জ্বলদর্চি

ওঝা ও ডাইনি বিশ্বাস /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৫৬

ওঝা ও ডাইনি বিশ্বাস

সূর্যকান্ত মাহাতো


"বিখ্যাত পন্ডিত 'নগেন্দ্রনাথ বসু' তার 'বিশ্বকোষ' (ষষ্ঠ খন্ড) গ্রন্থে 'ছোটনাগপুর' ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন' এখানকার লোক 'ডাইনি'-তে বিশ্বাস করে। শুধু তাই নয় এই মেয়েদেরকে বিচারের জন্য আদালতেও যেতে হয়। মাঝেমধ্যে কোন কোন নারীকে এই জন্য মেরেও ফেলা হয়, নয় তো অপমানিত করা হয়। (পৃষ্ঠা- ৫৪৩) নগেন্দ্র বাবুর ওই ব্যাখ্যা আজকের জঙ্গলমহলে কতখানি প্রাসঙ্গিক?" তৃতীয় বর্ষে পাঠরত এক কলেজ ছাত্রী প্রশ্নটা করল।

বললাম,"উনার মতো পন্ডিত মানুষ যখন বলেছেন তখন ভুল কিছু বলেননি। একথা একেবারেই একশো শতাংশ সত্য। তবে উনি যে সময়ে এমন কথা বলেছেন তখন এই বিশ্বাস যতখানি ভয়ঙ্কর ছিল আজ আর ততটা নেই। কোথাও কোথাও একেবারেই নেই, আবার কোথাও কোথাও এই বিশ্বাস বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে। তবে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যেও একটা পরিবর্তন আসছে। এটা কম বড় কথা নয়। আসলে এই 'ডাইনি', 'ভূত-প্রেত'গুলো যদি মুদ্রার একটি পিঠ হয় তাহলে অন্য পিঠে বসে আছে 'ওঝা', 'গুণীন', 'গুরু', 'জান' এদের মতো মানুষেরা। তারাও এই অন্ধ বিশ্বাসগুলোকে সহজ সরল মানুষগুলোর মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া। অবাক করা বিষয় হল, একই মানুষের শরীর, অথচ কখনো 'ভূতে' ভর করে আবার কখনো 'দেবতা' ভর করে। ভূতে ভর করলে তখন সে পুরোপুরী ভূত , আবার দেবতা ভর করলে তখন সে পুরোপুরি দেবতা।"

"এটাতো দারুণ একখানি সত্য কথা বললেন। একই মানুষের শরীরে "ঈশ্বর" ও 'ডাইনি' বা 'ভূত' কীভাবে ভর করতে পারে! এটা বড় আশ্চর্যজনক। তবে এইসব ঈশ্বর 'ভর'-কে 'প্রবীর ঘোষের' মতো যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা তো স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন, "ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ কখনো অভিনয়" (অলৌকিক নয় লৌকিক, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রবীর ঘোষ, পৃষ্ঠা- ২৬৭)

"একদম। উনি দারুন সত্যিটাই তুলে ধরেছেন। এর প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যাও তিনি করেছেন উক্ত গ্রন্থে। তুমিও যদি এর পিছনের ইতিহাসটা একটু দেখো তাহলে তুমিও প্রবীর বাবুর মতকেই গ্রহণ করবে।"

"এই যে ওঝা, গুণী, ঝাড়-ফুঁক, তুকতাক, মন্ত্র এগুলো কীভাবে একটু একটু করে জঙ্গলমহলের জনসমাজে জাল বিস্তার করেছে তারও একটা সূচনা বা পর্যায়ক্রম আছে নাকি?"

"অবশ্যই! আর এই বিশ্বাসগুলোর পিছনে জঙ্গলমহল জুড়ে প্রবলভাবে উৎসাহের সঙ্গে পূজিত দেবী 'মনসা' পূজার একটা বিরাট ভূমিকা আছে।"

"বলেন কি মশাই, 'মনসা' পূজার সঙ্গে এদের কি সম্পর্ক?"

"'মনসা' পূজার সঙ্গে কীভাবে এগুলোর একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছে সেটা বলি। একটা বিশ্বাস হঠাৎ করে তো আর গড়ে উঠে না। তার পিছনেও একটা কারণ থাকে। এই বিশ্বাস ও ধারণাগুলোরও জন্মের পিছনে তাই মনসা পূজার একটা ভূমিকা তো আছেই।"

"এতটা জোর দিয়ে বলার কারণ?" 

"জ্যৈষ্ঠ মাসের 'রোহিণী' উৎসবের দিন থেকে আশ্বিনের 'ডাক সংক্রান্তি' পর্যন্ত এই ক'মাসে নানা সময়ে বেশ ঘটা করে মনসা পূজা পালিত হয়। জঙ্গলমহলে এটাও কম বড় উৎসব নয়। আর এই মনসা পূজা উপলক্ষ্যে চলে গুরুর কাছে শিষ্যের 'মন্ত্রজ্ঞ' হওয়ার অলৌকিক সাধনা। আর এই সাধনাই 'মন্ত্র' ও 'ওঝা' নামক একাধিক অলৌকিক বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।"

"'গুরু' বলতে ঠিক কারা?"

"'গুরু' হলেন সাপের 'ওঝা' বা গুণী বা গুণীন। মনসা দেবীর এরাই প্রধান পুরোহিত। মন্ত্রবলে কীভাবে বিষ নামাতে হয়, বিভিন্ন দেবদেবী ভূত ভৈরবদের কীভাবে ডাইনির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় এর সব কিছুই গুরু বা গুণীর নখদর্পণে থাকে।"( সীমান্ত বাংলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ, পৃষ্ঠা- ৭২-৭৩)

"কিন্তু মনসা দেবীকেই কেন বেছে নেওয়া হল?"

"কারণ এখানকার প্রাচীন মানুষ আর এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ তার জন্য অনেকখানি দায়ী। জঙ্গলমহল চিরকাল গভীর অরণ্যে ঘেরা। জনবসতি গড়ে ওঠার সময় বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার যেমন ছিল, তেমনি ছিল সর্প সংকুল। সাপের কামড়ে মৃত্যু ভয় ছিল সব থেকে বেশি। এবং এটিই প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। প্রতি পদে পদে ছিল বিষাক্ত সর্পাঘাতের ভয়। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তবুও কিছুক্ষণ লড়াই করা যায়, কিন্তু সাপের সঙ্গে নয়। কখন যেন চুপিসারে একটা বিষধর সাপ ছোবল মেরে মুহূর্তে তোমার জীবন কেড়ে নিয়ে চলে যাবে বুঝতেও পারবে না। তাই এই ভীত সন্ত্রস্ত ও বিস্মিত করে তোলা প্রাণীটি অতি সহজেই জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে নিজের পূজা আদায় করে নিয়েছিল। আর অন্য কারণটি হল, এখানকার অস্ট্রিকভাষী মানুষদের বসবাস। কারণ ভারতে সর্বপ্রথম সর্প পূজার প্রচলন করেছিল আদিম যুগে অস্ট্রিকভাষী মানুষেরাই। তারা সর্পকে টোটেম হিসাবে গ্রহণও করেছিল।(সীমান্ত বাংলার লোকযান, সুধীর কুমার করণ, পৃষ্ঠা- ৬৮)"

"তবে কি এই 'সর্প' পূজা বিশেষ কোন একটি সাপের পূজা?"

"না। এই সর্প হলেন, সমস্ত সাপেদের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে 'সর্প দেবতা'। ইনি হলেন সমস্ত সর্প কুলের প্রধান। বিষধর গোখরো সাপকে মেরে ফেলা পর পোড়ানো হয় কেন জানো? কারণ গোখরোকে সর্প কুলের ব্রাহ্মণের সমান বলে মানা হয়। তাই তাকে অতিরিক্ত সম্মান জ্ঞাপন করতেই পোড়ানো হয়।(সীমান্ত বাংলার লোকযান, পৃষ্ঠা ৬৯)" 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
"এখন অবশ্য যে কোন বিষধর সাপকে মারলেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুরোপুরি নির্বিষ করে তুলতেই এমনটা করা হয়। আবার যাতে সাপের কঙ্কাল পায়ে ফুটে না যায়, সেটাও একরকম নিশ্চিত করা হয়। তবে পোড়ানোর ওই আদি রীতিটির কারণ আগে জানা ছিল না। তাহলে আপনি বলতে চাইছেন সাপের মুখে হঠাৎ করে যাতে পড়তে না হয় কিংবা পড়লেও কীভাবে সেই বিষ থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যাবে সেই ভাবনা থেকেই কি তাহলে 'মন্ত্র' নামক শব্দের উৎপত্তি?"

"এমনটাই অন্তত মনে করা হয়। কারণ তখন তো বিকল্প কোন 'এন্টিভেনামসিরাম' এর মতো সমাধানের কথা জানা ছিল না বা সেরকম কিছু আবিষ্কৃতও হয়নি। নানান যাদু বিশ্বাসের উপরেই তাই নির্ভরশীল থাকতে হয়েছিল।"

"এই পূজা এবং এই বিশ্বাসগুলো গড়ে ওঠা কতটা প্রাচীন বলে মনে হয়?"

"কত প্রাচীন তা কোন নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ঋকবেদের একটি শ্লোকে একটি বিষঘ্ন মন্ত্রে এই দেবীর একটি ইঙ্গিত আছে--

"ত্রী সপ্ত ময়ূর্য সপ্ত স্বসারো অগ্রু বঃ
তাস্তে বিষং বিজভ্রির উদকং কুম্ভিনীরিব।।"(১.১৯১.১৪)

"বৌদ্ধ মহাযানেও বিষহরি এক দেবী ছিলেন "জাঙ্গুলী তারা"। বলা হয় এই জাঙ্গুলী তারাই নাকি 'জাগুলি', যা মনসার অন্য একটি নাম। এমনটা মনে হওয়ার একটি কারণও বলা হয়েছে। মহাযানতন্ত্র সাধনায় জাঙ্গুলী দেবীর যে দারুণ প্রতিপত্তি ছিল সেই একজটা তারা দেবীর মূর্তির প্রতিচ্ছবি পরবর্তীকালে নাকি মনসার মূর্তিতেও প্রতিফলিত হয়েছিল। (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস/ সুকুমার সেন, পৃষ্ঠা ১৫৬, প্রথম খন্ড)। প্রাচীন কবি বিপ্রদাস মনসামঙ্গল কাব্যে "জাগুলি" নামের একটি লোকব্যুৎপত্তিও দিয়েছেন, "জাগিয়া জাগুলি নাম সিজবৃক্ষে স্থিতি।" আবার পিতাম্বর দত্ত বড়থোয়াল সম্পাদিত 'গোরখবাণী'র ১২৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, সত্যযুগ ও মধ্যযুগ এক রকম রচিত হল- এক বিষধরী নিষ্পন্ন হল। বৃন্দাবন দাসের লেখাতেও পাই, চৈতন্যর জন্মকালে জনগণ বিষহরির পূজায় মত্ত ছিল।
সুতরাং মনসা পূজা ও সর্প বিদ্যা, বিষ-ঝাড়া মন্ত্রগুলো তখন থেকেই বিশেষ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকেই একটু একটু করে এখানকার জনমানসে শিকড় ছড়াতে শুরু করেছিল। যা এখনো কম বেশি সেই অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। বিষ্ণু পাল ও রসিক পালের 'মনসামঙ্গল' কাব্যে একটি বিষ ঝাড়ার মন্ত্র আছে এইরকম---"ডাহুকার বহুড়ি তারা ঘটে পানি ভরে।" আরো একটি বিষনাশক মন্ত্র হল, যেটা জাঙ্গুলি বোধিসত্ত্বকে শিখিয়েছিলেন,
"ইল্লা চিল্লা চক্ববক্কো কোডাকোডেতি মোডামোডেতি কুরুডা কুরুডেতি।"

"হ্যাঁ! শুনেই তো আমার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল। এই রকম মন্ত্র হয়! এইসব বলে কখনো সাপের বিষ নষ্ট করা যায় নাকি! এ তো হাস্যকর ব্যাপার !"

"তখনকার দিনে যেটা বিষ নিবারণের একমাত্র উপায় ছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, সেটা হাস্যকর বলেই মনে হয়। তখন এর বিকল্পও কিছু ছিল না। আসলে পুরোহিত তন্ত্রই মনসাকে অবলম্বন করে ও মনসার দোহাই দিয়ে এই সর্প মন্ত্র গুলো সৃষ্টি করেছিল।(সীমান্তবাঙলার লোকযান, পৃষ্ঠা- ৭০) পরে এগুলোই তাদের চ‍্যালাদের শেখাতেন। এভাবে চ‍্যালারাও একদিন গুরুর আসন লাভ করত। তারাও পরে নতুন চ‍্যালাদের শেখাতে লাগল। এভাবেই পরম্পরা গত ভাবে চলে আসছে। তবে সবটাই মানুষের ভয় ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েই।"

"গুরু বা ওঝা বা গুণীনরা 'রহিনী' বা 'মনসা' পূজার দিনগুলোতেই শেখাতেন কেন?"

"কারণ শিষ্যের কাছে আরো বেশি করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার জন্য।"

"কীভাবে সেটা করত?"

"ঐদিন দেবীকে গুরুরা আহবান করত নানান মন্ত্রগানে গানে। কখনো মড়ার খুলির মাথার উপর বসে, কখনো এক পায়ে শিলের(মশলা বাঁটা) উপর বসে, কখনো কয়েকগাছি বেত ধরে মন্ত্র গান করতে করতে দেবীকে আহ্বান করা হত। তারপর একসময় দেবতা এসে ভর করতেন শিষ‍্যের শরীরে। তখন শরীর কেঁপে কেঁপে উঠত। প্রবল বেগে মাথা নাড়তে শুরু করত তারা। বুঝতে হত এইবার দেবতা শরীরে 'ভর' করেছেন। তখন সে নানান অসাধ্য সাধন করতে পারে বলেই মনে করা হয়। নানান সমস্যার আশু সমাধানও বাতলে দিতে পারে, ভবিষ্যৎ বাণীও করে থাকে। গুরু তাকে জিজ্ঞেস করে, 'কোন দেবতা ভর করে এসেছেন?' ভরগ্রস্ত চ‍্যালাটি তখন একটি নাম বলবে, 'মনসা', 'শীতলা', 'ধর্ম' নয় তো 'সাত বাহিনী'। 'মনসা' হলে ধুনোর গন্ধ দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে হয়।"

"ধুনো! কিন্তু আমি তো শুনেছি মনসা পূজোয় ধুনো ব্যবহার করা হয় না?"

"ঠিকই শুনেছো। তবে মনসা পুজোয় এই ধুনো ব্যবহার নিয়ে অঞ্চলভেদে বেশ পার্থক্য আছে। চব্বিশ পরগনায় যেমন মনসা পূজোতে ধুনোর ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু জঙ্গলমহলে তা নয়। এখানে ধুনোর ব্যবহার অন্যতম একটি অঙ্গ।"


"গুরু শুধুই মন্ত্র শেখাতেন নাকি আরো কিছু?"

নানা ধরনের মন্ত্র যেমন তুকতাক সর্পমন্ত্র, ডাকিনী মন্ত্র, যোগিনী মন্ত্র, ধুলোপড়া, বাটিচালা, তেল দেখা সহ আরো নানান ক্রিয়া পদ্ধতি শেখাতেন। যুক্তিবাদী 'প্রবীর ঘোষ' তার 'অলৌকিক নয় লৌকিক' গ্রন্থে এর সবগুলোই হাতে-কলমে ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে এগুলো স্রেফ বুজরুকি ছাড়া আর কিছুই নয়।"

"গুরুগৃহে মন্ত্র গুলো আবৃতি করে করে শিখতে হয়। সাপের বিষকে কীভাবে 'জল' করে দেওয়া যায় তার নানান প্রক্রিয়াও শেখানো হয়। যেমন রোগী যদি ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করে তখন তাকে চাপড় মেরে সজাগ করতে হয়। এবং সেই সঙ্গে মন্ত্র পড়তে হয়-- "ফুটুক চুঁই চাপড়েতে বিষ নাই।" তাতেও কাজ না হলে আঙুল মটকে বলতে হবে,  "চাঁই চটকা, নাইরে বিষ আঙুল মটকা।" এরপর রোগীর শরীরে ফুঁ দিতে হবে। এভাবেই বারবার মন্ত্র পড়ে পড়ে রোগীর শরীরে ফুঁ দিতে হবে। এমন হাজার হাজার অলৌকিক মন্ত্র গড়ে উঠেছে।"

শুধু তাই নয়। ডাইনি ও ওঝার উদ্ভবের একটি কাহিনী ওঁরাওঁদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় আছে। এই কাহিনী সম্পর্কে লেখক P. Dehon  সাহেবের Vide Memoirs of the Asiatic society of Bengal (vol - 1) The Religion end Customs of the Uraons গ্রন্থে উল্লেখও আছে। সেখানে বলা হয়েছে, অনেক যুগ আগে মহাদেব ভাবলেন তাঁর ওষুধ ও মন্ত্রগুলো কোন এক যোগ্য শিষ্যকে শিখিয়ে যাবেন। একটাই শর্ত, শেখার পর শক্তিশালী হয়েও সেই শক্তির কোন অপব্যবহার করা চলবে না। অপকার করা চলবে না। হতে হবে জিতেন্দ্রীয়, নির্লোভ, নিরহংকার। অনেক অনুসন্ধানের পর সেরকম একজনকে পেলেন। তিনি সবকিছু শেখার পর ভাবলেন  তার শিক্ষাটাও কোন শিষ্যদের শিখিয়ে যেতে হবে। শর্ত সেই আগের মতোই। এভাবেই তিনি দুজন শিষ্য জোগাড় করে তাদেরকে মন্ত্র শিক্ষা দিলেন। দুজন শিষ্য এভাবেই গুরুর আশীর্বাদে 'গুণী' হয়ে গ্রামে ফিরে এল। একদিন মহাদেব ভাবলেন, এই দুই শিষ্যের একটা পরীক্ষা নিতে হবে। সন্ন্যাসীর বেশে তাদের সামনে উপস্থিত হলেন। বললেন, 'তোমরা গুরুবিদ্যা লাভ করে শক্তিধর হয়ে উঠেছ। এখন তোমরা দিনকে রাত ও সমুদ্রকেও শুকিয়ে ফেলতে পারবে।' এভাবেই সন্ন্যাসী নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে দুই শিষ্যের মনের মধ্যে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করলেন। সন্ন্যাসী নানাভাবে তাদের ফাঁদে ফেলারও চেষ্টা করলেন। এক সময় তারা সন্ন্যাসীর ফাঁদে পা ফেলে। তাদের বিদ্যার দৌড় কতটুকু হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তিনি অন্তর্হিত হলেন। একদিন হঠাৎ করে আসল গুরুকে কালসাপে দংশন করল। গুরু সঙ্গে সঙ্গে তার দুই শিষ্যকে ডেকে স্বর্গ থেকে অমৃত আনতে বললেন। না হলে তিনি বাঁচবেন না। অমৃত আনতে গিয়ে শিষ্য দুজনের সঙ্গে পথে আবার মহাদেবের দেখা হল। তিনি জানালেন এতক্ষণে তাদের গুরুর মৃত্যু হয়েছে। সেই শুনে শিষ্য দুজন ফিরে এসে দেখল, গুরু তখনও বেঁচে আছেন। সব শুনে গুরু বললেন, তাদের তিনি অনেক মন্ত্র শিখিয়েছেন। আরো কিছু বাকি আছে। কিন্তু তার আর শেখানোর উপায় নেই। তাই তার মৃত্যুর পর তার শরীরটা যেন নদীর তীরে নিয়ে যায়। তারপর তার যকৃতটা বের করে যেন দুজন খেয়ে নেয়। গোটা শরীরটাও কেটেকুটে পুড়িয়ে খায়। তাহলে তারা ভূত, দেবতা ও মানুষ সকলকেই বশীভূত করতে পারবে। গুরুর মৃত্যুর পর শিষ্যরা সেই নির্দেশ পালন কালে মহাদেব ফের এসে বললেন, গুরুর মাংস খাওয়া তাদের ঠিক হচ্ছে না। তাই সব নদীর জলে ফেলে দিতে বললেন। দুই শিষ্য সেটাই উচিত ভেবে তখন যকৃতের পুঁটলিটা নদীর জলে ভাসিয়ে দিল। গুরুর শরীরের মাংস পোড়া ধোঁয়া তখন আকাশে উঠছে। এমন সময়ে একজন প্রৌঢ় তার একুশটি মেয়ের সঙ্গে সেই নদীতে নৌকা বিহার করছিল। সেই সময় ছোট মেয়েটি সেই পুঁটলিটা দেখতে পায়। তখন সে পুঁটলিটাকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেও বাকিরা দেখতে পেয়ে যায়। এবং কাড়াকাড়ি করে সকলে খেয়ে ফেলে। আর অমনি তারা ভূত প্রেত বশীকরণ মন্ত্র শিখে গেল। এবং ভূতকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গিয়ে তারা সবাই  হয়ে উঠল 'ডাইনি'। ওদিকে গুনিদের কপালে মন্ত্রগুলো জুটল না। তারা চিতার যে ধোঁয়া উঠছিল সেটাই নাকে মুখে গ্রহণ করল। ফলে তারা ভূত ছাড়ানোর মন্ত্র পেল। আর এভাবেই তারা হয়ে উঠল ওঝা বা গুণীন।

"এরকম কাহিনীগুলিও সে সময় দারুন প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার ওপর শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, সেই সময় কার্য কারণ ব্যাখ্যার ক্ষমতাও ছিল না বলেই এমন অন্ধ বিশ্বাস গুলো টিকে ছিল। আজ শিক্ষার আলোয় তাই সব অন্ধ বিশ্বাসগুলোও একটু একটু করে উবে যাচ্ছে। সময় যত গড়াবে ততই আরো বেশি করে মানুষ এই বিশ্বাসগুলোকে একটু একটু করে ছুঁড়ে ফেলবে।"

Post a Comment

0 Comments