আপনার অতিশয়োক্তি বা বন্ধু প্রীতির প্রকাশ। আমি যতদূর জানি দুর্যোধন গদাযুদ্ধে যতখানি পারদর্শী তার এক দশমাংশও ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী নন। তাছাড়া আপনি মহাবীর, বীর্যশুল্কা কন্যা রক্ত লাভ করা আপনার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই প্রতিযোগিতায় যোগদান করা আপনার অবশ্য কর্তব্য। বন্ধু প্রীতি দেখিয়ে সেক্ষেত্রে আপনি হয়তো তার পরাজয় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন কিন্তু তারপরে আপনার লক্ষ্যভেদের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া উচিত"। বাসুদেবের এই কথায় কর্ণ যারপরনাই আনন্দিত হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এরপরে ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘন্টা বাজিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার প্রাক্কালে বাসুদেব কর্নের কাছ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অগ্রজের পাশে এসে বসলেন।  
ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘোষণা করে বললেন "সভাস্থ সকলে লক্ষ্য করুন সভাস্থলের একেবারে সর্বোচ্চ বিন্দুতে একটি লক্ষ্যবস্তু অর্থাৎ একটি মৎস্য স্থাপিত আছে। তার নীচে চক্রাকার একটি ঘূর্ণায়মান যন্ত্র আছে এবং নিচে একটি জলপূর্ণ পাত্র আছে। যিনি এই জলপূর্ণ পাত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঘূর্ণায়মান চক্রের ছিদ্রপথে নিচে স্থাপিত এই বৃহদাকার ধনুতে জ্যা রোপন করে পঞ্চশর নিক্ষেপ করে মৎসের চক্ষু বিদ্ধ করে লক্ষ্যভেদ করবেন আমার ভগিনী দ্রুপদ রাজকন্যা কৃষ্ণা তাঁর গলাতেই বরমাল্য অর্পণ করবেন"। ধৃষ্টদ্যুম্ন এরপর একে একে উপস্থিত প্রত্যেক রাজন্যবর্গের পরিচয় প্রদান করলেন। 
অবশেষে রাজারা লক্ষ্যভেদ স্থলের দিকে অগ্রসর হলেন। শল্য, শাল্ব, ক্রাথ, বক্র, কলিঙ্গ, বঙ্গ, বিদেহ, বৎস, সিন্ধু, কোশল, যবন, হস্তিনাপুর প্রভৃতি সকল রাজ্যের রাজারা চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাদের অনেকেই ধনুক তুলতে পারলেন না, কেহবা জ্যা পরাতে যেয়ে ছিটকে কিছুদূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে ধূলিধূসরিত অঙ্গে, স্খলিত বসনে উঠে দাঁড়ালেন। কারো বা মাথার মুকুট গড়াগড়ি খেতে লাগল। রাজাদের এই অবস্থা দেখে গবাক্ষ থেকে অন্তপুরের নারীরা পরনের বস্ত্রের সম্মুখ অংশ মুখে চাপা দিয়ে হাস্যরোল করে উঠলেন। দুর্যোধন সহ সকল রাজারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসার পরে মহাবীর কর্ণ লক্ষ্যভেদ স্থলের দিকে অগ্রসর হলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন তার পরিচয় প্রদান করলেন। সূর্যের নন্দন লক্ষ্যভেদস্থলে যেয়ে ধনুকে জ্যা রোপন করে যখন অধোদেশে জলপূর্ণ পাত্রে চক্ষু নিবেশ করে ঘূর্ণায়মান চক্রের ছিদ্রপথে শর নিক্ষেপ করে অভীষ্ট লক্ষ্যভেদ করলেন সেই সময়ে শঠচূড়ামনি বাসুদেব সকলের অলক্ষ্যে সুদর্শন চক্র নিক্ষেপ করে নিক্ষিপ্ত শরের গতিপথে বাধার সৃষ্টি করলেন যাতে কর্ণ সফলকাম না হন। কারণ কর্ণ সফলকাম হলে তাঁর আসল উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হবে না। এই সময সহসা দ্রৌপদী বলে উঠলেন "আমি সুতপুত্রের গলায় বরমাল্য অর্পন করার পূর্বে বিষপান করে আমার এ প্রাণের পরিসমাপ্তি ঘটাব"। সভাস্থ সকলে সেই মুহূর্তে দ্রৌপদীর এই কথায় যুগপৎ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। স্বয়ং ধৃষ্টদ্যুম্নও বিস্মিত হলেন এই কথায়, তথাপি তিনি কিছু বলতে পারলেন না। অবশ্য দ্রুপদ রাজার ইচ্ছা ছিল দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় বরমাল্য দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য পূরন করবেন। তাঁর উদ্দেশ্য একমাত্র তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে জামাতা করে তিনি দ্রোণের পূর্ব অপমানের প্রতিশোধ নিবেন।
                                              ………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

0 Comments